বুথ আগলাতে না-পারলে ভোটে বিশেষ কিছু করা যায় না। রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য আদি-অনন্ত কাল ধরে চলে আসা এই আপ্তবাক্যের এ বার বাস্তবের মাটিতে পরীক্ষা! ভোটের আগেই প্রাক-নির্বাচন স্তরে। এবং পরীক্ষার নম্বরও উঠে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনের খাতায়। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়ার এ-ওএক বিশেষত্ব।
কী রকম? এসআইআর-এ নির্বাচন কমিশনের তরফে বুথ লেভেল অফিসারদের (বিএলও) পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের বুথ লেভেল এজেন্টদের (বিএলএ) ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রক্রিয়া শুরুর আগে স্বীকৃত সব দলের কাছে বিএলএ-দের তালিকা চেয়ে নেয় কমিশন। ভোটারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষার সময়ে বিএলও-র সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলের ওই প্রতিনিধিরাও থাকবেন, এমনই পরিকল্পনা করে এই ব্যবস্থা। কত বুথে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি কমিশনের লোকের সঙ্গী হতে পারবেন, সেটা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট দলের সাংঠনিক শক্তির উপরে। বিহারে আপাতত বাড়ি বাড়ি যাচাই প্রক্রিয়া শেষ। এর পরে বাংলার পালা এলে সেখানেও শাসক ও বিরোধী সব দলকে এই পরীক্ষায় বসতে হবে!
এসআইআর নিয়ে লোকসভা, বিধানসভা বা রাস্তায় রাজনৈতিক প্রতিবাদ বিস্তর হলেও বিহারে কিন্তু ভোটারের প্রতি বুথ-ভিত্তিক সহায়তা থেকে কোনও দলই সরে আসেনি। বলা যেতে পারে, নিয়মের ফাঁদে রাজনৈতিক দলকে বেঁধে ফেলেছে কমিশন! বিহারে এখনও পর্যন্ত বুথ বা ভোট-কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৭৭ হাজার ৮৯৫। কমিশনের হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে, বিজেপি সর্বাধিক ৫৩ হাজার ৩৩৮ বুথে বিএলএ দিয়েছে। তার পরে আরজেডি ৪৭ হাজার ৫০৬, জেডিইউ ৩৬ হাজার ৫৬০। কংগ্রেসের বিএলএ সংখ্যা ১৭ হাজার ৫৪৯, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের প্রতিনিধি ছিলেন ১৪৯৬ বুথে। যে সব দল একসঙ্গে জোটে আছে (শাসক এনডিএ-তে যেমন বিজেপি, জেডিইউ, হ্যাম ইত্যাদি), তারা রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে বিএলএ দিতে পারে।
জানিয়ে রাখা যেতে পারে, এসআইআর-এর পরে বিহারে যেমন ভোটারের সংখ্যা কমতে পারে, তেমনই আবার বুথের সংখ্যা বেড়ে হবে ৯০ হাজার ৭১২। কোনও বুথে ১২০০-র বেশি ভোটার থাকবে না, এমন ব্যবস্থা দেশের মধ্যে বিহারেই প্রথম চালু করছে কমিশন। বুথের সংখ্যা বেড়ে গেলে প্রকৃত ভোটের দিন রাজনৈতিক দলের এজেন্টের সংখ্যাও বাড়াতে হবে।
বিহারে বুথে বুথে এসআইআর-এর সময়ে ভোটারকে সহযোগিতার কৌশল নিয়েছে বিজেপি। কমিশনের পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন তুললেও একই ভূমিকা নিতে হয়েছে বিরোধীদের। আরজেডি, কংগ্রেস বা বাম, সব দলের নেতৃত্বেরই বক্তব্য, সাধারণ গরিব মানুষ বিপন্ন, আতঙ্কিত হচ্ছেন যখন, সে সময়ে তাঁদের মদত না-করে পালিয়ে যাব কী ভাবে!ঠিক এই একই প্রশ্ন এর পরে উঠতে পারে বাংলায়।
বিশেষ নিবিড় সংশোধনের নামে ভোটার বাদ দেওয়া হলে কমিশনকে তাঁরা ছেড়ে দেবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস তবে কী করবে? বাংলার শাসক শিবির সূত্রে বলা হচ্ছে, এসআইআর নিয়ে আপত্তি থাকলেও প্রশাসনিক ভাবে রাজ্য সরকারের বিশেষ কিছু করণীয় নেই। সরকারকে নিয়ম মেনে কমিশনকে পরিকাঠামোর সাহায্য দিতে হবে। কিন্তু কমিশন যদি শেষ পর্যন্ত বাংলায় বিহারের মতোই সংশোধন প্রক্রিয়ায় হাত দেয়, রাজনৈতিক ভাবে তার বিরোধিতায় অনড় থাকবে তৃণমূল। দলীয় সূত্রে খবর, কোনও ভাবেই ‘নথির নামে’ ভোটারদের নাম কাটতে দেবেন না মমতা।
সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল, ফের সেই ধাঁচেই দলকে পথে নামাতেপারেন তিনি। দলের বিএলএ-দের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়েওশীর্ষ স্তরে আলোচনা চলছে। তবে আগামী সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে কী বলে, সে দিকেই নজর রাখছে রাজ্যের শাসক শিবির। কারণ, প্রান্তিক মানুষের নাম বাদ গেলে ভোটের হিসেবে তা তৃণমূলের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে শাসক দলের।
কমিশনের তরফে বাংলায় বিভিন্ন দলের কাছে ইতিমধ্যেই বিএলএ সংক্রান্ত চিঠি গিয়েছে। বঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘আমরা তৈরি আছি। কিছু মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় আমাদের সমস্যা আছে। বাকি সর্বত্র বুথ স্তরে আমাদের লোকজন তাঁদের ভূমিকা পালন করবেন।’’
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলছেন, ‘‘এসআইআর-এর সময়ে বাংলায় পরিযায়ী এবং সংখ্যালঘুদের বেশি করে নিশানা করা হতে পারে আশঙ্কা করে আমরা ওই সব এলাকায় নজর দিচ্ছি। হেল্প ডেস্ক করছি, আইনজীবীর সহায়তার ব্যবস্থাও রাখছি। আতঙ্কিত মানুষজনকে ছেড়ে আমরাপালাব না!’’
অঙ্গ ঘুরে কমিশনের পরীক্ষার খাতা বঙ্গে ঢুকল বলে!
(শেষ)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)