Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Scindia Clan

রাজমাতা থামিয়ে দিয়েছিলেন ইন্দিরা ঝড়, দেউটি নিভিয়ে দিলেন মহারাজা

স্বাধীনতার সময়ে এ দেশে সর্বোচ্চ মর্যাদার ‘রাজঘরানা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল হাতে গোনা যে ক’টা পরিবার, সিন্ধিয়ারা তাদের অন্যতম।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২০ ১৮:৪০
Share: Save:

একটা বড়সড় ঝড়কে ১৯৭১ সালে থামিয়ে দিয়েছিল এই পরিবার। দেশজোড়া প্রবল ইন্দিরা হাওয়া সে বার পথ হারিয়ে ফেলেছিল সিন্ধিয়া দুর্গে ঢুকে। প্রায় ৫০ বছর পরে আবার সেই পরিবারের হাতেই খুব বড় ধাক্কা খেতে হচ্ছে প্রয়াত ইন্দিরা গাঁধীর রেখে যাওয়া দলটাকে। মধ্যপ্রদেশে এমনিতেই নড়বড়ে ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে ছিল কংগ্রেসের দুর্গ। গ্বালিয়রের জয়বিলাস মহল বিদ্রোহ ঘোষণা করতেই কমল নাথের নেতৃত্বাধীন সেই দেউটি নিভে যাওয়ার পথে।

মঙ্গলবার সকালে অমিত শাহের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে গিয়েছিলেন গ্বালিয়রের ‘মহারাজা’ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। মোদীর সঙ্গে বৈঠক সেরে বেরনোর কিছু ক্ষণের মধ্যে কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার চিঠি তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর কাছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই সিন্ধিয়া পরিবারের সঙ্গে দলের দীর্ঘ সম্পর্কের শেষ সুতোটাও ছিঁড়ে গিয়েছে। স্বাধীনতার সময়ে এ দেশে সর্বোচ্চ মর্যাদার ‘রাজঘরানা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল হাতে গোনা যে ক’টা পরিবার, সিন্ধিয়ারা তাদের অন্যতম। স্বাধীন ভারতের রাজনীতিতে তাদের উত্থান কিন্তু কংগ্রেস বিরোধী শিবির থেকে হয়নি, বরং কংগ্রেসের হাত ধরেই হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন ভারতে অলিখিত ভাবে ‘রাজনৈতিক রাজঘরানা’র উষ্ণীস বহন করছিল যে পরিবার, সেই গাঁধীদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে গোটা সিন্ধিয়া ঘরানা মিশে গেল বিজেপিতে।

মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে রাহুল-প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর সঙ্গে জ্যোতিরাদিত্য। ফাইল চিত্র।

‘মহারাজা’ বা ‘মহারানি’ সম্বোধন এখনও রয়েছে। কিন্তু রাজত্ব আর নেই। ‘মহারানি’ হিসেবে রাজত্ব চালানোর দিন বিজয়ারাজে সিন্ধিয়ার পরে আর কেউ দেখেননি জয়বিলাস মহলে। সেই অর্থে গ্বালিয়রের শেষ মহারানি বিজয়ারাজেই। কিন্তু স্বাধীন ভারতেও তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকেননি। ১৯৫৭ সালে গুণা লোকসভা আসন থেকে কংগ্রেসের টিকিটে লড়েন। জিতে সংসদে যান। ১৯৬২-তে ফের কংগ্রেসের টিকিটে লোকসভায় যান গ্বালিয়র থেকে। কিন্তু লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যু এবং প্রধানমন্ত্রিত্বে তথা কংগ্রেসের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় ইন্দিরা গাঁধীর উত্থানের পরে বিজয়ারাজে সিন্ধিয়াকে আর দেখা যায়নি কংগ্রেসে। দীর্ঘ দিনের সুসম্পর্কের সূত্র ছিঁড়ে যায়। ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্বতন্ত্র পার্টির হয়ে গুণা থেকে জেতেন বিজয়ারাজে। তার কিছু দিনের মধ্যেই জনসঙ্ঘে যোগ দেন। জাতীয় রাজনীতি ছেড়ে মধ্যপ্রদেশের রাজনীতিতে ডুব দেন আরও বেশি করে।

আরও পড়ুন: পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ? সিন্ধিয়া দিয়ে শুরু, এর পর কি আরও অনেকে

আরও পড়ুন: নিঃশব্দে অভিযান, অমিতের চালেই বিজেপিতে জ্যোতিরাদিত্য!

১৯৭১ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেশ জুড়ে ইন্দিরা ঝড় চলছে। সে ঝড় মধ্যপ্রদেশেও প্রবল। কিন্তু সিন্ধিয়াদের গড় গ্বালিয়র অঞ্চলে থেমে গিয়েছিল ইন্দিরার অশ্বমেধের ঘোড়া। রাজমাতা বিজয়ারাজে নিজের লোকসভা আসন গুণা ছেড়ে দিয়েছিলেন ছেলে তথা তরুণ ‘মহারাজা’ মাধবরাও সিন্ধিয়াকে। সিন্ধিয়া সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র গ্বালিয়র আসনটা ছেড়ে দিয়েছিলেন জনসঙ্ঘের তৎকালীন শীর্ষনেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীকে। আর নিজে দাঁড়িয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী আসন ভিণ্ড থেকে। তিন আসনেই ভারতীয় জনসঙ্ঘের জয়ধ্বজা উড়েছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, জনসঙ্ঘের নয়, আসলে রাজমাতার জয়ধ্বজা উড়েছিল।

সিন্ধিয়া পরিবারের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক তখনই পুরোপুরি অতীত হয়ে গিয়েছিল, এমন কিন্তু নয়। ১৯৭৭ নাগাদ মাধবরাওয়ের সঙ্গে জনসঙ্ঘের সম্পর্কে ভাঙন ধরে গিয়েছিল। গুনা থেকে মাধবরাও নির্দল হয়ে জিতেছিলেন। তার পরে কংগ্রেসের সঙ্গে দীর্ঘ পথ চলা তাঁর। ১৯৮০— বছর তিনেক আগে ধুয়েমুছে যাওয়া ইন্দিরার পুনরুজ্জীবনের ভোট। ইন্দিরা কংগ্রেসের টিকিটে ফের গুনা থেকে জিতেছিলেন মাধবরাও। তার পর থেকে ২০০২ সালে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু পর্যন্ত কংগ্রেসেই ছিলেন মহারাজা মাধবরাও। ১৯৮৪ সালে গ্বালিয়রে অটলবিহারী বাজপেয়ীকে হারিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাক বা না থাক, কোনও বার গুনা, কোনও বার গ্বালিয়র থেকে জিতে টানা লোকসভায় থেকেছিলেন।

মাধবরাওয়ের মৃত্যুর পরে রাজ্যাভিষেক হয় তাঁর ছেলে জ্যোতিরাদিত্যের। নতুন মহারাজাকেই প্রয়াত মহারাজার আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী করে কংগ্রেস। বিপুল ব্যবধানে জিতে জ্যোতিরাদিত্য লোকসভায় পৌঁছন। ইউপিএ জমানায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হন। কিন্তু গত বছর দুয়েক ধরে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল যাচ্ছিল না জ্যোতিরাদিত্যের। গাঁধী পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল একমাত্র কংগ্রেসি সিন্ধিয়ার। আর গেরুয়া শিবিরে থাকা অন্য সিন্ধিয়ারা ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠছিলেন মহারাজাকে নিজেদের দলে টানার।

বসুন্ধরা রাজের সঙ্গে জ্যোতিরাদিত্য। ফাইল চিত্র।

২০০১ সালে রাজমাতা বিজয়ারাজে মারা যান। কিন্তু তাঁর দুই মেয়ে বসুন্ধরা রাজে এবং যশোধরা রাজে তত দিনে বিজেপিতে বড় জায়গা করে নিয়েছেন। বসুন্ধরা রাজস্থানের রাজনীতির সামনের সারিতে এবং মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অপেক্ষায়। আর যশোধরা রয়েছেন মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায়, যিনি পরে সাংসদ হবেন, তারও পরে আবার রাজ্যে ফিরে মন্ত্রী হবেন।

রাজনীতিতে যতই উল্টো মেরুতে থাকুন, পিসি বসুন্ধরা-যশোধরার সঙ্গে ভাইপো জ্যোতিরাদিত্যের সম্পর্ক কিন্তু মধুরই ছিল। তাই ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজস্থানে বসুন্ধরার নেতৃত্বাধীন বিজেপি হারার পরেও দারুণ একটা ছবি তৈরি হয়েছিল নতুন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌতের শপথ মঞ্চে। নয়া মন্ত্রিসভার শপথে আমন্ত্রিত ছিলেন সদ্যপ্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা। আর এক ধাক্কায় তিন রাজ্যে কংগ্রেসের জয়ের আনন্দে তখন রাহুল গাঁধীর সঙ্গে রাজ্যে রাজ্যে ছুটছেন জ্যোতিরাদিত্য। গহলৌতের শপথে যোগ দিতে গিয়ে মঞ্চে দেখা হয়েছিল পিসি বসুন্ধরার সঙ্গে। ভাইপোকে দেখে পরম স্নেহে বুকে টেনে নেন পিসি। পারিবারিক সম্পর্কে যে রাজনীতি ছায়া ফেলেনি, গোটা ভারত তা সে দিন দেখেছিল। মধ্যপ্রদেশের রাজনীতিতে থাকা আর এক পিসি যশোধরার সঙ্গে জ্যোতিরাদিত্যের নিরন্তর যোগাযোগ ছিল। সম্প্রতি বিজেপি এবং জ্যোতিরাদিত্যের মধ্যে সেই যশোধরাই অন্যতম সেতু হয়ে উঠেছিলেন বলেই খবর।

অতএব কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্যপদে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ইস্তফা দিতেই জয়বিলাস মহল যেন উল্লাসে ঐক্যবদ্ধ। রাজমাতা বিজয়ারাজে আর নেই। রাজনীতি এবং সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদে রাজমাতার উল্টো মেরুতে চলে গিয়েছিলেন যিনি, সেই মহারাজা মাধবরাও-ও প্রয়াত। রয়েছেন রাজমাতার অন্য উত্তরসূরিরা। রয়েছেন মাধবরাওয়ের পরবর্তী প্রজন্ম। রাজনৈতিক ভাবে সবাই আজ ফের এক পঙ্‌ক্তিতে। প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়ে এসে রাজনৈতিক ভাবে আবার ঐক্যবদ্ধ সিন্ধিয়া পরিবার।

জ্যোতিরাদিত্যের ধাক্কায় কিন্তু টালমাটাল হয়ে পড়েছে মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস। কমল নাথের সরকার যে পড়বে, তা প্রায় নিশ্চিত। জ্যোতিরাদিত্যকে সমর্থন জানিয়ে বিধায়করা যে ভাবে দল ছাড়তে শুরু করেছেন, তাতে দলছুটদের সংখ্যা কোথায় গিয়ে থামবে, সে হিসেব কষা প্রায় থামিয়েই দিয়েছে হতোদ্যম কংগ্রেস। এই পরিস্থিতি কিন্তু কংগ্রেস এড়াতেই পারত। ২০১৮-র বিধানসভা নির্বাচনের আগেই টানাপড়েনটা শুরু হয়েছিল কংগ্রেসে। কমল নাথ কংগ্রেসের মুখ হবেন, না কি সিন্ধিয়া, তা নিয়েই টানাপড়েন শুরু হয়েছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেসের আর এক স্তম্ভ দিগ্বিজয় সিংহ বরং পিছনের সারিতে ছিলেন। কমল নাথকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি করে এবং সিন্ধিয়াকে প্রচার কমিটির চেয়ারম্যান করে পরিস্থিতি সামলেছিলেন রাহুল। ভোটের পরে মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা হবে বলে জানিয়েছিলেন। দীর্ঘ দিন পরে মোটের উপরে ঐক্যবদ্ধ হতে পারা কংগ্রেস সে ভোটে জিতেও যায়। ভোটের পর কমল নাথই মুখ্যমন্ত্রী হন। প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিত্ব এ বার সিন্ধিয়াকে দিতে হবে বলে শর্ত রাখা হয় মহারাজার শিবির থেকে। সে শর্ত মেনে নেওয়ার অলিখিত আশ্বাস শুধু কথার কথা ছিল, নাকি সমস্যা সাময়িক ভাবে ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা ছিল, তা নয়াদিল্লির ১০ জনপথের বাসিন্দারাই ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও কমল নাথ যে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিত্ব জ্যোতিরাদিত্যকে ছাড়েননি, তা বাস্তব।

সাম্প্রতিকতম সমস্যাটা শুরু হয়েছিল রাজ্যসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে। মধ্যপ্রদেশের যে ৩টি আসনে নির্বাচন হবে, তার মধ্যে ১টি আসনে কংগ্রেসের এবং ১টিতে বিজেপির জয় নিশ্চিত ছিল। অন্য ১টি আসনেও কংগ্রেসের পাল্লাই ভারী ছিল, কিন্তু নিশ্চিত ছিল না। জ্যোতিরাদিত্য চাইছিলেন নিশ্চিত আসনটি থেকে প্রার্থী হতে। কমল নাথ রাজি ছিলেন না বলে গুঞ্জন। রাহুল গাঁধীর ‘কিচেন ক্যাবিনেটের’ সদস্য মনে করা হত যাঁকে, সেই জ্যোতিরাদিত্যের এ হেন সঙ্কটে ১০ জনপথ হস্তক্ষেপ করবে বলে সম্ভবত আশা ছিল গ্বালিয়রের মহারাজার। কিন্তু নয়াদিল্লি সূত্রের খবর, ১০ জনপথের তরফ থেকেও কোনও উষ্ণতা টের পাননি মাধবরাও-পুত্র।

অতএব উষ্ণতা বাড়ল পরিবারের অন্দরে। যশোধরা রাজে আবেগঘন টুইটে লিখলেন, ‘‘রাষ্ট্রহিতের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিল রাজমাতার রক্ত, একসঙ্গে চলব, নতুন দেশ গড়ব, সব ব্যবধান মিটে গেল। কংগ্রেস ছাড়ার যে সাহসী পদক্ষেপ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া করলেন, আমি অন্তর থেকে তাকে স্বাগত জানাচ্ছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE