E-Paper

নীতীশ-গ্রামে শুধু ডিমের টানে আজ স্কুল

দিব্যাংশুর সঙ্গে দেখা নালন্দা জেলার কল্যাণ বিগহা গ্রামে। এই গ্রামেই গত বিশ বছর ধরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের পৈতৃক ভিটে।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:৪১
বিহারের মুখ্যমনত্রী নীতীশ  কুমার।

বিহারের মুখ্যমনত্রী নীতীশ কুমার। ফাইল চিত্র।

‘কল্যাণ বিগহা কে লাল, আপনে কর দিয়া কমাল’!

নীল রঙের বোর্ডে হিন্দিতে লেখা কথাগুলো পড়ে শোনায় অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া দিব্যাংশু। এ বার উচ্চ-প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোবে। তবে উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে আর ভর্তি হবে কি না, ঠিক নেই। স্কুলে ঠিক মতো ক্লাস হয়? শিক্ষকরা পড়ান ঠিক মতো? দিব্যাংশুর উত্তর, “নাহ্। কেউ রোজ স্কুলে যায় না। শুধু শুক্রবার সবাই স্কুলে যায়।” কেন? দিব্যাংশু হেসে ফেলে, “শুক্রবার মিড-ডে মিলে ডিম খাওয়ায়। বাকি দিন তোভাত-ডাল-সব্জি!’’

দিব্যাংশুর সঙ্গে দেখা নালন্দা জেলার কল্যাণ বিগহা গ্রামে। এই গ্রামেই গত বিশ বছর ধরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের পৈতৃক ভিটে। হলদে রঙা দোতলা বাড়ির সদর দরজায় তালা। এ বাড়িতে এখন কেউ থাকেন না। নীতীশ গ্রামের বাড়িতে আসেন বছরে তিন বার। বাবা, মা ও স্ত্রী-র মৃত্যুবার্ষিকীতে। বাড়িতে কোনও নামফলক নেই। তবে বাড়ির সামনেই পুকুরের বাঁধানো পাড়ের সামনে পাঁচ বছর আগে বসানো নীল রঙের বোর্ডে বড় করে লেখা—'১৫ সাল বেমিসাল’। সে বার ১৫ বছর গদিতে কাটিয়ে বিহারে সবথেকে বেশি সময় মুখ্যমন্ত্রী থাকার রেকর্ড করেছিলেন নীতীশ। গ্রামের ছেলে ‘মুন্না’-র জন্য গর্বিত হয়েছিল কল্যাণ বিগহা।

আরও পাঁচ বছর পার হয়ে গিয়েছে। নীতীশ পটনার গদিতে বিশ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন। বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে আরজেডির তেজস্বী যাদব রোজ প্রশ্ন তুলছেন—নীতীশ কি মানসিক ভাবে সুস্থ ? এনডিএ ফের সরকারে এলে নীতীশকে বিজেপি কি আর মুখ্যমন্ত্রী হতে দেবে?

নীতীশের বাড়ির সামনে শান বাঁধানো বটতলার আড্ডায় এ সব প্রশ্ন তুললে গ্রামের মানুষ ক্ষেপে ওঠেন। গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা অবধিয়া কুর্মি সম্প্রদায়ভুক্ত। নীতীশ নিজেও এই অনগ্রসর শ্রেণির সন্তান। সেই কুর্মি সম্প্রদায়ের চন্দ্রকান্ত কুমারের প্রশ্ন, “নীতীশবাবুর জন্ম তো একান্ন সালে। মোটে চুয়াত্তর বছর বয়স। নরেন্দ্র মোদী পঁচাত্তর পার করে দেশ চালাতে পারলে নীতীশবাবু চুয়াত্তরে বিহার চালাতে পারবেন না?”

কল্যাণ বিগহা হরনৌত বিধানসভা কেন্দ্রের অধীন। এই হরনৌত থেকেই নীতীশ পঁচাশি সালে প্রথম বিধায়ক হয়েছিলেন। এখন আর নীতীশ ভোটে লড়েন না। বিধান পরিষদে নির্বাচিত হয়েই মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আসছেন। কল্যাণ বিগহার ব্রাহ্মণ, অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত কুর্মি, অতি অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত কাহার বা নাই সম্প্রদায় থেকে দলিত পাসোয়ানদের দাবি, নীতীশ ভোটে না লড়লেও তাঁরা সবাই জেডিইউ-কে তির চিহ্নে ভোট দেবেন।

শুধু কল্যাণ বিগহা নয়। গোটা নালন্দা জেলা চায়, নীতীশ মুখ্যমন্ত্রী থাকুন। কারণ, গত বিশ বছরে জেলার ভোল পাল্টেছে। জাতীয় সড়ক থেকে গ্রাম পর্যন্ত মসৃণ পাকা রাস্তা। দু’ধারে সাজানো গাছের সারি। গ্রামের ভিতরে কংক্রিটের রাস্তা। প্রায় ২৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ। এটিএম-সহ স্টেট ব্যাঙ্কের শাখা খুলেছে। তৈরি হয়েছে আইটিআই। সবথেকে আশ্চর্য—গ্রামে শ্যুটিং রেঞ্জ তৈরি হয়েছে। জেডিইউ নেতারা বলছেন, নালন্দার গ্রামের মেয়েরা এখন বিহারের শ্রেয়সী সিংহের মতো শ্যুটার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতে ফেরা শ্রেয়সী এখন বিহারের বিধায়ক।

প্রদীপের আলো থাকে। প্রদীপের নীচে অন্ধকারও। নীতীশের কল্যাণে কল্যাণ বিগহার ইন্টার স্কুল বা হাই স্কুলের ভোল পাল্টেছে ঠিকই। কিন্তু ডিম খাওয়ার টান না থাকলে কেউ স্কুলে যায় না। এক ঝলকে বোঝা যায়, কেন স্কুলে ভর্তির হার বা মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার মতো শিক্ষার মাপকাঠিতে বিহার গোটা দেশের মধ্যে পিছনের সারিতে পড়ে থাকে। ‘মুখ্যমন্ত্রীর গ্রাম’ বলে কল্যাণ বিগহায় দোতলা সরকারি হাসপাতাল তৈরি হয় বটে। তবে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধপত্র বিশেষ মেলে না। আয়ুর্বেদিক ওষুধ নিয়মিত মেলে।

কাকতালীয় বটে! নীতীশের বাবা রামলখন সিংহ ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। পৈতৃক ভিটের সামনেই নীতীশ ‘কবিরাজ রামলখন সিংহ স্মৃতি উদ্যান’ তৈরি করিয়েছেন। বাবা ও মায়ের মূর্তি স্থাপন করেছেন। ভোটের বাজারে মুখ্যমন্ত্রীর পৈতৃক ভিটে, স্মৃতি উদ্যানের সামনে ভিড় জমে। ভিড় দেখে টোটো চালক ধোরি পাসোয়ান মুচকি হেসে বলেন, “দরকার হলে নীতীশবাবু আবার জোট বদলাবেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন।’’

স্কুল পালানো দিব্যাংশু নীল রঙের বোর্ডে লেখা শেষের লাইনগুলো পড়ে শোনায়, ‘আপ হি নীতীশ কুমার, আপ কি সরকার, আপ সে সরকার’।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Nitish Kumar Bihar Assembly Election 2025 Bihar

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy