চতুর্থ দিনে চার মিনিটেই ছুটি। এ যেন উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের হুজ্জুতি ঠেকাতে মাস্টারমশাইয়ের ছুটির ঘণ্টা বাজানো! কিন্তু এ তো পাঠশালা নয়, দেশের সংসদ বলে কথা। দেশের সমস্ত জন-প্রতিনিধি এক গম্বুজের তলায়। এখানে অসময়ে ছুটি দেওয়া মানে কোটি কোটি টাকার অপচয়। তার পরিমান কতটা?
তিন বছর আগে বিরোধী আসনে থাকা বিজেপির হট্টগোলে সংসদের একের পর এক জরুরি অধিবেশন ভেসে যাওয়ার পর তখনকার সংসদীয় মন্ত্রী পবন বনশল একটি হিসেব প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, দিনে ছ’ ঘণ্টা করে বছরে গড়ে ৮০ দিন অধিবেশন চলে সংসদে। যদি সংসদের পিছনে হওয়া সমস্ত খরচ একত্র করা হয়, তা হলে প্রতি মিনিট অধিবেশন চালাতে সেই খরচ দাঁড়ায় আড়াই লক্ষ টাকা! আর আজ লোকসভা সচিবালয় হিসেব দিয়েছে, আনুষঙ্গিক সমস্ত খরচপত্র বাদ দিয়ে শুধু সংসদ চালানোর খরচটাই যদি ধরা হয়— প্রতি মিনিটে তা প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা! সংসদের বাদল অধিবেশনে প্রথম সপ্তাহে কাজ হয়েছে ৬ শতাংশ। বাকি ৯৪ শতাংশ শুধু অপচয়। মাত্র ১৮ দিনের এই অধিবেশনের প্রথম চার দিন এ ভাবেই কেটে গেল। সামনের হপ্তায় সংসদ চলবে, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই!
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, করদাতাদের কোটি কোটি টাকা অপচয় করে এ ভাবে স্রেফ হল্লা করে সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত কতটা অর্থবহ? অধিবেশন ভন্ডুল হবে জেনেও সোমবার থেকে সংসদ খোলার প্রয়োজনটাই বা কী?
হতাশা যে সংসদ থেকেও ফুটে ওঠেনি, এমন নয়। রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান পি জে কুরিয়নও বলেছেন, ‘‘এই অর্থহীন প্রক্রিয়ার মানেটা কী? রোজ আলোচনার নোটিস আমার কাছে জমা পড়ে। সব পক্ষের মত শুনে আলোচনার সম্মতিও দিই। কিন্তু তার পর আর কেউ আলোচনা করেন না!’’ খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও গত কাল সাংসদদের কর্মশালার অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘সাংসদদের উপরে মানুষের অনেক প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণে আমাদের কাজ করা উচিত। গোটা পৃথিবী কিন্তু নজর রাখছে আমাদের উপর।’’
কিন্তু আজ বিজেপি যেটি বলছে, অতীতে বিরোধী দলে থাকতে তো তারাই উল্টো কাজ করে এসেছে। সংসদ অচল করে ইউপিএ সরকারকে নাস্তানাবুদ করে গিয়েছে সেই সময়। পাঁচ বছর আগে বাজেট অধিবেশনে টুজি কেলেঙ্কারির জন্য মন্ত্রী এ রাজার ইস্তফার দাবি হোক বা আদর্শ কেলেঙ্কারিতে অশোক চহ্বাণের, সংসদ অচল হয়েছে রোজ। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফা চেয়ে সে বছরই শীতকালীন অধিবেশন ভন্ডুল করে দিয়েছিল বিজেপি। তার পর থেকে ইউপিএ জমানায় একের পর এক দুর্নীতি যে ভাবে সামনে এসেছে, অন্য বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি স্তব্ধ করে রেখেছিল সংসদ। অরুণ জেটলির মতো নেতা বলতেন, বিক্ষোভ দেখানোও সংসদীয় কৌশলের অঙ্গ। আর আজ কংগ্রেস বিরোধী দলে এসে সেই বিজেপির দেখানো পথে হেঁটেই নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর রাজনীতিতে মরিয়া।
জেডিইউ-র যে নেতা শরদ যাদব তখন রোজ সুষমা স্বরাজের সঙ্গে পরামর্শ করে সংসদ অচল করতেন, এখন বিজেপির সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর সেই সুষমার ইস্তফা চেয়ে একই কাজ করছেন কংগ্রেসের হাত ধরে। শরদ বলেন, ‘‘তখন যদি বিজেপির সঙ্গে মিলে আমরা কংগ্রেসের মন্ত্রীদের ইস্তফা চাইতে পারি, তা হলে এখন কেন পারব না?’’ আর বিজেপি বলছে, ইস্তফার তো প্রশ্নই নেই। মন্ত্রীরা নিষ্কলঙ্ক। বিরোধীরা আলোচনায় এলে বিজেপির ‘অপরাধ’ প্রমাণ করতে পারবেন না বলেই সংসদ ভেস্তে দিয়ে পালাচ্ছে।
সুতরাং সংসদ অচল করে লড়াই এখন চলছে বাইরে। কাল রাহুল গাঁধী সংসদের বাইরেই বলেছিলেন, এক জন ফেরার অভিযু্ক্তকে সাহায্য করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন সুষমা স্বরাজ। তাঁর জেলে যাওয়া উচিত। রাজ্য সফরে বেরিয়েও সরকারকে বিঁধছেন তিনি। আজ সংসদের বাইরেই নরেন্দ্র মোদী সরকারের মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী পাল্টা হুঙ্কার
ছেড়ে বললেন, রাহুল গাঁধী ক্ষমা না-চাইলে মানহানির মামলা করা হবে। তার আগেই আজ সকালে সংসদের গাঁধী মূর্তির পাদদেশে বিজেপির সাংসদরা ধর্নায় বসলেন কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীদের ইস্তফার দাবিতে। আগে বিরোধী দলই এখানে ধর্না দিত। প্রচারের আলো নিতে আজ শাসক বিজেপিও সেখানে ধর্নায় বসল।
মাঝখান থেকে যে ঘটনাটি নিরন্তর ঘটে চলেছে, সেটি হল সংসদের অধিবেশনের রফাদফা। দু’পক্ষই এখন আতসকাঁচে মাপছে কার দুর্নীতি কত বড়! আম আদমির কথা ভাবার সময় নেই কারও। অথচ আম আদমির করের টাকাতেই সংসার চলছে সংসদের, খাতায় কলমে সাংসদদেরও। এ সবের মধ্যে আটকে যাচ্ছে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ বিলও। আম জনতার স্বার্থ জড়িয়ে যে সব বিলে, সেগুলিও এখন নেতিবাচক রাজনীতির শিকার।