এক সপ্তাহ আগে গিয়ে বাংলাদেশি সন্দেহে শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ পর্যন্ত শুনে এসেছি গুরুগ্রামের বহুতলের ছায়ায় পড়ে থাকা পুতিগন্ধময় বস্তিগুলি থেকে। এর মাঝে তৃণমূলের পাঁচ সাংসদ গিয়ে শুনেছেন, পোশাক খুলিয়ে ধর্ম যাচাই করার অপমানের কথা। আজ জমাট কাদা পেরিয়ে সেক্টর ৬১-র কেদারপুর সব্জিমান্ডির বঙ্গ-বস্তিতে গিয়ে শুনলাম বাঙালি হেনস্থার নতুন সংস্করণ। অভিযোগ, বস্তি থেকে লোকজন তুলে নিয়ে গিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া।
স্বল্প পরিসর কুয়োতলায় দ্রুত স্নান সারছিলেন দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর থানার আব্দুল কালাম। সপরিবার পাততাড়ি গুটিয়ে আজই ফরাক্কা এক্সপ্রেস ধরবেন। টিকিট কাটা। ছেড়ে দিচ্ছেন এখানে বহুতলের ঝাড়ুপোঁছার কাজ। বললেন, “সব দেখিয়েছি। আধার, প্যান, ভোটার কার্ড। এর পরে নতুন কিছু চাইলে আমার কাছে নেই। আর আমরা একেবারেই গরিব মানুষ। বিশ হাজার টাকা চাইলেও দিতে পারব না।”
বিশ হাজার? এমনটা আগের সপ্তাহে এসে শুনিনি! নড়বড়ে একটা বেঞ্চে বসে কথা বলতে বলতেই ছোট জটলা জমে গেল। এসেছেন কালামের বিবি তারা বানু এবং বোন শিউলি। এ-ঘর ও-ঘর থেকে আরও কেউ কেউ। যাঁদের মধ্যে কেউ এখনও এই তল্লাট ছাড়েননি, কেউ ছাড়তে তৈরি হচ্ছেন। তারা বানুর কথায়, “সেক্টর ৬৫-র থানায় নিয়ে গিয়ে আমাদের এই বস্তিরই এক চেনা লোকের কাছ থেকে পরিচয়পত্র দেখতে চেয়েছিল। তার পর প্রশ্নের পর প্রশ্ন। শেষে চড়থাপ্পড়। সব শেষে পঞ্চাশ হাজার টাকা চেয়েছে, ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে। কতয় রফা হয়েছে, জানি না। সেই লোক চলে গিয়েছে নয়ডার কোনও বস্তিতে।”
পুলিশের টাকা চাওয়ার অভিযোগ উঠছে কেদারপুরের এই বস্তিতে। যার শুরু হয়েছিল নাকি এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে দিয়ে। শিউলির বক্তব্য, “আমরা জানতাম না উনি বাংলাদেশি। সামনেই কাপড়ের দোকান দিয়ে বেশ ঠাটবাটে থাকতেন। পুলিশ তুলে নিয়ে গেলে, পরিচয়পত্র থেকে নাকি পরিচয় ফাঁস হয়েছে। অথচ তাকে ছেড়েও দিয়েছে একদিন পর। বাংলাদেশে ফেরায়নি। কানে এসেছে, দু’লাখ টাকা খেয়েছে পুলিশ। তবে এখানে আর থাকতে দেয়নি। বড় গাড়িতে মালপত্র গুটিয়ে সে চম্পট দিয়েছে, অন্যত্র।’’ তার পরেই তাঁর ক্ষোভ, ‘‘টাকা রয়েছে বলে বাংলাদেশি পার পাচ্ছে, আর আমরা এই দেশের নাগরিক হয়েও গরিব বলে, টাকা খাওয়াতে পারব না বলে, ভয়ে পালাচ্ছি।”
নিজের রাজ্যে কাজ করলে দিনে বড়জোড় দেড়শো টাকা মজুরি পাওয়া যায়, এই অভিযোগ সেক্টর তেষট্টির উলাবাস বস্তির বাসিন্দাদের। দক্ষিণ দিনাজপুরের হায়দর শেখের বক্তব্য, “তাতে তো সন্তানের প্রতিপালন হয় না, শুধুমাত্র নিজেদের পেটটুকু চলে যায় মাত্র। তাই কষ্ট করে এখানে আসা এবং পড়ে থাকা।” আপাতত এই বস্তিতে পুলিশের অথবা নম্বরহীন প্লেটের গাড়ির আনাগোনা কমেছে বলেই জানালেন তিনি। জানা গেল, এই বস্তিতে আপাতত শান্তির একটা কারণ, আশপাশের বহুতলের ময়লা সাফ করার লোকের প্রবল অভাব ঘটছে। বস্তির পর বস্তি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, সাফ-সাফাই, বাসন মাজা, দিনগত নোংরা ফেলার লোক মিলছে না। আকাশছোঁয়া আবাসনগুলির প্রতিনিধিরা স্থানীয় থানার কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে, বিষয়টি সামলানোর চেষ্টা করছেন। নিজেদের স্বার্থেই চেষ্টা করছেন, বস্তির বাঙালিরা যাতে গুরুগ্রাম না ছাড়েন। এমনকি, এর পরে কিছু বস্তিতে পুলিশ এসে বলেও গিয়েছে, ‘যারা পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক, তাঁদের কোনও ভয় নেই। কাগজপত্র নিয়ে থেকে যান। শুধু বাংলাদেশিদের ধরিয়ে দিতে হবে।’
দেখা যাচ্ছে, এই ‘বাংলাদেশি ধরিয়ে দেওয়ার’ মোড়কে মেরুকরণ রয়েছে কমবেশি। সাংবাদিক দেখে যেমন গলাটা একটি বেশিই তুললেন কাকদ্বীপের অনুপম জানা, “অভাবের তাড়নায় এসেছি এখানে, স্থানীয় বাড়িগুলিতে গাড়ি ধোয়ার কাজ করি। বাংলাদেশি দেখলেই তাড়াব এখান থেকে। কিছু তাড়িয়েওছি। আমাদের রুজিতে টান মারছে ওরা। মোদী যা করছেন, ঠিক করছেন।” সেই সঙ্গে নিজেকে নিরাপদে রাখার তাগিদ থেকেও হয়তো বার বার বললেন, “আমার ভাই বিএসএফ-এ কাজ করে। আমরা সবাই দেশভক্ত।” হরিপুর, নামখানার পরেশচন্দ্র মাইতি এক মনে বাঁধাকপি কাটছেন। রাস্তার কাছেই ছোট খাবারের দোকান তাঁর। সাড়ে আট বছর রয়েছেন এই বস্তিতে। তাঁর মত, “লোকে ভয়েই এলাকা উজাড় করে পালিয়েছে। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে হয়তো ফিরবে। তবে গত কয়েক দিন হল, কেউ এসে লাল চোখ দেখাচ্ছে না। এত ভয়ের কিছু নেই অন্তত এখানে।” অথচ তাঁদের পাশের ঘিঞ্জি গলিতেই গালে হাত দিয়ে বসে দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে আসা রাজমিস্ত্রি জামিল খান। বললেন, “এই বস্তি থেকে বেরিয়ে বাইরের বড় রাস্তায় পা রাখতে ভয় লাগছে গত দু’সপ্তাহ ধরে। বাংলায় কথা বলছি বলে এখানে পেটে লাথি না খেতে হয়! অথচ দেখুন বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সংসার, কাজে না গেলে খাওয়াব কী?”
আতঙ্ক রয়েছে, অস্পষ্টতা রয়েছে। সব মিলিয়ে ভবিষ্যৎ সরু সুতোর উপর ঝুলে রয়েছে অভিজাততন্ত্রের আঁস্তাকুড়ে, কোনও মতে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এই বিপুল সংখ্যক বাঙালির।
(চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)