Advertisement
E-Paper

‘কাচা’ চাদরে দাগ, খাবার নিম্নমানের

‘রেল নীর’ ছাড়া অন্য অখ্যাত কোম্পানির জলের বোতল কী করে বিক্রি হয় বুঝতে পারি না।

সমীর গোস্বামী

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ ১৮:২২

গত বছরের মতো এ বছরেও সাধারণ বাজেটের সঙ্গে একত্রে রেল বাজেট পেশ করা হবে।

রেল বাজেট বললেই সাধারণ মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে নিত্যযাত্রীদের মনে অনেকগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে এসে পড়ে। তবে আগের চেয়ে সাধারণ মানুষ অনেক বেশি ওয়াকিবহাল হয়ে গিয়েছেন। আগে প্রথমেই যে প্রশ্নটা উত্থাপিত হত, সেটা হচ্ছে, রেলের ভাড়া বেড়েছে কি না। কিন্তু, গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য ভাড়া বাড়ানো হয়নি ঠিকই, কিন্তু তার ফল আদৌ ভাল হয়নি। আর্থিক অনটনের ফলে গোটা রেলব্যবস্থাটাই একেবারে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। আখেরে কোনও লাভই হয়নি। রেলে নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েই শঙ্কা দেখা গিয়েছে। স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি কারওর ভ্রুক্ষেপ নেই।

মানুষ বুঝতে পেরেছেন, ভাড়া কিছুটা বাড়লেও আসল প্রয়োজন নিরাপদ যাত্রা, স্বাচ্ছন্দ্য, পরিচ্ছন্নতা এবং সময়ানুবর্তিতা।

দুঃখের বিষয়, বর্তমানে সবগুলোই প্রশ্নের মুখে।

এর মধ্যে, স্বাচ্ছন্দ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিষয় দু’টির জন্য অতিরিক্ত ব্যয় অপেক্ষা দরকার যথাযথ নজরদারি। প্রশাসন যদি ‘গয়ং গচ্ছ’ ভাবের পরিবর্তে কর্মী মহলে কর্মসংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে কড়া মনোভাব নেয়, তা হলেই রেল যাত্রা অনেকাংশে স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়ে উঠবে।

প্রথমেই ‘কেটারিং’-এর কথায় আসা যাক। প্রাপ্ত হিসেবে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র রাজধানী ও শতাব্দী এক্সপ্রেসের মতো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনের খাবার সরবরাহের বিরুদ্ধে ২০১৪ সাল থেকে ৩১ অক্টোবর, ২০১৭ পর্যন্ত তিন বছরে লিখিত অভিযোগ হয়েছে ৯,৮০৪টি। রেলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কন্ট্রাক্টরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন দু’টির ক্ষেত্রে যদি এই হাল হয়, তা হলে অন্য ট্রেনগুলির ক্ষেত্রে কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়। মনে রাখতে হবে, অনেকেই সেই মুহূর্তে অসন্তুষ্ট হলেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু লিখিত অভিযোগ করার বাড়তি ঝামেলা নিতে চান না। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সংখ্যাটা তা হলে অনেক গুণ বাড়ত।

খাবারের মান দিনকে দিন এতই নিম্নগামী, অনেকেই আবার আগের মতো নিজেরাই খাবার নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রেলের খাবার মুখে দেওয়া যায় না। পয়সা দিয়ে কিনে, কিছু ক্ষণ নাড়াচাড়া করে ফেলে দিতে হয়।

খাবারের পরিমাণ রেলের খাতায় নির্দিষ্ট থাকলেও, দেখভালের অভাবে, বাস্তবে মেলে তার তুলনায় অনেক কম। এখন এমন অবস্থা হয়েছে, খাবারে পোকামাকড়, আরশোলা ইত্যাদি মেলার অভিযোগও আছে। গত ২৬ জুলাই হাওড়া থেকে নয়াদিল্লিগামী পূর্বা এক্সপ্রেসে এক যাত্রী বিরিয়ানির ‘অর্ডার’ দিয়েছিলেন। অভিযোগ, যে বিরিয়ানি তাঁকে দেওয়া হয়, তিনি তাতে দেখেন মড়া টিকটিকি রয়েছে।

ট্রেনের খাবারের গুণগত মান নিয়ে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (ক্যাগ) সংসদে যে রিপোর্ট কিছুকাল আগে পেশ করেন, তাতে স্পষ্ট লেখা আছে রেলের পরিবেশিত খাবার উপযুক্ত মানের নয়।

আরও পড়ুন: পেট্রোল-ডিজেলের কর কমিয়ে কোষাগারে আঘাত হানার সাহস দেখানো মুশকিল

যাত্রী মাত্রেই আর একটি অভিজ্ঞতা আছে। রেল ক্যাটারিং-এর ‘বেয়ারা’রা কখনওই মূল্য বাবদ বিল দেবেন না। হাতে একটা কাগজ নিয়ে এসে বার্থ নম্বর অনুযায়ী যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ‘অর্ডার’ নিয়ে লিখে রাখবেন। ট্রেন গন্তব্য স্টেশনে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে ধূমকেতুর মতো হাজির হয়ে, যা খুশি টাকা চাইবে। বিল চাইলে উত্তর মিলবে, ‘ট্রেন ঢুকে পড়েছে, এখন আর আনা যাবে না।’

রেলের নিয়মে বলা আছে, প্রতি কামরায় খাদ্য মূল্য ও পরিমাণের তালিকা লাগাতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! যদি বা কোনও ক্ষেত্রে লাগানো থাকে, সেটা এত পুরনো যে তা কোনও কাজেই আসবে না। এ ক্ষেত্রে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বোধহয় উল্লেখ করা যেতে পারে।

একসময় হাওড়া-গুয়াহাটির মধ্যে কয়েক মাস প্রায় নিয়মিত সরাইঘাট এক্সপ্রেসে যাতায়াত করতে হত। প্রতি বারই পরিমাণ নিতান্ত কম এবং বিস্বাদ খাবারের জন্য বুঝতে পারতাম বাড়তি মূল্য নিচ্ছে। তিতিবিরক্ত হয়ে আইআরসিটিসি (ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন)-এর তত্কালীন পূর্বাঞ্চলীয় গ্রুপ জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে পরিচয় থাকায় আগে ফোনে অভিযোগ করলাম। ওঁর নির্দেশমতো, পরে ওঁর অফিসে গিয়ে ওঁর হাতে লিখিত অভিযোগ দিয়ে এলাম। বেশ কয়েক মাস পরেও, অবস্থার কোনও পরিবর্তন না হওয়ায় আবার তাঁকে আমতা আমতা করে ফোন করলাম। ওঁর আবার নির্দেশ, লিখিত অভিযোগ কর। বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘সে কি, কয়েক মাস আগে তো আপনার অফিসে গিয়ে আপনার হাতে অভিযোগ দিয়ে এলাম। এবং আর একটি ‘কপি’ আপনার অফিসে জমা দিয়ে ‘রিসিভ’ করিয়ে নিয়ে এসেছি।’ ফোনের ও প্রান্ত থেকে আশ্বাসবাণী শোনা গেল, ‘আচ্ছা দেখবো।’

আর একটি অভিজ্ঞতার কথা না বললে সম্পূর্ণ হবে না। শিয়ালদহ স্টেশনে একটি খাবার বিক্রির স্টলে যে দাম লেখা থাকে, তার থেকে প্রতিটি খাবারের জিনিসের দাম ১০ টাকা নিয়মিত বেশি চাওয়া হয়। লিখিত দামের কথা বললে হয় উত্তর পাওয়া যায়, ‘ওটা পুরনো তালিকা’ অথবা বলা হয়, ‘এটা স্পেশাল কোয়ালিটি।’ কয়েক বার এ রকম হওয়াতে রেলের শিয়ালদহ বিভাগের বাণিজ্য বিভাগের প্রধানকে ফোন করে বিষয়টা জানালাম। বললেন, দেখবেন। মাস দু’য়েক পরে দেখলাম, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। আবার ফোন করলাম। এ বার অফিসারটি এমন একটি তুচ্ছ বিষয়ে আবার তাঁকে ‘বিরক্ত’ করার জন্য একপ্রকার প্রায় ধমক লাগালেন। বুঝতে পারলাম, ভেন্ডারটির টাকা বেশি নেওয়ার হক আছে।

রেল প্রচার করা সত্ত্বেও, ‘রেল নীর’ ছাড়া অন্য অখ্যাত কোম্পানির জলের বোতল কী করে বিক্রি হয় বুঝতে পারি না। বড় স্টেশনে মিলিয়ে মিশিয়ে বিক্রি হয়। মাঝারি স্টেশনে অন্য কোম্পানির জলের বোতল প্রকাশ্যেই বিক্রি হয়। নজরদারির ব্যবস্থা থাকলে সম্ভব হয়?

এয়ারকন্ডিশন্‌ড কামরায় রাত্রে শোবার জন্য বিছানা দেওয়া হয়। চাদর, বালিশের ওয়ারের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। রেল কর্তৃপক্ষও সেটা জানেন। বলা হল, ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কী ব্যবস্থা? দেখা গেল, চাদর দু’টি বাদামী প্যাকেটের ভেতরে দেওয়া হয়েছে। প্যাকেট খুলে ভিরমি খেতে হল। নেড়েচেড়ে দেখা গেল, আগের মতোই ব্যবহার করা চাদর। দাগ লেগে। অতি কষ্টে ‘কোচ অ্যাটেন্ড্যান্ট’কে (সাধারণত পাওয়া যায় না। ঘাপটি মেরে থাকে) খুঁজে বার করে মোলায়ম গলায় কারণটা জিগ্যেস করায় জানা গেল, কাচার জন্য যারা বরাত পেয়েছে, তারা রোজ কাচে না। ইস্ত্রি চালিয়ে প্যাকেটে ভরে দেয়।

অবশ্য যাত্রীদের কথাও বলতে হয়। স্টেশনে নামার আগে ধোপদুরস্ত হবার জন্য, বালিশের ওয়াড় খুলে জুতো মুছে নিতে দেখেছি। দাগ তো হবেই।

পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বলতে গেলেও দু’পক্ষের কথা বলতে হয়। কর্মীরা দায়সারা ভাবে পরিষ্কার করেন। যার জন্য ‘কোচিং ডিপো’ থেকে প্ল্যাটফর্মে খালি ট্রেন এসে দাঁড়ানোর পরেই ট্রেনের বাথরুমে গেলে অনেক সময়েই দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। মাঝপথে ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ালে, সাফাইওয়ালা অল্প কিছু সংখ্যক কামরা কোনও রকমে পরিষ্কার করেই পালিয়ে যায়। যাত্রীরাও অন্য যাত্রীর কথা ভাবেন না। কামরার ভেতরেও একই অবস্থা। চলন্ত ট্রেনে না হয় ঠিকমতো পরিষ্কার, না আসে যাত্রীদের চেতনা।

কামরায় জল না থাকা প্রসঙ্গে রেলের পক্ষ থেকে অনেক অজুহাত দেওয়া হয়। কিন্তু আসল কারণটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে কোনও দিনই এ সমস্যার সমাধান হবে না। সেটা হচ্ছে, কামরায় জল ভরা যে কর্মীদের দায়িত্ব, তাঁদের সময়মতো খুঁজে না পাওয়া। নীচের তলার কর্মীরা দিন কে দিন ‘আসি যাই, মাইনে পাই’ নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে। এর একমাত্র দাওয়াই হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত কড়া প্রশাসন।

অবশ্য কর্মী সঙ্কোচনের প্রভাবও কিছু মাত্রায় হলেও দায়ী। এক দিকে কর্মীর সংখ্যা কমেছে, অন্য দিকে ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। তার ফলে কাজের চাপ বাড়ার কথাও অস্বীকার করা যাবে না।

ঢিলেঢালা ওপরতলার সুযোগে একদল কর্মী ফাঁকি দিয়ে চলেছে। আর এক দলের উপর সেই চাপ পড়ছে। স্বভাবতই পরিষেবার মান খারাপ হতে বাধ্য।

সময়ানুবর্তিতা? রাজধানী এক্সপ্রেসও ৩০ ঘণ্টা দেরিতে চলছে। এর আলোচনা এই পরিসরে কুলোবে না। লাইন না বাড়া, পরিবর্তে ‘গিমিক’ দেওয়ার জন্য অসংখ্য ট্রেন বৃদ্ধি, কুয়াশা, লাইন সংরক্ষণের জন্য ‘ব্লক’ নেওয়া, লাইনে ফাটল, ইঞ্জিন, কামরা, মালগাড়ি, সিগন্যাল পথিমধ্যে বিকল হয়ে যাওয়া, রেল বহির্ভূত কারণ— সব আলোচনা অসম্ভব।

Rail Budget Union Budget Central Budget Budget 2018 Budget 2018-19 Passenger security Cleanliness Safe journey Punctuality
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy