Advertisement
E-Paper

অস্থিসার সিদ্ধার্থের মূর্তি তেলহারায়

তখন তিনি দিনে একটি করে পাতাই শুধু খেতেন। এক সময় তাও ছেড়ে দিলেন। প্রায় ছ’বছরের সেই প্রচণ্ড তপস্যায় শরীর জীর্ণ হতে থাকে। এক দিন নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান করতে নামার সময় পড়ে যাচ্ছিলেন।

অলখ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৬ ০৪:১৪
তেলহারাতে প্রাপ্ত বুদ্ধের সিল। ছবি অতুল বর্মার সৌজন্যে।

তেলহারাতে প্রাপ্ত বুদ্ধের সিল। ছবি অতুল বর্মার সৌজন্যে।

তখন তিনি দিনে একটি করে পাতাই শুধু খেতেন। এক সময় তাও ছেড়ে দিলেন। প্রায় ছ’বছরের সেই প্রচণ্ড তপস্যায় শরীর জীর্ণ হতে থাকে। এক দিন নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান করতে নামার সময় পড়ে যাচ্ছিলেন। কোনওমতে গাছের ডাল ধরে রক্ষা পান। পরে একটি গাছের নীচে গিয়ে বসেন। তখন সংজ্ঞাও হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেই দিন পরে গোপকন্যা সুজাতা তাঁকে পায়েসান্ন দিয়েছিলেন।

সুস্থ হয়ে সিদ্ধার্থ স্থির করেন, কৃচ্ছ্রসাধনের এই পথ অনার্যোচিত, হীন গ্রাম্য, অনর্থ সংহিত এবং পৃথক জন বা সাধারণ মানুষের সেব্য। বরং মজ্‌ঝিম পতিপদা বা মধ্যম পন্থাই ঠিক।

তপস্যারত সেই অস্থিসার চেহারার সিদ্ধার্থের মূর্তি প্রথম দেখা যায় উত্তর পশ্চিম ভারতের গান্ধার শিল্পে। সেই মূর্তি খোদাই করা পোড়ামাটির সিল আবারও পাওয়া গেল নালন্দার কাছে পাল যুগের তৈলাঢ়ক বা তেলহারার বৌদ্ধ বিহার থেকেও। সেখানে কঙ্কালসার গৌতমের দু’পাশে আরও দু’জনকে দেখা যাচ্ছে। তাঁদের শরীরও তপস্যাক্লিষ্ট। তাঁরা বোধিষত্ত্ব হতে পারেন। আবার গৌতম যে পাঁচ শিষ্যকে নিয়ে তপস্যায় বসেছিলেন, এই দু’জন তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করছেন বলেও মনে করেন ইতিহাসবিদেরা।

পূর্ব ভারতের বৌদ্ধ বিহারগুলিতে সাধারণত বুদ্ধের ভূমিস্পর্শ বা ধ্যানমুদ্রায় থাকা মূর্তিই দেখা যায়। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন মহা অধিকর্তা গৌতম সেনগুপ্তের কথায়, ‘‘গান্ধার শিল্পে এমন বুদ্ধ মূর্তি মেলে। সেখানে অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত আক্ষরিক ভাবে মেনে সেই মতোই বুদ্ধের এমন কৃশোদর, কোটরাগত চক্ষু এবং অস্থিসর্বস্ব মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তা ছাড়া ভারতের অন্যত্র এমন বুদ্ধমূর্তি বিরল।’’ তাঁর কথায়, ‘‘তেলহারা মাগধী বৌদ্ধ সংস্কৃতির পরিমণ্ডলেই পড়ে। সেখানেই এমন মূর্তি পাওয়া তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’

কেন এমন মূর্তি এখানে পাওয়া যাচ্ছে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্বের অধ্যাপক রজত সান্যাল জানান, সম্ভবত এই বিহারে কোনও একটি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গোষ্ঠী উপবাসরত বুদ্ধের উপাসনা করতেন। গৌতমের এই রূপ তপস্যার কঠোরতার বহিঃপ্রকাশ। জ্ঞানের জন্য আকাঙ্ক্ষার তীব্রতারও প্রকাশ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপিকা ঐশ্বর্য বিশ্বাসের বক্তব্য, তাই শরীরকে কষ্ট দিয়ে সাধনার পথ থেকে গৌতম নিজেই সরে এলেও, বৌদ্ধ দর্শনের নানা শাখায় গৌরবের সঙ্গেই তথাগতের জীবনের এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।

বিহার প্রত্নতত্ত্ব দফতরের অধিকর্তা অতুল বর্মা জানান, আদি মধ্য যুগে তেলহারার এই বিহারটি জ্ঞানচর্চার জন্য বিখ্যাতও ছিল। সারা ভারত থেকে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা সেখানে আসতেন। নালন্দা থেকে সেখানে গিয়েছিলেন জ্যান জুয়াং বা হিউয়েন সাংও। বিহারে প্রচুর পুথি ছিল। তেলহারার বিহারটির খোঁজও প্রথমে মিলেছিল নালন্দা থেকেই। নালন্দা মহাবিহারে যে সমস্ত অভিলেখ পাওয়া গিয়েছিল, ১৯৪২ সালে সে সব একত্রিত করে পুরাতত্ত্ববিদ হীরানন্দ শাস্ত্রী একটি রিপোর্ট লিখেছিলেন। সেখানে কিছু বৌদ্ধ বিহারের নামমুদ্রার কথাও হীরানন্দ উল্লেখ করেন। তার একটিতে লেখা ছিল ‘শ্রীপ্রথমশিবপুরমহাবিহারী
কার্যভিক্ষুসঙ্ঘস্য’। এই শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষে তেলহারায় অতুলবাবুর নেতৃত্বে উৎখনন শুরু হলে জানা যায়, এই বিহারটিই হীরানন্দের উল্লেখ করা সেই বিহার। বিহারের নামমুদ্রাটির পাঠোদ্ধার করেছেন রজতবাবু। এই নামমুদ্রাগুলি বিহারের পরিচয়চিহ্ন। কখনও বিহার থেকে কোনও পুথি অন্য কোথাও নিয়ে যেতে হলেও তার উপরে বিহারের নামমুদ্রা আটকে দেওয়া হত। সে ভাবেই এই বিহারটির নামমুদ্রার সিলমোহর মেলে নালন্দায়।

তেলহারার বিহারটিতে এমন একটি বড় বাঁধানো মঞ্চ ছিল, যেখানে এক হাজার জন বসে উপাসনা করতে পারতেন। অতুলবাবু জানান, সারা বিহারে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল ছোট ছোট ঘণ্টা। বাতাস বইলেই সেগুলি বেজে উঠত। ছড়িয়ে পড়ত সুরের তরঙ্গ।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy