E-Paper

ধুলো মেখে ‘বদলাও’-এ নেমেছেন দিদির সেই পিকে

পিকে-র হাতে থাকা পরামর্শদাতা সংস্থা তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়াও নরেন্দ্র মোদী, নীতীশ কুমার, অরবিন্দ কেজরীওয়ালদের সঙ্গে নানা সময়ে কাজ করেছে। সেই সংস্থার সঙ্গে পিকে-র যোগ এখন অতীত।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৩১
বিহার ‘বদলাও যাত্রা’য় প্রশান্ত কিশোর।

বিহার ‘বদলাও যাত্রা’য় প্রশান্ত কিশোর। —নিজস্ব চিত্র।

দফতরে দেখা হয়েছিল তো কলকাতায়। এ বার ‘স্যর’কে ময়দানে দেখুন। ওঁর ‘বদলাও যাত্রা’ দেখুন। সুবিধা হবে।

ঝকঝকে দফতরে তাঁর মিডিয়া ম্যানেজার তরুণীর দেওয়া পরামর্শ মেনে বেরিয়েই পড়া গেল। এবং পাবলিক স্কুল ময়দানের চারপাশে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে হল! চার দিকে শুধু হলুদ আর হলুদ! পতাকা-ফেস্টুন হলুদ, কর্মী-সমর্থকদের গলায় উত্তরীয় হলুদ। সার দিয়ে থাকা গাড়ি ও বাইক সেই হলুদেই রাঙানো। মোবাইল উঁচিয়ে ‘জয় বিহার’ স্লোগানরত জনতার মাঝে সাদা কুর্তা-পায়জামা পরিহিত তিনি এক হাতে কর্ডলেস মাইক ধরে মঞ্চে উঠে গেলেন। তাঁর আহ্বান, ‘‘নীতীশ, লালু, মোদী অনেক হল। এ বার নিজের সন্তানের মুখ মনে করে ভোটটা দিন। শিক্ষা ভাল হোক, রোজগারের ব্যবস্থা হোক, অপরাধ কমুক। বিহারকে বদলান!’’

ইনিই নব কলেবরের প্রশান্ত কিশোর! সব মহলে চেনা নাম ‘পিকে’। এক সময়ের দুঁদে ভোট-কুশলী। বাংলায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আসন খুইয়ে ধাক্কা খাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে ‘দিদিকে বলো’র মতো নানা রসদ জুগিয়ে দু’বছরের মধ্যে আবার বিপুল ভাবে ঘুরে দাঁড় করানোর অন্যতম কারিগর বলে যাঁকে ধরা হয়। পিকে-র হাতে থাকা পরামর্শদাতা সংস্থা তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়াও নরেন্দ্র মোদী, নীতীশ কুমার, অরবিন্দ কেজরীওয়ালদের সঙ্গে নানা সময়ে কাজ করেছে। সেই সংস্থার সঙ্গে পিকে-র যোগ এখন অতীত। ‘জুন সুরজ’ নামে নতুন দল খুলে তিনি এখন সরাসরিই নেমে গিয়েছেন রাজনীতির ময়দানে। বিহারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন তাঁর সামনে বড় পরীক্ষা।

পিকে-র সংস্থার পরামর্শে বাংলায় তৃণমূলের সব নেতা-বিধায়কদের গাড়ি যেমন মমতার ছবি দেওয়া প্রকল্পের স্টিকারে ছেয়ে গিয়েছিল, বিহারে এখন অনেকটাই সেই ছবি। পিকে-র ছবি-সমেত ‘জন সুরজে’র স্টিকার, সেই সঙ্গে রাজ্য জুড়ে ঘুরছে অজস্র হলুদ গাড়ি এবং বাইক। পিকে এখন বেরিয়েছেন ‘বিহার বদলাও যাত্রা’য়। মিছিল, এলাকাভিত্তিক জনসভা হচ্ছে। হলুদ রঙের জাম্বো ভ্যান পিকে-র সঙ্গে ঘুরছে। ধরন দেখলে বাংলায় এর আগে হয়ে যাওয়া অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচির কথা মনে পড়ে যাবে। তফাত বলতে শাসক দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে অভিষেক পুলিশ-প্রশাসনের যাবতীয় বন্দোবস্ত পেয়েছিলেন, পি কে-র দলকে সেখানে কখনও কখনও সংঘর্ষের মুখে পড়তে হচ্ছে। পিকে-র নামে এফআইআর-ও দায়ের হয়েছে।

পটনার পাটলিপুত্র কলোনিতে ‘জন সুরজে’র মূল দফতর। দেহাতি রাজনীতির ওঠাপড়ায় অভ্যস্ত বিহারে এই দফতর চলে কর্পোরেট কায়দায়। পিকে নিজে থাকেন অভিজাত বেইলি রোডে এক প্রাক্তন সাংসদের বাংলোয়। সামান্য নজরেই খরচের বহর বোঝা যায়। কোন কেন্দ্রে কোন সম্প্রদায়ের কেমন জনবিন্যাস, কোন ধরনের লোককে প্রার্থী করলে ফায়দা— সে সব যে তাঁদের ছকে নেওয়া হয়ে গিয়েছে, দু’টো উপনির্বাচনে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আর পাঁচটা দলের দফতরে ঘুরে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না, এখানে মজুত। দুর্ঘটনার বিমার সুবি‌ধার কথা বলে অটো ও টোটো-চালকদের সংগঠন খুলেছে পিকে-র দল। আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, সরকার হলে সহজ শর্তে গাড়ির ইএমআই-এর ব্যবস্থাও হবে।

কলকাতায় দেখা সেই চেহারায় একটু মেঠ‌ো ছাপ যোগ হয়েছে। হয়তো মেপেই! বাঁ হাতের দুই আঙুলে লিউকোপ্লাস্ট, ধাক্কাধাক্কিতে আঘাতের জের। সাদা দাড়ি, কা‌লো অবিন্যস্ত চুলের পিকে সভার শেষে গাড়ির ছাদে উঠে বসেন কথা বলার জন্য। ‘‘শুধু এসআইআর (বিশেষ নিবিড় সংশোধন) দিয়ে তো ভোট হয় না। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও রোজগারের কথা ভেবে এ বার ভোট দিন, এটাই আমাদের মূল কথা। বিহারের ৫০ লক্ষ লোক ১০-১২ হাজার টাকার জন্য বাইরে কাজ করতে যায়। এমন সরকার চাই, যারা রাজ্যেই কাজের ব্যবস্থা করবে। অপরাধ কমাতে হবে।’’ বলছেন তিনি। অপরাধের বিরুদ্ধে তেজস্বী যাদবেরাও তো সরব? হাসছেন পিকে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘তেজস্বীরা অপরাধের বিরুদ্ধে বলার মানে বাঘের শাকাহারী হওয়া! ওঁরা আগে সরকার চালিয়েছেন, বিহার তখন খুন, দুর্নীতি, অপহরণের স্বর্গরাজ্য ছিল। এখন নীতীশ কুমারের হাতে নিয়ন্ত্রণ নেই, এই সরকারের আয়ুও ফুরিয়ে এসেছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘মোদীর ভয়ে লালুকে ভোট, আবার লালুদের যাঁরা ভয় পান, তাঁদের ভোট মোদী বা নীতীশকে— এই চক্কর থেকে বিহারকে বেরোতে হবে!’’

শাসক ও প্রধান বিরোধীর বাইরেও সাধারণত বিহারে অন্যান্য দল সব মিলিয়ে ২০-২২% ভোট পায়। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মত, পিকে এই অন্যান্য অংশের ভোটকে এককাট্টা করতে চাইছেন এবং তাঁর চেষ্টায় আখেরে মোদী-নীতীশ জোট সুবিধা পেয়ে যেতে পারে। সে কারণেই পিকে-র প্রতি তেজস্বীর কটাক্ষ, ‘‘আকাশে বাদল এলে যেমন ব্যাঙ বেরোয়, এঁরাও তেমন! মরসুমি।’’ জবাব? ‘‘বর্ষা চলে যাবে, ভোটও যাবে। ভোটের পরে অনেক কিছুই দেখা যাবে!’’

ধুলোর ঝড় তুলে পরবর্তী গন্তব্যে এগিয়ে গেল ‘বদলাও যাত্রা’!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bihar Prashant Kishor Bihar Assembly Election 2025

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy