Advertisement
E-Paper

অর্থাভাবে স্কুল হারানোর আশঙ্কায় ছাত্ররা

উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির টাকা জোগাড়ের চিন্তায় রাতের ঘুম উড়েছে ওদের। পড়াশোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা ঘিরেছে অরূপ দাস, সুমনা বিশ্বাস, পাপ্পু দাস, নাজিরা বেগম লস্কর, দিয়া পাল, পূজা বৈষ্ণবদের।

উত্তম সাহা

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০৩:১৩

উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির টাকা জোগাড়ের চিন্তায় রাতের ঘুম উড়েছে ওদের। পড়াশোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা ঘিরেছে অরূপ দাস, সুমনা বিশ্বাস, পাপ্পু দাস, নাজিরা বেগম লস্কর, দিয়া পাল, পূজা বৈষ্ণবদের।

মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে ভর্তি ফর্ম তুলেছে দিয়া। অরূপ ফর্ম এনেছে নরসিং উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফর্ম দাখিলের টাকা মিলবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটেনি। দু-তিন দিনের মধ্যে আড়াই-তিন হাজার টাকা সংগ্রহ করার কথা ভাবতেই পারছে না বাকিরা। তাই ফর্ম তুলতেই যায়নি বাকিরা।

এমনই দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে মাধ্যমিকে সফল দরিদ্র পরিবারের ওি পড়ুয়াদের।

পরিজনদের কয়েক জন তো নাজিরাদের বলেই দিয়েছেন— আগেও তো টাকার অভাবে পড়াশোনা ছেড়েই দিয়েছিলে। কোনও ভাবে মাধ্যমিক তো পাশ করলে। আর না পড়লে দুঃখ কীসের!

মন থেকে সে কথা মানতে নারাজ নাজিরা, অরূপ, দিয়ারা। তাদের কথায়, ‘‘ছোটবেলায় স্কুলে না যেতে পারায় আক্ষেপ ছিল না। সংসারের খরচ তুলতে কাজ করে দিন কাটছিল। কিন্তু সর্বশিক্ষা অভিযানে সামিল হয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার সুযোগে পড়াশোনার খিদেটা যে বেড়ে গিয়েছে।’’ পরিচারিকার কাজ করত দিয়া, নাজিরা, পূজা। বাজারের ব্যবসায়ীদের জল এনে রোজগার করত অরূপ। কিন্তু পড়াশোনার দগতে এক বার পা রাখার পর সেখান থেকে সরে আসতে চাইছে না কেউই।

দেড় দশকের তাদের জীবন আক্ষরিক অর্থেই একটা যুদ্ধ।

পাপ্পুর বাবা ঠেলাগাড়ি টানতেন। আচমকা মারা যান। এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে কী করবেন— তা ভেবে নাজেহাল ছিলেন পাপ্পুর মা। একটা দোকানে সামান্য মজুরিতে কাজে ঢুকলেন। ঠিকমতো খাবারও জুটত না। একরত্তি ছেলেমেয়ে দু’টিকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যান তার মাসী-মেসো। তাঁদেরও দারিদ্রের সংসার। শেষ পর্যন্ত সর্বশিক্ষা প্রকল্পের জ্যোতিকেন্দ্র দায়িত্ব নেওয়ায় পড়াশোনা শুরু হয় পাপ্পুদের। অযাচক আশ্রমের স্থানীয় কর্তারা ওই পুপুনকি আশ্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাপ্পুর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। সেখান থেকেই এ বার মাধ্যমিক পাশ করে সে।

দিয়াদের বাড়ি জিরিঘাটে। বাবা ক্ষেতমজুর হলেও দুই মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল। বড় মেয়েকে শখ করে ইংরেজি মাধ্যম নার্সারি স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। আচমকা মৃত্যু এসে তাদের সব সুখ কেড়ে নেয়। আচমকা মারা যান দিয়ার মা। পত্নীবিয়োগে বাবার মাথায় গোলমাল শুরু হয়। কাজে যান না, কারও সঙ্গে কথা বলেন না। পিসি দুই বোনকে শিলচরের বাড়িতে নিয়ে যান। তাঁদেরও নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। দিয়া বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ শুরু করে। জ্যোতিকেন্দ্র তাকে পেয়ে এক বছর নিজেদের তত্ত্বাবধানে রাখে। পরে সিস্টার নিবেদিতা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। নাজিরার গল্পটাও অনেকটা একই। সুমনার বাবা নিকুঞ্জ বিশ্বাস দিনমজুর। মা শিখাদেবী পরিচারিকা। বাবার নিয়মিত কাজ জুটত না। তাই অঙ্গনওয়াড়ির পরে সুমনা আর স্কুল চত্বরে যেতে পারেনি। জ্যোতিকেন্দ্র তাকে স্কুলে ভর্তি করায়।

আড়াই বছর বয়সে পিতৃহীন হয় পূজা। মা, দিদি পরিচারিকার কাজ শুরু করে। একটু বড় হয়ে সে-ও একই কাজে ঢোকে। তারও সহায় হয় জ্যোতিকেন্দ্র। স্কুলে ভর্তির পরও কম লড়তে হয়নি তাকে। পড়াশোনার জন্য সময় বের করতে গিয়ে কাজে যেতে দেরি হওয়ায় ভর্ৎসনা সহ্য করতে হতো প্রায়ই। মাধ্যমিক দেওয়ার সময় ছুটি চাওয়ায় কাজই চলে যায়। এখন সে স্থানীয় এক সংস্থায় মদের বোতলে লেবেল সাঁটে। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারলেও, কাজ আর পড়াশোনা কী করে মেলাবে— তা নিয়েও চিন্তা রয়েছে বছর সতেরোর পূজার।

অরূপের কাহিনি আরও করুণ। ৮ বছর বয়সে বাবাকে হারায় সে। এক বোন, দুই ভাই। মা বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করে সামান্য টাকা রোজগার করেন। ছোটবেলাতেই সে কাজ খুঁজতে শুরু করে। ফাটকবাজারে মাছ-সবজির ব্যবসায়ীদের জন্য জল বয়ে উপার্জন শুরু। কাগজের ঠোঙাও বানায় কয়েক দিন। জ্যোতিকেন্দ্রের পরামর্শে পড়তে শুরু করলে সমস্যা বেড়ে যায়। কাজের সময় স্কুলে থাকতে হয়। ঠোঙা তৈরিরও সময় মেলে না। পরে এক জন নদীর তীর থেকে বস্তায় ভরে মাটি দিতে বলেন। দেখা যায়, অনেকেই মাটি নিতে আগ্রহী। এই কাজে সময়েরও সমস্যা নেই। ঘুম থেকে উঠে কয়েক বস্তা মাটি তুলে ঠিক জায়গায় পৌঁছে স্কুলে যেত অরূপ। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই অবশ্য নতুন পেশায় জড়িয়েছে সে। এখন সকালে বেরিয়ে পড়ে সংবাদপত্র বিলি করতে।

সর্বশিক্ষা মিশনের শিলচর আরবান কো-অর্ডিনেটর গৌতম দাস জানান, শহরে এখন তাঁদের ৩৫টি জ্যোতিকেন্দ্র রয়েছে। ছাত্রসংখ্যা ৪৭১। শিশুশ্রমিক বা স্কুলে যেতে পারে না যে সব ছেলেমেয়ে, তাদের খুঁজে বের করে পড়ার ব্যবস্থা করেন তাঁরা। এক-দেড় বছর নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখে পরে যে যতটা বুঝতে পারে, সেই হিসেবে বিভিন্ন ক্লাসে ভর্তি করানো হয়। তবে সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েই তাঁদের দায়িত্ব শেষ হয় না। খাতা-কলম সহ অন্য সামগ্রী সরবরাহ, পড়ার ব্যাপারে তদারকি চলতেই থাকে। এ বার দিয়া-নাজিরাদের মতো ৬২ জন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। পাশ করেছে ৩২ জন। সকলের জন্য কোচিং ক্লাসে নেওয়া হতো জ্যোতিকেন্দ্রগুলিতে।

কিন্তু যে ৩২ জন পাশ করেছে, তাদের এখন কী হবে। গৌতমবাবু জানান, উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির জন্য আড়াই-তিন হাজার টাকা করে লাগে। এই টাকা সরকারি তরফে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবু পড়াশোনা চালিয়ে যেতে যারা আগ্রহী, তাদের জন্য তিনি তদ্বির করছেন। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে বলেছি। দেখা যাক, কতটা সাড়া মেলে। পরে অধ্যক্ষদের সঙ্গে দেখা করব, ওদের ভর্তির জন্য ছাড় চাইব।’’

সেই সাড়ার আশাতেই এখন দিন কাটছে পাপ্পু-সুমনাদের।

financial problem Uttam Saha Silchar Sumana Biswas student higher secondary
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy