মেঘভাঙা বৃষ্টি এবং হড়পা বানে বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী। মঙ্গলবার দুপুরের বিপর্যয়ে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে উত্তরকাশীর ধরালী গ্রাম। এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে চার জনের। নিখোঁজ অনেকে। মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামীর নির্দেশে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উদ্ধারকাজে নেমেছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছে সেনাও। বহু ঘরবাড়ি ধসে গিয়েছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে হর্ষিলের এক সেনাছাউনিও। কিন্তু কী এই মেঘভাঙা বৃষ্টি? কেনই বা হয় বিধ্বংসী এই বিপর্যয়? তা নিয়ে আরও এক বার শুরু হয়েছে চর্চা।
মেঘভাঙা বৃষ্টি আদতে অতিভারী বৃষ্টিই। তবে সাধারণ বৃষ্টির সঙ্গে এর কিছু ফারাক রয়েছে। নির্দিষ্ট এবং সীমিত এলাকা জুড়ে হয় মেঘভাঙা বৃষ্টি। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ভারী বৃষ্টি হলে তাকে মেঘভাঙা বৃষ্টি বলা যায় না। সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এক ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টিপাত হলে তাকে মেঘভাঙা বৃষ্টি বলে। মূলত পার্বত্য এলাকাতেই এ ধরনের বিপর্যয় হয়ে থাকে। তবে সমতলেও মেঘভাঙা বৃষ্টি হতে পারে। মেঘভাঙা বৃষ্টির পর হড়পা বানের প্রবল সম্ভাবনা থাকে। কারণ, পাহাড়ি নদীতে ধারণক্ষমতার অনেক বেশি জল আচমকা এসে পড়লে প্রবল বেগে হুড়মুড়িয়ে বইতে থাকে স্রোত। হড়পা বানে ধুয়েমুছে যায় নদীর দু’কূল। যেমনটা মঙ্গলবার দুপুরে ক্ষীরগঙ্গা নদীতে হয়েছে।
কেন মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়?
এই বিপর্যয়ের নেপথ্যে রয়েছে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ। কখনও কখনও একসঙ্গে অনেকটা উষ্ণ, আর্দ্র বাতাস পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অপেক্ষাকৃত দ্রুত উপরে উঠে আসে এবং ক্রমে ঠান্ডা হয়ে মেঘে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াকে ‘অরোগ্রাফিক লিফ্ট’ বলে। একসময় মেঘ আর জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে পারে না। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অল্প সময়ের মধ্যে সেই জলীয় বাষ্প মুষলধারে বৃষ্টির আকারে নেমে আসে। উষ্ণ ও শীতল বাতাসের মিশ্রণ, পরিচলন পদ্ধতিতে ঊর্ধ্বমুখী বায়ু চলাচল এবং অপেক্ষাকৃত বেশি উচ্চতায় বাতাসের অত্যধিক আর্দ্রতার কারণেও মেঘভাঙা বৃষ্টি হতে পারে। এই ধরনের বৃষ্টিতে জলের ফোঁটাগুলি এতটাই বড় এবং সংগঠিত হয় যে, আলাদা করে জলবিন্দু হিসেবে তাদের পৃথক করা যায় না।
আরও পড়ুন:
ভারতে হিমালয়ের পাদদেশের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিরূপ, বায়ুপ্রবাহ এবং উচ্চতাভেদে তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে প্রায়ই মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়। সে কারণে হিমাচল প্রদেশ, সিকিম, উত্তরাখণ্ড-সহ হিমালয়-সংলগ্ন রাজ্যগুলিতে এই বিপর্যয় বেশি দেখা যায়। আবহাওয়া দফতর কেবলমাত্র হালকা নাকি ভারী বৃষ্টি হবে, তা বলতে পারে, কিন্তু কোন এলাকায় ঠিক কতটা বৃষ্টি হবে, তা বলতে পারে না। সে কারণে আগে থেকে মেঘভাঙা বৃষ্টির সতর্কতা জারি করাও কঠিন। মেঘভাঙা বৃষ্টির পরেই দেখা দেয় হড়পা বানের আশঙ্কা। কখনও কখনও ভূমিধসও নামে। সে কারণেই মেঘভাঙা বৃষ্টি এত বিপজ্জনক। গত এক দশকে ভারতে একাধিক মেঘভাঙা বৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালের ১৬ জুন কেদারনাথে মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে। মৃত্যু হয় অন্তত চার হাজার মানুষের। ২০২১ সালে জোশীমঠের বিপর্যয় আরও এক বার উস্কে দেয় সেই ঘটনার স্মৃতি। ২০২৪-এও হড়পা বান হয়েছে উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল প্রদেশে। চলতি বছরের জুনেও একের পর এক মেঘভাঙা বৃষ্টিতে থমকে গিয়েছিল হিমাচলের জনজীবন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল কয়েকশো কোটি টাকার।
মঙ্গলবার দুপুরের মেঘভাঙা বৃষ্টির পর আচমকা হড়পা বান নামে ক্ষীরগঙ্গা নদীতে। জলের তোড় নেমে আসে সুক্কি-সহ আশপাশের গ্রামগুলির উপর। ধুয়েমুছে যায় ধরালী গ্রামের একাধিক ঘরবাড়ি। হর্ষিল সেনাছাউনি থেকে ১১ জন সেনাকর্মী নিখোঁজ। তাঁদের খোঁজে তল্লাশি জারি রেখেছেন সেনা, পুলিশ এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীরা। উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশ থেকে এয়ারলিফ্ট করে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে উত্তরাখণ্ডে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামীকে ফোন করে পরিস্থিতির খবরাখবর নিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।