Advertisement
E-Paper

আনন্দধারা বহিছে ভুবনে

এই গোটা মে মাসটাতেই ঘুরেফিরে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে। সে প্রসঙ্গেই একটা পুরনো বিখ্যাত ঘটনার কথা বলা যাক। সেটা আশির দশকের প্রথম দিক। কলকাতা শহর তখন খুবই বিখ্যাত তার লোড শেডিংয়ের জন্য, ঘটনাটা সে সময়েরই। বিদেশে ছিলেন বেশ কিছু পঞ্চাশের কবি। তাঁরা সবাই প্রায় একইসঙ্গে দেশে ফিরলেন। সেই উপলক্ষে বন্ধুদের সমাবর্তনের জন্য নবনীতা দেবসেনের বাড়িতে একটি আড্ডার আয়োজন হয়।

রূপক চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share
Save

এই গোটা মে মাসটাতেই ঘুরেফিরে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে। সে প্রসঙ্গেই একটা পুরনো বিখ্যাত ঘটনার কথা বলা যাক। সেটা আশির দশকের প্রথম দিক। কলকাতা শহর তখন খুবই বিখ্যাত তার লোড শেডিংয়ের জন্য, ঘটনাটা সে সময়েরই। বিদেশে ছিলেন বেশ কিছু পঞ্চাশের কবি। তাঁরা সবাই প্রায় একইসঙ্গে দেশে ফিরলেন। সেই উপলক্ষে বন্ধুদের সমাবর্তনের জন্য নবনীতা দেবসেনের বাড়িতে একটি আড্ডার আয়োজন হয়। কিন্তু তারই মধ্যে অকস্মাৎ লোড শেডিং! এর পর? এর পরের কথা আমরা জানতে পারি শঙ্খ ঘোষের লেখা থেকে। তিনি জানাচ্ছেন—আবছা অন্ধকারে বসে আছে কৃত্তিবাসের কালাপাহাড়ি কবির দল। যাঁরা বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে কিছু পান না। কেউ বলেন রবীন্দ্রনাথ? পড়ে দেখব কখনও। সেই তাঁরাই এলোমেলো কিছু কথার পর যখন আর কিছু নেই, তখন গলায় তুলে নিলেন গান। কার গান? সেই রবীন্দ্রনাথেরই গান। কোন গান? ওই ‘আসনতলে মাটির পরে লুটিয়ে রব’। শঙ্খ ঘোষের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, সেই মুহূর্তে ঘরের আগলটা যেন চলে গিয়েছিল। আর বাইরের ধুলোভরা একটা প্রান্তর যেন উপস্থিত হয়েছিল সেই সন্ধ্যায় সুনীল-শক্তি-অলোকরঞ্জন-তারাপদ-উৎপলদের ঘিরে। কিন্তু কথাটা অন্যত্র। তা হল: কথা শেষের রেশে যখন গান আসে, তখন তাঁকে আশ্রয় করেই। শেষ নয়। সেই রবীন্দ্রনাথের গানেই আশ্রয় নিতে হয় এবং উচ্চারণ করতে হয়—‘তোমার চরণধূলায় ধূলায় ধূসর হব’।

পঞ্চাশের সেই ডাকসাইটে কবিরা, যাঁরা আজ কিংবদন্তি—তাঁরা তো আশ্রয় নিয়েছিলেনই, কিন্তু আজও তো আমরা তাঁর গানের আশ্রয়েই আছি। আর গানগুলো মনে পড়লে অবধারিত ভাবে গানের কথাগুলো ভেতরে ভেতরে গাঁথা হয়ে যায়। অল্প বয়সের রবীন্দ্রনাথের গান শুনে এক তরুণী জানিয়েছিলেন: কবির গান শুনলে তিনি মরণলোক ছেড়ে উঠে আসতে পারেন। কেন যেন মনে হয়, এখানে গান মানে তো শুধু গান নয়, তার বাণীও একটা প্রধান অংশ। যে কথাগুলো আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। শঙ্খবাবু আমাদের জানিয়েছেন: ভালেরি একবার বলেছিলেন, আলোয়-ধোওয়া রাত্রি আর তার তারার পুঞ্জ পাল্টে দেয় আমাদের সব কিছু, আমরা এক আশ্চর্য সরলতায় ভরে যাই। রবীন্দ্রনাথের গানও যেন সেই রকমই মস্ত এক প্রাকৃতিক নিশীথিনী। যার মুখোমুখি হলে সব বস্তুর ভার হালকা হয়ে যায়। সরে যায় সব মিথ্যে, সাজিয়ে বলা কথার সংসার। কিন্তু তার মধ্যেও যেন প্রকোষ্ঠ আছে, ঘরের ভাগ আছে। সে ভাগ সুর আর কথা। কখনও গানের কথা সুরের থেকে দূরে নিয়ে যায়, আবার সুর তার সমস্ত কূলপ্লাবিনী রহস্য নিয়ে কথাকে সরিয়ে নিজের জায়গা করে নেয়। কিন্তু পঁচিশে বৈশাখের পরে আজ বারবার মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের গানের কথাগুলো। এমন কিছু কিছু কথা—যা ভাবতে ভাবতে আবারও অন্য একটি কথা এসে যাচ্ছে, যা আরেকটির পরিপূরক। যেমন আমরা লক্ষ করলে দেখব, ১৩১৭-য় লেখা ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা’, তার পর ১৩২৯-এ লেখা ‘ওগো দখিন হাওয়া’, আবার ১৩২৯-এই লেখা ‘দখিন হাওয়া জাগো জাগো’। যদিও তিনটি গানের কথার মধ্যে সময়ের ফাঁক রয়েছে, কিন্তু কোথাও যেন কথার দিক দিয়ে একটা মিল পাওয়া যায়। তেমনই পূজা পর্যায়ের গান ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’র এক জায়গায় লিখছেন—‘আমার এ ঘর বহু যতন করে/ধুতে হবে, মুছতে হবে মোরে’। আবার সেই পূজা পর্যায়েরই গান ‘প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে’। সেখানে একদম শেষে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন—‘যতন করে আপনাকে যে/ রেখেছিলেম ধুয়ে মেজে/ আনন্দে সে ধুলায় লুটেছে’। দুটো গান রচনা করার মধ্যে একটা সময়ের দূরত্ব রয়েছে, এ কথা সবাই জানেন। কিন্তু আমার ঘর বহু যত্ন করে ধুয়ে মুছে রাখতে হবে-র সঙ্গে যত্ন করে আপনাকে ধুয়ে মেজে রাখার কোথাও যেন একটা সাযুজ্য রয়েছে। একবার তিনি বলছেন—ধুতে হবে মুছতে হবে। আর একবার বলছেন—ধুয়ে মেজে।

আমাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হবে না। আমরা তাঁর কাছ থেকেই জেনে নিতে পারব না, তিনি ঠিক কী ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁর গাণের বাণী থেকে এটুকু পড়ে নিতে পারি যে—‘আমার এ ঘর বহু যতন করে’। এখানে ঘর মানে কি নিজেকেই মনে করাচ্ছেন! নিজেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতে বলছেন তাঁর জন্য! তিনি হলেন ‘সে’। এই সে-র মুগ্ধতা বারবার দেখা গিয়েছে তাঁর রচনায়। এ প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র। আমরা শুধু বোঝার চেষ্টা করছিলাম, সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ের দুটি গানের মধ্যে কোথাও যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এ কথাই আমরা বলছিলাম—একটা গানের কথা মাথায় রাখতে রাখতে আবার অন্য একটি গান স্মৃতিতে এসে জুড়ে বসে। কিন্তু তা সম্পূর্ণ বিষয়-বিবেচনা নয়। তাদের মধ্যে আত্মীয়তাও আছে। হয়তো একেবারেই এর উল্টো কথা বলেছেন। কিন্তু কোথাও যেন সেই ‘আমার এ ঘর’-এর একটা আভাস পাই অন্য গানের বাণীতে। তা হল, ‘এই দুয়ার দেওয়া ঘরে/ শুধু আঁধার নাহি সরে/ তবু আছ তারি ’পরে/ ও মোর দরদিয়া/ সেথা আসন হয়নি পাতা/ সেথা মালা হয়নি গাঁথা/ আমার লজ্জাতে হেঁট মাথা’। এখানেও যেন সেই ঘরের কথা আবারও ফিরে আসে। যে ঘরে নিজেই ধুয়ে মুছে রাখতে চেয়েছিলেন যাকে—যতন করে আপনাকে যে\রেখেছিলেন ধুয়ে মেজে। সেই ঘরই যেন পরিষ্কার না করে রাখার কারণে কবির খেদের শেষ নেই। কেননা তাঁর যে ‘দরদিয়া’, তাঁকে কোনও মালিন্যর মধ্যে তিনি রাখতে চান না, রাখতে চাইছেন না। এ যেন এক নতুন কবিতার লাইন মনে করিয়ে দেয়—‘কে যেন বাসন মাজে সারা রাত/ শরীরের ভেতরে কি ঘাট?/ শরীরের ভেতরেই ঘাট।’ যা যা আছে জগতে, সব কিছুর জন্য যেন নিজেকে প্রস্তুত করে রাখতে হবে—এমনটাই বারবার দেখিয়েছেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কথা নিয়ে আলোচনা করতে করতে, কথা নিয়ে ‘কথা’ বলতে বলতে খেয়াল করতে হয়—কখন যেন মন চলে যায় সুরের দিকে। যার জন্য তিনি বলেন—‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে/ আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।’ তার মানে বাণীর চেয়েও প্রধান হিসেবে তিনি দেখেছিলেন সুরকে। যার জন্য তিনি বলেছিলেন—‘গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি’। অথবা যখন কামনা করেন—‘গান আমার যায় ভেসে যায়/ চাস নে ফিরে, দে তারে বিদায়।’ এখানে এসে বোঝা যায় শুধু মাত্র বাণী নয়, গানের সুরকেও এক অসম্ভব প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। শঙ্খ ঘোষ আমাদের জানাচ্ছেন, যে-অমল অপেক্ষায় ছিল রাজার চিঠি পাবে বলে, সেই অমল যদি বয়সে আরও খানিকটা বড় হত, তবে সেও বলত—‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে।’ আর এই গান অর্থাৎ বাণী আর সুরের মিলিত রূপ যে প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী করেছেন, তার কথাও বলেছেন। জানিয়েছেন—‘কেন তোমরা আমায় ডাকো/ আমার মন না মানে/ পাই নে সময় গানে গানে।’ এ গানেরই শেষে আবার বলছেন, ‘আজ যে কুসুম ফোটার বেলা/ আকাশে আজ রঙের মেলা/ সকল দিকেই আমায় টানে গানে গানে।’ অর্থাৎ এ জগতের যত তুচ্ছাতিতুচ্ছ অথবা যত মহৎ—সবটাই তাঁর গানের মধ্য দিয়ে দেখে নেওয়া জীবন। যে জীবনের জন্য তিনি প্রতি মুহূর্তে তৈরি রয়েছেন। খুব কাছাকাছি যখন তিনি দুটি গান রচনা করেছেন—‘দাঁড়াও মন অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড মাঝে’ আর ‘নদীপারের এই আষাঢ়ের প্রভাতখানি/ নে রে ও মন, নে রে আপন প্রাণে টানি।’ এই যে ধরার শ্যামলিমায় নদীতল ছেয়ে বিপুল মহিমাময় ব্রহ্মাণ্ড, যেখানে তিনি বিরাজ করছেন—পুরোটাই গানের মধ্য দিয়ে বিরাজ করছেন। এই পুরো ব্রহ্মাণ্ডই তাঁর যে রাজেশ্বর। সেই যে রাজা, যে অমলকে চিঠি পাঠাবে কখনও, তার জন্যও রবীন্দ্রনাথ লিখছেন—‘আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান/ প্রিয় তোমার জগৎ-সভায় এইটুকু মোর স্থান।’ শুধু তা-ই নয়, যে ‘মরণরে’ কিশোর বয়সে তিনি ‘শ্যামসমান’ দেখেছিলেন, সেই মৃত্যুলোক উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তিনি আশ্রয় নিচ্ছেন গানের। বলছেন—‘তোমার কাছে এ বর মাগি/ মরণ হতে যেন জাগি/ গানের সুরে।’ গান দিয়েই উদ্ভাসিত হতে চেয়েছিলেন প্রতিদিনের, চিরদিনের মৃত্যুতীর্থ থেকে। আর আমাদের এই প্রলাপ-লিখন স্থির ছিল গানের বাণী নিয়ে কথা বলার। কখন যে সে সুরের দিকে গেল, আবার কখন বাণীতে ফিরে এল—তা ঠিক রাখা গেল না।

এখানেই সত্য। এইখানেই তিনি চিরকালের রবীন্দ্রনাথ।

Rupak Chakrabarty Rabindranath Tagore rabindra sangeet Nabaneeta Dev Sen Shankha Ghosh

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}