ওয়াকফ মামলায় মঙ্গলবার দীর্ঘক্ষণ শুনানি চলল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিআর গবইয়ের এজলাসে। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে চলা শুনানিতে মামলাকারী পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শুনল প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিভিন্ন অংশ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মামলাকারীদের আইনজীবী কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি-সহ অন্য আইনজীবীরা। ওয়াকফ কাউন্সিলে সিংহভাগই কেন অমুসলিম সদস্য রাখা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। ওয়াকফ সম্পত্তি দানের ক্ষেত্রে কেন পাঁচ বছর ইসলাম ধর্ম পালনের শর্ত রাখা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন মামলাকারী পক্ষের।
সিব্বলের বক্তব্য, ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষা করার জন্যই আইন। তবে নতুন আইনটি তৈরি হয়েছে ওয়াকফের সম্পত্তি দখল করার জন্য। প্রধান বিচারপতির এজলাসে তিনি জানান, দেশের সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্র কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ দিতে পারে না। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ দিতে পারে না রাষ্ট্র। ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি দিয়েই কবরস্থান তৈরি করতে হয়। তাই অনেকেই জীবনের শেষ অধ্যায়ে নিজেদের সম্পত্তি ওয়াকফকে দান করেন। সিব্বলের কথা শুনে প্রধান বিচারপতি গবই বলেন, “এমন তো মন্দিরেও হয়। আমি দরগায় যাই, সেখানেও এমন হয়।”
ওয়াকফ সংক্রান্ত পুরনো আইন এবং নতুন আইনে কী ফারাক রয়েছে, তা-ও আদালতে বোঝানোর চেষ্টা করেন সিব্বল। তাঁর দাবি, আগে কোনও প্রাচীন সৌধকে সংরক্ষিত করা হলেও সেটির পরিচয় বদল করা হয়নি। অর্থাৎ, যে সম্পত্তিটি ওয়াকফ বলে চিহ্নিত ছিল, সেটিকে তেমনই রাখা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। তবে প্রধান বিচারপতি সে ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে খাজুরাহোর প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। খাজুরাহো মন্দির একটি প্রাচীন সৌধ হিসাবে সংরক্ষিত হলেও সেখানে যে এখনও লোকে প্রার্থনা করতে যায়, তা স্মরণ করিয়ে দেন গবই। সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন, সে ক্ষেত্রে ওই আইন কী ভাবে প্রার্থনার অধিকার কেড়ে নিতে পারে? যদিও আইনজীবীর বক্তব্য, নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফের হাতে থাকা সৌধগুলিকে আর ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য করা হবে না। সে ক্ষেত্রে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য না হলে সেখানে প্রার্থনা করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
ওয়াকফ কাউন্সিলে কেন অমুসলিম সদস্যদের সংখ্যা বেশি রাখা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন সিব্বলের। তাঁর দাবি, এই আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সিব্বলের দাবি, নতুন আইন অনুসারে কাউন্সিলে মুসলিম সদস্য থাকবেন ১০ জন এবং অমুসলিম সদস্য থাকবেন ১২ জন। আগে সকলেই মুসলিম ছিলেন। এই নিয়ে প্রশ্ন উঠলে শুনানির একটি পর্যায়ে বুদ্ধগয়ার প্রসঙ্গ তোলেন প্রধান বিচারপতি। সিব্বলকে তাঁর প্রশ্ন, “বুদ্ধগয়া নিয়ে কী বলবেন? সেখানে তো সকলে হিন্দু।” তখন সিব্বল বলেন, “কারণ, সেটি হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয়েরই উপাসনাস্থল। বুদ্ধগয়া আইনেও এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। আমি জানতাম আপনি এই প্রশ্ন করবেন।”
ওয়াকফকে সম্পত্তি দানের ক্ষেত্রে কেন পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালনের শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সিব্বল। তিনি বলেন, “যদি কেউ মৃত্যুশয্যায় শায়িত থাকেন এবং ওয়াকফকে সম্পত্তি দান করতে চান, তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি মুসলিম ধর্ম পালন করছেন! এটি তো অসাংবিধানিক।” এই নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মামলাকারী পক্ষের অপর আইনজীবী হাফেজ় আহমেদিও। তাঁরও প্রশ্ন, কেউ পাঁচ বছর ইসলাম ধর্ম পালন করছেন কি না, তা যাচাই করার মাপকাঠি কোথায় উল্লিখিত রয়েছে?
নতুন ওয়াকফ আইনের ৩ডি এবং ৩ই ধারায় যেগুলি উল্লেখ রয়েছে, সেটি প্রকৃত বিলে উল্লেখ ছিল না বলেও দাবি সিব্বলের। তাঁর বক্তব্য, যৌথ সংসদীয় কমিটিতেও এগুলি নিয়ে আলোচনা হয়নি। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিচারপতিরা প্রশ্ন তোলায় সিব্বল জানান, নিশ্চয়ই ভোটাভুটির ঠিক আগে এই ধারাগুলি যুক্ত করা হয়েছিল। আইনের ৩ডি ধারা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আহমেদিও। তাঁরও বক্তব্য, “৩ডি ধারার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। বহু পুরনো মসজিদে এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” আইনের এই ধারার উপর সম্পূর্ণ স্থগিতাদেশের আর্জি জানান তিনি।
সম্প্রতি বিভিন্ন মহলে দাবি করা হয়েছে, ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তথ্য কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। তাঁর বক্তব্য, ২০১৩ সাল থেকে ওয়াকফগুলি একটি পোর্টালে নিবন্ধীকরণ শুরু হয়েছিল। পোর্টালের তালিকায় সেই বৃদ্ধিকে ওয়াকফের পরিমাণ বৃদ্ধি বলে কেন্দ্র দেখাতে চাইছে বলে দাবি সিঙ্ঘভির। যৌথ সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “২৮টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ৫টি রাজ্যে সমীক্ষা হয়েছে। ৯.৩ শতাংশ সমীক্ষা হয়েছে।” মঙ্গলবার দীর্ঘ শুনানির পর আগের নির্দেশই বহাল রয়েছে। বুধবার ফের মামলার শুনানি হবে।