নিষেধাজ্ঞা চাপার পরেই বইগুলোর খোঁজ যেন হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে কাশ্মীরে। খুঁজছেন সাধারণ মানুষ, যাঁদের অনেকেই তরুণ প্রজন্মের। ২৫টি বই। ‘ভ্রান্ত ভাষ্য’ আর ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ছড়ানোর অভিযোগে যে বইগুলি বাজার থেকে তুলে নেওয়ার এবং সেগুলির সমস্ত ছাপা কপি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন জম্মু-কাশ্মীরের উপরাজ্যপাল মনোজ সিন্হা।
নিষিদ্ধ-তালিকার কয়েকটা বই এ রকম— বুকারজয়ী অরুন্ধতী রায়ের ‘আজ়াদি: ফ্রিডম, ফাসিজ়ম, ফিকশন’, সুমন্ত্র বসুর ‘কন্টেস্টেড ল্যান্ডস’ এবং ‘কাশ্মীর অ্যাট দ্য ক্রসরোডস: ইনসাইড আ টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি কনফ্লিক্ট’, এ জি নুরানির ‘দ্য কাশ্মীর ডিসপিউট ১৯৪৭-২০১২’, ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ভিক্টোরিয়া স্কোফিল্ডের ‘কাশ্মীর ইন কনফ্লিক্ট— ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড দ্য আনএন্ডিং ওয়ার’। সাংবাদিক অনুরাধা ভাসিনের ‘আ ডিসম্যান্টল্ড স্টেট: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব কাশ্মীর আফটার ৩৭০’, পিয়োতর বলসেরোউইকজ় এবং অ্যাগনিজ়কা কুসজ়েউস্কার ‘ল অ্যান্ড কনফ্লিক্ট রেজ়োলিউশন ইন কাশ্মীর’ বই দু’টির উপরেও চেপেছে নিষেধাজ্ঞা। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ষষ্ঠ বার্ষিকীতে, গত ৫ অগস্ট এই নিষেধাজ্ঞার বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করেছে উপরাজ্যপালের নিয়ন্ত্রণাধীন জম্মু-কাশ্মীরের স্বরাষ্ট্র দফতর। তাদের বক্তব্য, নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা-তথ্যের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত। ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক ভাষ্যের আড়ালে সুসংহত ভাবে ভুল তথ্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদী লেখাপত্র ছড়ানো হচ্ছে বলে তদন্তে ইঙ্গিত মিলেছে।
লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মীদের একাংশের মতে, কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাস বা বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে মুক্ত চিন্তা ও আলোচনার পরিসরকে ব্যাহত করতে পারে এই সিদ্ধান্ত। বইগুলি নিষিদ্ধ করার তীব্র সমালোচনা করেছেন হুরিয়ত নেতা মিরওয়াইজ় উমর ফারুক থেকে শুরু করে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলকে সমর্থন করা সাংবাদিক-সমাজকর্মী আরতি টিকু সিংহ। মিরওয়াইজ় এক্স হ্যান্ডলে লেখেন, ‘বই নিষিদ্ধ করলেই ঐতিহাসিক তথ্য আর কাশ্মীরিদের স্মৃতি মুছে যায় না। বরং এই ধরনের স্বৈরাচারী পদক্ষেপের আড়ালে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা এবং বোধের সীমাবদ্ধতাই ফুটে ওঠে।’ গত ২ তারিখ থেকে শ্রীনগরে ‘চিনার বই উৎসব’ শুরু হয়েছে। চলবে ১০ অগস্ট পর্যন্ত। মিরওয়াইজ়ের কটাক্ষ, সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রমাণে যাঁরা ওই উৎসব করছেন, তাঁরাই বই নিষিদ্ধ করে আখেরে পরস্পরবিরোধী আচরণ করছেন।
নিষিদ্ধ হওয়া বইগুলির একটির লেখিকা অনুরাধা ভাসিন মনে করেন, এই নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হল মানুষের মনে ভয় ঢোকানো। ভবিষ্যতে যে কোনও ধরনের বই কেনার সময়েই তাঁদের সতর্ক থাকতে বাধ্য করা। জন্মসূত্রে কাশ্মিরী পণ্ডিত আরতি টিকু সিংহ একযোগে উপরাজ্যপাল মনোজ সিন্হা, জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা এবং নরেন্দ্র মোদী সরকারের সমালোচনা করেছেন।
এক্স হ্যান্ডলে আরতি লিখছেন, ‘১৯৪৭ সাল-পরবর্তী কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে অন্যতম সেরা কাজ ডেভিড দেবদাসের ‘দ্য স্টোরি অব কাশ্মীর’। সেই বইও নিষিদ্ধ-তালিকায় রয়েছে। ভারত সরকার কী করে বই নিষিদ্ধ করতে পারে? আমি হয়তো এই তালিকার অধিকাংশ বইয়ের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। কিন্তু সাহিত্য নিষিদ্ধ করাকে কখনওই সমর্থন করি না। কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী, ধর্মীয় কট্টরপন্থী আর জেহাদি মৌলবাদীদের তীব্র বিরোধিতা আমি নির্ভয়ে করে এসেছি। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্বাসে নিষেধাজ্ঞা চাপানোকে সমর্থনকরি না।’
শ্রীনগরের বই বিক্রেতারা উৎসাহী পাঠকদের জানিয়ে দিচ্ছেন, নিষিদ্ধ-তালিকায় পড়া বইগুলি আনিয়ে দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও আরতি মনে করেন, ইন্টারনেট ও বিনামূল্যের ই-বইয়ের যুগে কোনও বই বা সাহিত্যকে নিষিদ্ধ করাটাই বোকামি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)