Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

খাপলাং বেঁচে যাওয়ায় পাল্টা হানার আশঙ্কা

বয়স অন্তত ৭৫। চোখে ভারী কাচের চশমা। এক ঝলক দেখলে মনে হবে ন্যুব্জ, অশক্ত এক বৃদ্ধ। কিন্তু গত দু’দশক ধরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে সব চেয়ে নাজেহাল করে রেখেছেন যে নাগা জঙ্গি নেতা— তিনি এই এস এস খাপলাং। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, এই বৃদ্ধ জঙ্গি নেতাকে নিকেশ করার লক্ষ্যেই মায়ানমারের অনুমতি নিয়ে দু’দিন আগে তাদের ভূখণ্ডে সেনা অভিযান চালিয়েছে ভারতীয় কম্যান্ডোরা। ওনজায় এই অভিযানে ৩৮ জন জঙ্গি মারা গেলেও খাপলাং অক্ষতই থেকে গিয়েছেন। উল্টে আজ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা জারি করে জানানো হয়েছে, ক্যাডারদের মনোবল বাড়াতে চলতি সপ্তাহেই বড় হামলা চালাতে পারে এনএসসিএন-এর খাপলাং গোষ্ঠী।

এস এস খাপলাং

এস এস খাপলাং

অনমিত্র সেনগুপ্ত
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

বয়স অন্তত ৭৫। চোখে ভারী কাচের চশমা। এক ঝলক দেখলে মনে হবে ন্যুব্জ, অশক্ত এক বৃদ্ধ। কিন্তু গত দু’দশক ধরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে সব চেয়ে নাজেহাল করে রেখেছেন যে নাগা জঙ্গি নেতা— তিনি এই এস এস খাপলাং।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, এই বৃদ্ধ জঙ্গি নেতাকে নিকেশ করার লক্ষ্যেই মায়ানমারের অনুমতি নিয়ে দু’দিন আগে তাদের ভূখণ্ডে সেনা অভিযান চালিয়েছে ভারতীয় কম্যান্ডোরা। ওনজায় এই অভিযানে ৩৮ জন জঙ্গি মারা গেলেও খাপলাং অক্ষতই থেকে গিয়েছেন। উল্টে আজ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা জারি করে জানানো হয়েছে, ক্যাডারদের মনোবল বাড়াতে চলতি সপ্তাহেই বড় হামলা চালাতে পারে এনএসসিএন-এর খাপলাং গোষ্ঠী। চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছে উত্তর-পূর্বের সব রাজ্যে। কারণ গোয়েন্দাদের খবর— সম্প্রতি আলফা, পিএলএ ও বড়ো জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এই এনএসসিএন (খাপলাং)। ৪ঠা জুন মণিপুরের চান্ডেলে সেনা কনভয়ে খাপলাং গোষ্ঠী যে হামলায় ১৮ জনকে হত্যা করেছে, তাতে অন্য গোষ্ঠীগুলির জঙ্গিরাও অংশ নিয়েছেল।

কিন্তু খাপলাং কি সত্যিই ভারতের সীমান্ত লাগোয়া মায়ানমারের এই এলাকায় ছিলেন? ফেব্রুয়ারি মাসে মায়ানমার প্রশাসন বার্ধক্যজনিত অসুখে কাবু খাপলাংকে ইয়াঙ্গনে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। ভারতকে জানিয়েই মায়ানমার সরকার জন্মসূত্রে তাদের দেশের নাগরিক খাপলাংকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে গিয়েছিল। সে সময়ে খাপলাং গোষ্ঠীর সঙ্গে কেন্দ্রের কিন্তু গোয়েন্দাদের দাবি, চিকিৎসার পর এই জঙ্গি নেতা আবার ফিরে এসেছেন চান্ডেলে সীমান্তের জঙ্গি ঘাঁটিতে। অভিযানের দিন খাপলাং চান্ডেলে তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে থাকবেন বলে নির্দিষ্ট খবর ছিল গোয়েন্দাদের কাছে। তাঁরা মনে করছেন, খাপলাংয়ের অনুপস্থিতিতে তাঁর অনুগামী জঙ্গিরা এত সক্রিয় হতে পারত না। উত্তর-পূর্বের অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে সমন্বয়ের কাজও খাপলাংয়ের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি ওনজাতেই ছিলেন।

কেন্দ্র মনে করছে, এ যাত্রায় খাপলাংকে নিকেশ করে ফেলতে পারলে অনেকটাই কোমর ভেঙে ফেলা যেত উত্তর-পূর্বের জঙ্গিদের। সেই মতো প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছিল। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ভারতীয় বাহিনী হামলা শুরু করতেই পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে যান পোড় খাওয়া ওই নেতা। পাল্টা আক্রমণের পথে না-হেঁটে নিজস্ব রক্ষীদের ঘেরাটোপে চুপি চুপি পালিয়ে যান। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের খবর অনুযায়ী, সে দিন ৩৮ জন জঙ্গি মারা গেলেও জনা দশেক পালিয়ে যান। তার মধ্যে খাপলাংও রয়েছেন। মায়ানমার-চিন সীমান্তের দিকেই
তিনি পালিয়ে গিয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

হেমি নাগা গোষ্ঠীভুক্ত খাপলাংয়ের জন্ম ভারত সীমান্তের কাছে মায়ানমারের পাংসাউ-এ। দশ ভাইবোনের মধ্যে সব থেকে ছোট এই খাপলাং ভারত ও মায়ানমারের নাগা অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পৃথক নাগালিম রাষ্ট্রের দাবিতে সরব রয়েছেন গত কয়েক দশক ধরে। ষাটের দশকে হাতে অস্ত্র তুলে নেন তিনি। ১৯৬৪ সালে তিনি গড়ে তোলেন নাগা ডিফেন্স ফোর্স। সে সময়ে তাঁর দায়িত্ব ছিল নাগা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের জন্য চিনে পাঠানো। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আরও দুই জঙ্গি নেতা আইজ্যাক আর মুইভার। তিন জনে গড়ে তোলেন ন্যাশনালিস্ট সোস্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড (এনএসসিএন)।

শুধু নাগাল্যান্ডে নয়, ক্রমশ মণিপুর ও অরুণাচলপ্রদেশেও সমান্তরাল প্রশাসন চালাতে শুরু করে এনএসসিএন। সখ্য গড়ে ওঠে আলফার সঙ্গেও। কিন্তু রাজীব গাঁধীর আমলে প্রথম এই তিন নেতার জোটকে ভাঙতে সফল হয় কেন্দ্র। অস্ত্রবিরতির প্রশ্নে আইজ্যাক আর মুইভার সঙ্গে মতপার্থক্য হওয়ায় দল ছেড়ে এসএসসিএন (খাপলাং) গড়ে তোলে তিনি। মুইভাকে হত্যার জন্য হামলাও চালায় খাপলাংয়ের অনুগামীরা। তবে মুইভা বেঁচে যান। আইজ্যাক আর মুইভার অনুগামী জঙ্গিরা অস্ত্র ছাড়লেও জঙ্গি কার্যকলাপ জারি রাখে খাপলাং গোষ্ঠী। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত খাপলাং গোষ্ঠীর হাতে ৬২ জন নাগরিক ও ২৬ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মারা যান। কিন্তু পাল্টা হামলায় প্রায় আড়াইশো জঙ্গি নিহত হওয়ায় বাধ্য হয়ে ২০০১ সালে কেন্দ্রের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে খাপলাং গোষ্ঠী। কিন্তু তার পর থেকে কেন্দ্রের সঙ্গে আইজ্যাক-মুইভা গোষ্ঠীর প্রায় আশিটি বৈঠক হলেও পৃথক নাগা রাষ্ট্রের দাবি না-ছাড়ায় দিল্লি ডাকেনি খাপলাং-কে।

উত্তর-পূর্বে ক্রমশ আইজ্যাক-মুইভার অনুগামীদের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় চলতি এপ্রিলে শান্তি চুক্তি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় খাপলাং। গত দেড়-দু’বছর ধরেই উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন খাপলাং। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলছে, শান্তিচুক্তি ভেঙে যাওয়ায় খাপলাং-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব ওয়েস্টার্ন সাউথ-ইস্ট এশিয়া (ইউএনএলএফডাবলু)।।

কেন্দ্র মনে করছে, নতুন ওই জোটকে শুরুতেই বিনাশ করতে খাপলাং-কে নিকেশ করাটা দরকার ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আশঙ্কা, খাপলাং বেঁচে যাওয়ায় জঙ্গিরা এখন অস্তিত্ব প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE