Advertisement
E-Paper

নাগরিক পঞ্জীর নবীকরণ, আশঙ্কায় বাংলাভাষীরা

অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী নবীকরণের (এনআরসি) সময় ঘোষণা করা হয়েছে। এ বার এই রাজ্যের বাংলাভাষীদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। আবেদনকারী নিজে বা তাঁর পূর্বপুরুষ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে ভারতে রয়েছেন, এমন নথি দেখতে চাইবে সরকার। এ নিয়েই ছড়িয়েছে দুশ্চিন্তা। অধিকাংশ মানুষের কাছেই ওই সময়ের কোনও নথি নেই। এত আগের কাগজ জোগাড় করাও সহজ নয়। এতে নতুন সঙ্কটে বরাক-ব্রহ্মপুত্রের বাংলাভাষীরা। তাঁদের আশঙ্কা, নথির অভাবে সকলকে ভিন্দেশি হিসেবে না চিহ্নিত করা হয়।

উত্তম সাহা ও রাজীবাক্ষ রক্ষিত

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৫

অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী নবীকরণের (এনআরসি) সময় ঘোষণা করা হয়েছে। এ বার এই রাজ্যের বাংলাভাষীদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে। আবেদনকারী নিজে বা তাঁর পূর্বপুরুষ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে ভারতে রয়েছেন, এমন নথি দেখতে চাইবে সরকার। এ নিয়েই ছড়িয়েছে দুশ্চিন্তা। অধিকাংশ মানুষের কাছেই ওই সময়ের কোনও নথি নেই। এত আগের কাগজ জোগাড় করাও সহজ নয়। এতে নতুন সঙ্কটে বরাক-ব্রহ্মপুত্রের বাংলাভাষীরা। তাঁদের আশঙ্কা, নথির অভাবে সকলকে ভিন্দেশি হিসেবে না চিহ্নিত করা হয়।

ওই সব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বরাকের কয়েকটি সংগঠন। শিলচরে নাগরিক সভা করেছে তারা। নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে ১৫টি নথির কোনও একটি দিতে হবে। সংগঠনগুলির দাবি, কোনও ভারতীয় নাগরিক যেন তাঁর নাগরিকত্ব না হারান, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হস্তক্ষেপ দাবি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দেশের কোথাও নাগরিক পঞ্জী তৈরির রেওয়াজ নেই। ব্যতিক্রম অসম। এখানে ১৯৫১ সালে এক বার ওই কাজ শেষ করা হয়। পরে দেশের অন্যত্র জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরির পরিকল্পনা করা হলেও, কাজ শুরু হয়নি। ২০০৩ সালে ফের এই প্রক্রিয়ায় জোর দেওয়া হয়। তখন নতুন নাগরিক পঞ্জী ও ফটো পরিচয়পত্র নিয়ে আইন তৈরি হয়। তার ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সব রাজ্যে বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাগরিকদের নাম তালিকাভুক্ত করা হবে। সারা অসম ছাত্র সংস্থা (আসু) তাতে আপত্তি তোলে। তাদের বক্তব্য ছিল, সবার নাম নথিভুক্ত করা হলে, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরাও নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে। তার জেরে একই আইনে ৪(ক) ধারা সংযোজিত হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জী বা ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকলেই ভারতীয় নাগরিকের স্বীকৃতি মিলবে। দ্বিতীয়ত, অসমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাম তোলা হবে না। শুধু ফর্ম দেওয়া হবে। বাংলাদেশি বলে যাদের সন্দেহ করা হয়, অর্থাৎ বাংলাভাষীদের ফর্মের সঙ্গে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দিতে হবে। অন্যেরা শুধু ফর্ম পূরণ করে নিজেদের তথ্য জানালেই হবে।

দেশভাগের সময় যাঁরা এ দেশে ছিলেন বা সীমান্তের ওপার থেকে এসেছেন তাঁরা সবাই ভারতীয় নাগরিক। বৈবাহিক সূত্রেও নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। জন্মসূত্রেও মেলে দেশের নাগরিকত্ব। কিন্তু অসমের বাংলাভাষীদের ক্ষেত্রে এই সব প্রচলিত আইন কার্যকর নয়। ১৯৭৯ সালে বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে ‘বিদেশি বিতারণ’ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নামও রাজ্যের ভোটার তালিকায় ঢুকে রয়েছে। সে সব নাম বাতিলের দাবিতে ১৯৮৩ সালে লোকসভা নির্বাচন বয়কট করা হয় অসমে। এর পরই অসমের বাংলাভাষীদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কখনও ভোটার তালিকায় তাঁদের নামের পাশে ‘ডি-ভোটার’ (ডাউটফুল ভোটার) তকমা লিখে দেওয়া হচ্ছে। কখনও ১০ বছরের জন্য কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ভোটাধিকার।

এ বার ফের নাগরিক পঞ্জী নবীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। রাজ্য সরকারকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, মার্চের মধ্যে বাড়িতে বাড়িতে ফর্ম পৌঁছে দেওয়া হবে। জুনে উপযুক্ত নথি-সহ তা জমা দিতে হবে। পরবর্তী তিন মাস সেগুলির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে। খসড়া তালিকা প্রকাশের পর নভেম্বর-ডিসেম্বরে তার উপর আবেদন বা অভিযোগের শুনানি হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হলে, জানুয়ারিতে চূড়ান্ত তালিকায় নাম উঠবে। সেটিই হবে ভারতীয় নাগরিকত্বের স্বীকৃতি। যাঁরা নথি দিতে পারবেন না, তাঁদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। সে সব ব্যক্তিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।

বিভিন্ন সংগঠন এই বিষয়টিকে মানবিক ভাবে দেখার অনুরোধ জানিয়েছে। নাগরিক অধিকার রক্ষা সমিতির সাধন পুরকায়স্থ, মুজাম্মেল আলি লস্কর বলেন, “অধিকাংশ ব্যক্তির কাছেই নির্দিষ্ট ১৫টি নথির কিছুই নেই। বন্যা, নদীভাঙন-সহ নানা কারণে অনেকের কাগজ নষ্ট হয়েছে। অনেকে অশিক্ষার জেরে ৪৫ বছর আগের নথি রেখে দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেননি।”

সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ১৫টি নথির মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগের ‘সিটিজেনশিপ’ বা ‘পার্মানেন্ট’ সার্টিফিকেট, রেশন কার্ড, পাসপোর্ট, বিমা পলিসি, ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত কাগজপত্র। সাধারণ মানুষের বক্তব্য, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ওই গুলির কিছুই রেখে দেওয়া হয় না। পুনর্নবীকরণের সময় রেশন কার্ড, পাসপোর্ট জমা দিতে হয়। মেয়াদ পূর্তিতে টাকা তোলার সময় অ্যাকাউন্টের কাগজ জমা রাখাও বাধ্যতামূলক। ’৭১ সালের আগের জন্মের শংসাপত্রেও কাজ হবে বলে সরকার জানিয়েছে। কিন্তু জন্ম-মৃত্যু পঞ্জিকরণ বাধ্যতামূলক করার আইন প্রণীত হয়েছে ১৯৮১ সালে।

নথির তালিকা ঠিক করতে গিয়ে ‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’ লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নাগরিক অধিকার রক্ষা সমিতির কাছাড় জেলা সভাপতি কিরণশঙ্কর দত্তের ব্যাখ্যা, যে কোনও আদালতের রায় দেশের সব জায়গাতেই প্রযোজ্য। অথচ এখানে বলা হচ্ছে, শুধু ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগের আদালতের নথিই গৃহীত হবে। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালগুলি বিভিন্ন মামলায় ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে যে সব রায় দিয়েছে, সে সব এখানে কার্যকর হবে না। এটা প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।

(চলবে)

uttam saha rajibakksha rakshit nrc assam coordination of national registration
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy