টিকিটের হাহাকার আগেও ছিল, এখনও রয়েছে। কিন্তু সেই হাহাকারকে কাজে লাগিয়ে পর্যাপ্ত উড়ান বাড়ানো হয়নি শিলচরে। দেশের বিমান মানচিত্রে এখনও শিলচর উপেক্ষিতই।
এই মূহূর্তে কলকাতা থেকে শিলচরে উড়ান চালাচ্ছে শুধুমাত্র এয়ার ইন্ডিয়া এবং জেট। জেটের সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি দিন তাদের দু’টি করে বিমান কলকাতা-গুয়াহাটি-শিলচর রুটে যাতায়াত করছে। ছোট এটিআর, ৬৮ আসনের বিমান দু’টি শিলচর-কলকাতা রুটে সারা বছরই ভর্তি থাকে। কিন্তু তবুও এই মূহূর্তে বড় বিমান চালানোর পরিকল্পনা নেই তাদের। কেন? স্পষ্ট উত্তর, কলকাতা থেকে উড়ান বাড়ানোর পরিকল্পনাই নেই। কারণ উড়ান বাড়াতে গেলে যে সংখ্যক বিমান হাতে থাকার দরকার, তা তাদের নেই।
এয়ার ইন্ডিয়া সপ্তাহে তিন দিন ছোট এবং চার দিন বড় বিমান চালাচ্ছে কলকাতা-শিলচর রুটে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা-শিলচর রুটে নিয়মিত বড় বোয়িং চালাত এয়ার ইন্ডিয়া। তখনও সব আসন থাকত ভর্তি। এখনও ৪৮ আসনের ছোট এটিআর বিমান ভর্তিই থাকে। ৮০ শতাংশের বেশি যাত্রী যাতায়াত করেন ১৪৫ আসনের বড় এয়ারবাস বিমানে। এই মুহূর্তে শিলচরে উড়ান বাড়ানোর পরিকল্পনা না থাকার পিছনে বিমানের অভাবই কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। জানা গিয়েছে, অনেক আগে থেকেই বিক্রি হয়ে যায় টিকিট। এখন দিল্লি থেকে ৭২ আসনের নতুন এটিআর বিমান আসার অপেক্ষায় রয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া। সেই বিমান এলেও অবশ্য উড়ান-সূচির কোনও অদলবদল হবে না। শুধু বদলে যাবে ছোট বিমানটি। সুবিধা শুধু এটুকু, সপ্তাহে চার দিন ৪৮ জনের বদলে ৭২ জন যাতায়াত করার সুযোগ পাবেন। কেন বাড়ানো হচ্ছে না উড়ান? এয়ার ইন্ডিয়ার এক কর্তার কথায়, “সিদ্ধান্ত দিল্লি নেয়। আসলে এই সব রুট নিয়ে দিল্লির কর্তাদের মাথাব্যথাই নেই।”
তবে, আগ্রহ দেখাচ্ছে ইন্ডিগো। কলকাতাকে ঘাঁটি করে একের পর এক উড়ান বাড়িয়ে চলেছে তারা। যেখানেই চাহিদা রয়েছে, সেখানেই নতুন উড়ান চালু করছে তারা। সংস্থার এক কর্তার কথায়, “উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কয়েকটি রুট ক্রমশ লাভজনক হয়ে উঠছে। আমরা এই মূহূর্তে ডিমাপুর উড়ান চালু করছি। তার পরে হাতে নতুন বিমান এলে শুরু করব শিলচর উড়ান।” জানা গিয়েছে, ইন্ডিগোর সমীক্ষাও বলছে, শিলচর থেকে নিয়মিত যাত্রী মিলবে।
শিলচর থেকে কলকাতা বা গুয়াহাটি যাওয়ার জন্য বিমানই প্রধান ভরসা। সমস্যা টিকিট নিয়ে। দু’তিন দিন আগে টিকিটের খোঁজ করলে জবাব পাওয়া যাচ্ছে, এখন কিনলে চড়া দাম দিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা বা অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। তখনই সমস্যা বেড়ে যায়। ছ’টি আসন তুলে রোগীর শয্যার ব্যবস্থা করতে হয়। একসঙ্গে ছ’-সাতটি টিকিট প্রায় পাওয়াই যায় না।
কাছাড় ক্যানসার হাসপাতালের প্রশাসনিক আধিকারিক কল্যাণ চক্রবর্তীর কথায়, “আমরা টিকিটের খোঁজ করলেই শুনি, হাই রেট। রোগী ছাড়াও আমাদের ডাক্তাররা নিয়মিত সেমিনারে যান, বাইরে থেকেও এখানে আসেন। নার্সদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা লেগেই রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে এক কে সময় ১১ হাজার টাকাতেও টিকিট কিনতে হয়েছে।”
শুধু কলকাতা নয়, শিলচর থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার উড়ানের অবস্থাও তথৈবচ। অভিযোগ, এই মূহূর্তে শিলচর থেকে শুধুমাত্র জেটই গুয়াহাটিতে উড়ান চালানোয়, তাদের একাধিপত্য রয়েছে। তাই তারা ইচ্ছা মতো দাম চাইছে টিকিটের। নবারুন নন্দী, রণজিৎ ভট্টাচার্যের মতো ট্রাভেল এজেন্টদের অভিযোগ, জেটের সর্বনিম্ন দামটাও তুলনায় অনেক চড়া।
শিলচর-গুয়াহাটি রুটে তারা গড়ে ষাট শতাংশ যাত্রী পায়। অভিযোগ, ওই ষাট শতাংশ যাত্রীর কাছ থেকেই তারা পুরো ভাড়াটা তুলে নিতে চায়। অভিযোগ মানতে নারাজ জেট এয়ারওয়েজ-এর শিলচরের স্টেশন ম্যানেজার দেবাশিস বড়ঠাকুর। তিনি বলেন, “বিভিন্ন স্তরের টিকিট রয়েছে। প্রথম স্তরের টিকিট খুব কম দামে তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। পরে তার দাম বেড়ে যায়। সর্বনিম্ন মূল্যের টিকিট মেলে না বলে গ্রাহকরা টিকিট নেই, চড়া দাম ইত্যাদি অভিযোগ আনেন।”
গায়ক দেবজিৎ সাহার বাড়ি বরাকে। তিনি থাকেন মুম্বইয়ে। অনুষ্ঠানের জন্য তাঁকে নিয়মিত মুম্বই, কলকাতা, দিল্লি, গুয়াহাটি যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু শিলচর থেকে গুয়াহাটি ও কলকাতার উড়ান সংখ্যা এত কম ও ভাড়া এতটাই বেশি যে বিরক্ত দেবজিৎ। তিনি বলেন, “আজ অবধি শিলচর বিমানবন্দরে রাতে বিমান নামে না। আগরতলায় নাইট ল্যান্ডিং রয়েছে। ফলে সেখানে উড়ান অনেক বেশি। এয়ার-ইন্ডিয়া ও জেটের তিনটি উড়ানই ভরসা। বিকেলের পরে বিমান অবতরণের কোনও নিশ্চয়তা নেই। শিলচর থেকে সোজা মুম্বই বা দিল্লি যাওয়ার উপায়ও নেই।”
জানা গিয়েছে, উত্তর-পূর্ব ভারতে বিমান যোগাযোগ বাড়াতে আগ্রহী কেন্দ্র। তাই ‘রিজিওনাল অ্যান্ড রিমোট এরিয়া এয়ার কানেকটিভিটি’ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু আপাতত তা স্থগিত রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি সংসদে আলোচনাও হয়েছে। অসমের সাংসদ গৌরব গগৈ ও মেঘালয়ের সাংসদ ভিনসেন্ট পালা এ নিয়ে সংসদে প্রশ্নও তোলেন। বিমান প্রতিমন্ত্রী মহেশ শর্মা জানান, উত্তর-পূর্বের বহু স্থানে উড়ানের ব্যবস্থা নেই। সড়ক পথেও এলাকাগুলি প্রায় বিচ্ছিন্ন। সেখানকার মানুষের কথা ভেবেই উড়ান পরিষেবা সংক্রান্ত এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। তার জন্য কিছু শর্তও আরোপ করা হয়েছিল বিমানসংস্থাগুলির উপরে। কিন্তু সেই সব শর্ত নিয়ে আপত্তি রয়েছে বিমানসংস্থাগুলির। তাদের আবেদনে ফের নতুন করে নির্দেশিকা তৈরি করা হচ্ছে। তবে শিলচরে এই মূহূর্তে বেশি উড়ান নামার ক্ষেত্রে অন্য একটি সমস্যাও রয়েছে। রাতে অবতরণের পরিষেবা না থাকায় এখানে সমস্ত বিমানের ওঠানামা দিনের আলোতেই করতে হবে। অথচ প্রায় এক দশক আগে শিলচরে নৈশ অবতরণের সমস্ত সরঞ্জাম কিনে প্রতিস্থাপন করে বিমান মন্ত্রক। কিন্তু বিমানবাহিনী শিলচরে নৈশ বিমান চলাচলে আপত্তি জানানোয় তা এখনও কার্যকর হয়নি।
শিলচর-সহ উত্তর-পূর্বে বিমান পরিবহণ-সহ যোগাযোগের বিষয়টি তদারক করে উত্তর-পূর্ব পরিষদ। সেখানকার পরিবহণ ও যোগাযোগ বিভাগের উপদেষ্টা পি কে এইচ সিংহ-র যুক্তি অবশ্য ভিন্ন। তাঁর কথায়, “শিলচরে নাইট ল্যান্ডিং-এর সুবিধা রয়েছে। কিন্তু বিমান সংস্থাগুলির তরফে কখনওই সেই সুবিধা চাওয়া হয় না। শিলচর-সহ উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন বড় শহর থেকে বিমানবন্দর এতটাই দূরে যে সন্ধ্যার পরে যাত্রীদের বিমানবন্দর থেকে বাড়ি যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবহণ ও নিরাপত্তার সমস্যা রয়েছে।” সেই ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকেই।
তথ্য সহায়তা: রাজীবাক্ষ রক্ষিত, উত্তম সাহা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy