Advertisement
২০ মে ২০২৪

বাঁধনার মাঠে আর খিদের হাহাকার নেই

বেড়েছে জীবনীশক্তি। গড় আয়ু ৩০ থেকে বেড়ে ৬৬। গরিব হওয়ার কারণে মাঝপথে স্কুল ছেড়ে ছাগল চরাতে যেতে হয় না, নাবালিকাদের বিয়ের পিঁড়িতে পাঠানো হয় না। শোষণ, অসাম্য আছে। কিন্তু প্রাপ্তিগুলিও কম নয়। কুমার রাণাবেড়েছে জীবনীশক্তি। গড় আয়ু ৩০ থেকে বেড়ে ৬৬। গরিব হওয়ার কারণে মাঝপথে স্কুল ছেড়ে ছাগল চরাতে যেতে হয় না, নাবালিকাদের বিয়ের পিঁড়িতে পাঠানো হয় না। শোষণ, অসাম্য আছে। কিন্তু প্রাপ্তিগুলিও কম নয়। কুমার রাণা

দুর্ভিক্ষ: জয়নুল আবেদিনের ছবি

দুর্ভিক্ষ: জয়নুল আবেদিনের ছবি

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:১১
Share: Save:

অনেক দিন পর বাঁধনার মাঠে ছোটবেলার এক সঙ্গীর সঙ্গে বেশ অনেক ক্ষণ কথা হল। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ, অবরে-সবরে যদিও বা বাড়ি যাই, তেমন থাকা হয়ে ওঠে না। ওরাও জীবিকায় ব্যস্ত থাকে। বাঁধনা বলে সবাই মাঠে। কিছু ক্ষণের জন্য পঞ্চাশ বছর পিছনে ফিরে যাওয়া। জড়িয়ে ধরা। এবং স্মৃতিচারণের পালা।

“তোর মনে আছে, সেই সব দিনের কথা? তুইও তো গরু নিয়ে আসতিস, খুঁটায় বাঁধতে। মনে আছে, তুই আমাকে আলতা এনে দিতিস, আমার গরুটার গায়ে ছোপ ছোপ রং করে দেওয়ার জন্য। মনে আছে, রাত্রে আমাদের বাড়িতে একসঙ্গে খেতাম শুয়োরের মাংসের পিঠে…”, বলতে বলতে হঠাৎ হু-হু করে কেঁদে উঠল সে। “আমার খুব মনে আছে, সেই শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে কাকি (আমার মা) কত দিন আমাকে খাইয়েছে। না হলে হয়তো মরেই যেতাম।… সে কী দিন ছিল রে, খালি খিদে, শুধু ধান কাটার পর কিছু দিন মাত্র হাঁড়িতে ভাত থাকত। মাত্র কয়েক দিন, ফসল যা উঠত তার সবই তো প্রায় নিয়ে যেত মহাজন।… আমাদের কারও ইস্কুলে পড়া হল না। কত জন একসঙ্গে ভর্তি হলাম, তার পর কেউ গরু-বাগাল, কেউ কারও ভাতুয়া। শুধু তোরা তিন জন এখান থেকে ফোর পাস করলি।’’

বাস্তবিক, সেই পঞ্চাশ বছর আগে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম, আমরা প্রায় পঁচিশ জন, কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠতে না উঠতেই সংখ্যাটা কমে দশ মতো, আর চতুর্থ শ্রেণিতে তিন। সেই দলের মাধ্যমিক পাশ করা সৌভাগ্য এক জনেরই হয়েছিল— এই অধমের। ক্ষুধার তীব্রতা বলে বোঝানোর জিনিস নয়, অনুভব করার ব্যাপার। জীবনের পাত্র উপুড় করা দানের মধ্যে ক্ষুধা কী জিনিস তা বোঝার সুযোগও পেয়েছি। বেদ আয়ত্ত হয়েছে, পুত্র শ্বেতকেতুর অহংকার ভাঙার জন্য অরণি তাকে সাত দিন না খেয়ে থাকার আদেশ দিয়েছিলেন। সপ্তাহান্তে তিনি যখন শ্বেতকেতুকে বেদগুলি স্মরণে আনতে বললেন, তত দিনে ক্ষুধা তার বিদ্যা কেড়ে নিয়েছিল। না, সাত দিন লাগে না, একটা গোটা দিন খেতে না পেলে চোখের সামনে পৃথিবী টলমল করতে থাকে, আলো-অন্ধকার প্রভেদ করার ক্ষমতা থাকে না, মৃত্যু যেন মূর্ত হয়ে দেখা দেয়। ওডিয়া সাহিত্যগুরু ফকিরমোহন সেনাপতির বর্ণনায়, “দিনরে আলুয়া নাহি, রাত্তিরে অন্ধার নাহি”।

“না রে, এখন আর অবস্থা তেমন নেই। অনেক বদলে গেছে। সবাই খেতে পায়। আর জানিস, এখন গাঁয়ে এমন কোনও বাচ্চা নেই যে ইস্কুলে যায় না। আমরা খিদের জন্য ইস্কুল যেতে পারিনি। যারা তাও খানিক গেছিল, বেশি এগোতে পারেনি। বড় ইস্কুল ছিল সাত মাইল দূর। গাঁয়ে আট ক্লাস পর্যন্ত পড়বার ইস্কুল হয়েছে। আর ইস্কুলে খাবার ব্যবস্থা হয়েছে। এ যে কত বড় উপকার কী বলব। আমরা পরের গরু চরিয়েছি, নিজের পেট ভরাবার জন্য।... না, এখন বাচ্চাদের নিজেদের খাবার জোগাড় করার জন্য লোকের ঘরে কাজ করতে যেতে হয় না।... আমি মূর্খ লোক, লেখাপড়া কী হচ্ছে জানি না। কিন্তু ইস্কুলে যখন যাচ্ছে, কিছু তো শিখছে। আমরা তো জানতেই পারলাম না ইস্কুল কী জিনিস, ওরা অন্তত আটটা বছর ইস্কুলে যেতে পারছে। কথা বলতে শিখছে।... আর জানিস, সব মেয়েরা ইস্কুল যাচ্ছে। তোর মনে আছে, আমাদের সময় মেয়েরা ইস্কুল যাবে কেউ ভাবতে পারত না।... আরও অনেক বদল হয়েছে। আগে যেমন মহাজন সব নিয়ে যেত, তা আর হচ্ছে না। মজুরি ছিল দেড় কিলো ধান। তার পর সেই যে আমরা আন্দোলন করেছিলাম তিন কিলো ধানের মজুরির জন্য? তার পর জমি দখল, গরিব লোকরা কিছু কিছু জমি পেল, আর সব চেয়ে বড় কথা, আগে যেমন বড়লোকরা যেমন খুশি ব্যবহার করত, সেটা বন্ধ হল। তার পর, এখন রেশন দোকান থেকে দু’টাকা দরে চাল পাওয়া যাচ্ছে। নাই নাই করে হলেও বছরে কয়েক দিন একশো দিনের কাজ পাওয়া যাচ্ছে। লোকে এখন আগের চেয়ে ভাল আছে রে।’’

নিকষ আঁধার রাতে ধামসার আওয়াজ, ঝিঁঝিঁর ডাক, আর স্মৃতির শৈশব। বন্ধুর কথাগুলো বারবার ভেসে আসছে, “লোকে এখন আগের চেয়ে ভাল আছে রে।’’ শুনতে শুনতে কখন যেন ঢুকে পড়েছি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ৬৮ বছরে। ঠিকই, অবস্থাটা তেমন নেই। ঠিক যে সেই দিবারাত্র গুলিয়ে দেওয়া ক্ষুধা নেই। ঠিক যে, গত সাত দশকে ভারত খাদ্য আমদানীকারী দেশ থেকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর দেশে পরিণত, গড় আয়ু হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ থেকে ৬৬। সাক্ষরতার হার ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৪ শতাংশ। প্রজাতন্ত্রে উপনীত হবার আগেও দেশ যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করেছিল, যার জেরে প্রাণ গেছে কোটি কোটি দেশবাসীর, সে দুর্ভিক্ষ অস্তমিত। অবশ্যই আমাদের পূর্বজদের তুলনায় আমরা অনেক ভাল আছি। কিন্তু, তার পরও প্রশ্ন জাগে, দুর্ভিক্ষ দূর হয়েছে ঠিক, কিন্তু এখনও ভারতবর্ষ সবচেয়ে ক্ষুধার্ত দেশগুলোর অন্যতম, এ দেশে অপুষ্টির বীভৎস কায়া, শিশুমৃত্যুর সংখ্যা বিরাট। আরও বিরাট অসাম্যের বিস্তার। আমার বন্ধুকে অনাহারে কাটাতে হত অনেক বেশি, কিন্তু আমাদেরও খানিকটা সইতে হত ক্ষুধার জ্বালা। আমরা প্রায় একই রকম বাড়িতে থাকতাম— মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল। আপেক্ষিক অসাম্যের মাত্রা ছিল কম। কিন্তু, আজ সেই বন্ধুর খাদ্যসুরক্ষা কিছুটা নিশ্চিত, তার সন্ততি স্কুলে যেতে পারে, তবু, ‘আমাদের’ সঙ্গে তার ফারাক বিস্তর— এতটাই যে সে তা কল্পনাও করতে পারে না। “যাই বল বাপ, লড়াই ছাড়া পথ নেই”, সন্ধ্যায় বাঁধনার মাঠে হাঁড়িয়া খেয়ে চুর আমার ছোটবেলার কাকা বলেছিল। “দেখ বাপ, কিছু থাকবে, কিছু বদলাবে। এই যেমন বাঁধনা, সেই কবে থেকে আছে, কিন্তু হ্যাঁ, আগের মতো খিদে নেই... আর বদল চাই। আমাদের যা আছে তা রেখে বদল চাই। বাঁধনা থাকবে, হাঁড়িয়া থাকবে, কিন্তু শোষণ থাকবে না, অত্যাচার থাকবে না, মানুষে মানুষে সম্পত্তির ফারাক থাকবে না।...আমি বলছি বাপ, আরও অনেক বদল হবে। আমি থাকব না, মরে যাব, তোরাও হয়তো থাকবি না, কিন্তু বদল হবে... আমাদের যা আছে তা রেখেই বদল করতে হবে।’’

আজ, প্রজাতন্ত্রের ৬৮ বছরে, যা আছে তাকে রাখাটাই বোধ হয় প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রজাতন্ত্রই যদি না থাকে তা হলে যে বদলটুকু হয়েছে, যতটুকুই হোক না কেন, সেটাই বা থাকে কী করে? বিপন্ন সংবিধান, মুহ্যমান বিচারব্যবস্থা, দিশাহীন রাজনৈতিক দর্শন ও সুবিধাবাদের নির্বস্ত্র উল্লাসের সামনে প্রজাতন্ত্রকে রক্ষার জন্য, “যাই বল বাপ, লড়াই ছাড়া পথ নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE