Advertisement
E-Paper

একবিংশ শতাব্দী থেকে এক অদেখা প্রস্তর যুগের পথে সভ্যতা?

শিউরে উঠেছিলাম দিনকয়েক আগে। চেন্নাইয়ের একটি রেলওয়ে স্টেশনের রক্তাপ্লুত প্ল্যাটফর্মে নিথর পড়ে থাকা তরুণী তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীর দেহ শিহরণ খেলিয়ে দিয়েছিল গোটা দেশের স্নায়ুতন্ত্রে।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ০১:১৪

শিউরে উঠেছিলাম দিনকয়েক আগে। চেন্নাইয়ের একটি রেলওয়ে স্টেশনের রক্তাপ্লুত প্ল্যাটফর্মে নিথর পড়ে থাকা তরুণী তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীর দেহ শিহরণ খেলিয়ে দিয়েছিল গোটা দেশের স্নায়ুতন্ত্রে।

আবার শিউরে উঠলাম ওই ঘটনাটার জন্যই! এ বার মৃতার বাবার আর্তস্বর শুনে!

অসহায়, নিষ্ফলা এক আফসোস আর্তচিৎকার হয়ে ছিটকে এসেছে খুন হওয়া তরুণীর জন্মদাতার কণ্ঠ থেকে। প্ল্যাটফর্মে যাঁদের চোখের সামনে সেই নৃশংস হত্যালীলা ঘটেছিল, তাঁরা ‘মূক’ না হলে মেয়েকে এ ভাবে খোয়াতে হত না, বললেন বিয়োগ-বিহ্বল পিতা। শোকের স্তম্ভন কাটার পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এক বাবার প্রাণ যেন ডুকরে উঠল।

একটা মাত্র কথা গুচ্ছ গুচ্ছ অস্বস্তিকর প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়েছে চারপাশে। এত পাষাণ হয়ে গিয়েছি আমরা? ব্যস্ত রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে সকলের চোখের সামনে আততায়ী কুপিয়ে হত্যা করে তরুণীকে, আর আমরা সব দেখে সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তের ছবি তোলার জন্য পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করার কথা না ভুললেও, তরুণীকে বাঁচানোর চেষ্টা করার কথা ভুলে যাই? এক প্ল্যাটফর্ম ভিড়ের মধ্যে এক জনেরও কি মনে হয় না যে ছুটে যাওয়া উচিত, আততায়ীকে বাধা দেওয়া উচিত? নাকি সাহসে কুলায় না আজকাল আর? নাকি ট্রেন ধরার তাড়া এতই বেশি থাকে যে সহযাত্রীকে আচমকা ধারালো অস্ত্রের একের পর এক কোপে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখলেও সে দিকে খুব বেশি মনোযোগ দেওয়ার ফুরসৎ হয় না?

শোকসন্তপ্ত পিতার একটা কথা এই এতগুলো প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে, গোটা সমাজকে, গোটা নাগরিক জীবনকে। নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা আজ!চোখের সামনে সহ-নাগরিককে, সহযাত্রীকে খুন হয়ে যেতে দেখলেও প্রাথমিক কর্তব্যটুকু নির্ধারণ করে উঠতে পারি না!

আমরা যারা চেন্নাইয়ের ওই রক্তাপ্লুত প্ল্যাটফর্মে ছিলাম, তারা পাল্টা প্রশ্ন তুলতেই পারি। বলতেই পারি: খুন করল আততায়ী, দোষী হলাম আমরা? মৃতার বাবা কি ঠিক করছেন? খুনীকে দোষ না দিয়ে মেয়েকে চিরতরে হারানোর জন্য আমাদের মতো প্রত্যক্ষদর্শীদের দোষারোপ করছেন? ‘মূক’ বলে গালি দিচ্ছেন?

হ্যাঁ গালি দিচ্ছেন। আলবাৎ দিচ্ছেন, দেবেন। আমরা যদি ভুলে যাই যে আমরা সমাজবদ্ধ, তা হলে গালি শুনতে হবে বই কি? সভ্যতার বড়াই করি, সংস্কৃতির শ্লাঘায় নিজে নিজেই তৃপ্ত হই,নাগরিক সভ্যতার দর্পে বিপুলবক্ষ হয়ে উঠতে চাই। কিন্তু মাঝেমধ্যেই বনচারী মানুষের মতো আচরণ করে ফেলি। বিপদ আর শ্বাপদ-সঙ্কুল অরণ্যে আমরা সবাই একা যেন! সবাই সবার আশেপাশে থেকেও যেন অদৃশ্য!

শ্বাপদ যেমন আচমকা হানা দেয় কালান্তক যমের মতো, খুনী-অমানুষের কাছ থেকেও তেমন আচরণই তো প্রত্যাশিত। কিন্তু আমরা যারা নিজেদের সভ্য মানুষ ভাবি, সভ্যতার সঙ্কটে তারাই তো পরস্পরের পাশে দাঁড়াব। তেমনই তো প্রত্যাশিত। যদি না পারি, তা হলে ভর্ৎসনাই প্রাপ্য।

ভয় হয়! একবিংশ শতক থেকে কোনও এক অদেখা প্রস্তর যুগের দিকে আমরা যাত্রা করেছি বলে মনে হয়। যে প্রস্তর যুগ কাটিয়ে এসেছি, এই অদেখা প্রস্তর যুগ তার চেয়ে আলাদা। ফেলে আসা প্রস্তর যুগে মানুষের হাতিয়ার পাথরের ছিল, জীবন ধারণের নানা সরঞ্জাম পাথরের ছিল। যে প্রস্তর যুগের দিকে এখন এগোচ্ছি, সেখানে মানুষগুলো পাথরের হবে।

Chennai Murder of a Infosys Techie Anjan Bandyopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy