Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অচেনা ট্রাম্প কতটা বন্ধু, মাপছে ভারত

চেনা শত্রুর চেয়ে অচেনা বন্ধুর সঙ্গে কাজ করা বেশি কঠিন। মার্কিন নির্বাচনের ফল স্পষ্ট হতেই কথাটা ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল সাউথ ব্লকে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে বললে আমেরিকার সদ্যনির্বাচিত পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর টিম ভারতের বন্ধুই।

অগ্নি রায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩০
Share: Save:

চেনা শত্রুর চেয়ে অচেনা বন্ধুর সঙ্গে কাজ করা বেশি কঠিন। মার্কিন নির্বাচনের ফল স্পষ্ট হতেই কথাটা ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল সাউথ ব্লকে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে বললে আমেরিকার সদ্যনির্বাচিত পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর টিম ভারতের বন্ধুই। কিন্তু দেশের কূটনৈতিক কর্তা ও মন্ত্রী-আমলাদের কাছে তাঁরা সম্পূর্ণ অপরিচিত। আগামী ট্রাম্প জমানার আমেরিকার সঙ্গে ‘বন্ধুত্বের’ প্রশ্নে আপাতত তাই সতর্ক হয়েই পা ফেলতে চাইছে নয়াদিল্লি।

হিলারি ক্লিন্টনকে ভারত ভাল রকম জানে। আট বছরের মার্কিন ফার্স্ট লেডি। তার পরে আরও আট বছর ছিলেন সেনেটর। বারাক ওবামার জমানায় বিদেশমন্ত্রী হিসেবে আরও চার বছর। ফলে হিলারি ক্ষমতায় এলে ভারতের পক্ষে তা হতো পড়া বই উল্টেপাল্টে দেখার মতো। তাঁর ডেমোক্র্যাটসুলভ নীতির কোনটা এ দেশের পক্ষে কতটা ভাল বা মন্দ— তার আঁচ পাওয়া অনেকে সহজ হতো দিল্লির কর্তাদের কাছে।

আগেকার রিপাবলিকান প্রেসিডন্টদের ও তাঁদের টিমের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেছে ভারত। কিন্তু ট্রাম্প? প্রাক্তন বিদেশসচিব কনওয়াল সিব্বল বলছেন, ‘‘যে সব রিপাবলিকান নেতাকে আমরা চিনি, তাঁদের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর টিমের লোকজন পড়েন না।’’ একমত দেশের বর্তমান কূটনীতিকরাও। ফলে গত কয়েক মাসে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার থেকে তাঁর আগামী কর্মসূচি সম্পর্কে যেটুকু ছবি তৈরি হয়েছে, আপাতত তার উপর নির্ভর করেই ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ বোঝার চেষ্টা শুরু হয়েছে।

নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড বর্মা এ দিন কিছুটা অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতেই বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘দু’দেশের মধ্যে যে বন্ধুত্ব রয়েছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তার ভিত। এটা নিছক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ ও আরও মজবুত হয়ে ওঠা ছাড়া ভারত-মার্কিন সম্পর্কের আর কোনও পরিণতি হতে পারে না।’’

তবে এতেই আশ্বস্ত হচ্ছে না সাউথ ব্লক। বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, এটা ঠিক যে, চিন ও পাকিস্তান সম্পর্কে ট্রাম্পের অবস্থান কঠোর। তিনি ক্ষমতায় আসায় ভূকৌশলগত রাজনীতিতে তুলনায় খানিকটা সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছবে নয়াদিল্লি। কিন্তু আমেরিকায় কর্মরত ভারতীয় পেশাদারদের ভবিষ্যৎ, দ্বিপাক্ষিক উদার বাণিজ্য-সম্পর্ক মুখ থুবড়ে পড়তে পারে— এমন আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। আমেরিকার অভিবাসন, ভিসা বা বাণিজ্য নীতি বিদায়ী ডেমোক্র্যাট জমানার থেকে অনেক গুণ কঠোর হয়ে পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিদেশ মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘ভাল-মন্দ, দু’দিকের মধ্যে ভারসাম্য রেখেই কূটনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এখন। আমেরিকায় যে সরকার আসুক, তাদের সঙ্গেই কাজ করতে হবে আমাদের। দু’‌দেশের কৌশলগত সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। রয়ে-সয়ে, পরিস্থিতি বুঝেই আমরা মার্কিন নীতির পুনর্মূল্যায়ন করব।’’

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, বাণিজ্যের প্রশ্নে আমেরিকায় কার্যত পাঁচিল তোলার অভিপ্রায় ঘোষণা করেছিলেন ট্রাম্প। ভারত দেখতে চাইছে, দায়িত্বে আসার পরে বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প ওই সব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে কতটা তৎপর হন। বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘ভুললে চলবে না, ভারতই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আমেরিকার সবচেয়ে বড় খদ্দের। ট্রাম্পরা যদি একতরফা ভাবে ভারতীয়দের ভিসা পাওয়া কঠিন করে তোলেন, কিংবা কাজের ‘আউটসোর্সিং’ কমিয়ে দেন, ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তিতেও তার প্রভাব পড়বে।’’ শুধু প্রতিরক্ষায় নয়, সামগ্রিক ভাবেও ভারতের বিশাল বাজারকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে চলা ট্রাম্পের পক্ষে সম্ভব হবে না বলেই মনে করছে সাউথ ব্লক।

কনওয়ালের কথায়, ‘‘প্রচারে ভারত সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। এক বার বলেছেন, ভারত তথ্যপ্রযুক্তি-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের কাজ করছে। আবার আমেরিকা থেকে যে সব চাকরি ভারতে চলে গিয়েছে, তা ফিরিয়ে আনার কথাও বলছেন। মেক্সিকো, চিন ও ভারতকে এক বন্ধনীতে ফেলে অভিযোগ করেছেন, এই দেশগুলি আমেরিকার চাকরি চুরি করে নিচ্ছে। কাজেই নয়াদিল্লিকে অপেক্ষা করে দেখতে হবে, শেষ পর্যন্ত এই দুইয়ের মধ্যে কোনও ভারসাম্যে পৌঁছায় কিনা নতুন মার্কিন প্রশাসন।’’ কনওয়াল এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ট্রাম্প ঘোষিত ভাবেই মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির বিরুদ্ধে, যা কিনা ভারতের স্বার্থবিরোধী। তাঁর মতে, সব মিলিয়ে এক দিক থেকে নয়াদিল্লির উপর চাপ কিছুটা বাড়বেই।

তবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ যে পুরোটাই অন্ধকার, এমনটাও মনে করা হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ, সীমান্ত থেকে সন্ত্রাস, বাণিজ্য থেকে কূটনীতি— বিভিন্ন প্রশ্নে ভারত এই মুহূর্তে যে দু’টি দেশের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে রয়েছে, সেই চিন ও পাকিস্তান সম্পর্কে ট্রাম্পের ঘোষিত অবস্থান বেশ কঠোর। পরোক্ষে এটা ভারতের পক্ষে যথেষ্ট স্বস্তির বিষয়।

দিল্লির দাঁড়িপাল্লা

আশঙ্কা

• পুরনো সমস্ত বাণিজ্য চুক্তি নতুন করে খতিয়ে দেখা

• এইচ ১বি ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়া

• আউটসোর্সিং বন্ধ হওয়া

• আমেরিকায় কর্মরত ভারতীয় পেশাদারদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়া

• ভারতে কর্মরত মার্কিন সংস্থাগুলিকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রয়াস, যাতে ধাক্কা খেতে পারে মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’

আশা

• সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কর্মসূচির ঘোষণা

• পাকিস্তানকে জঙ্গিদের স্বর্গোদ্যান হিসাবে চিহ্নিত করা

• অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিনের উপর চাপ তৈরি করা

• রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন সুসম্পর্কের সূচনা, যাতে লাভবান হবে নয়াদিল্লি

• কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে হইচই কম হতে পারে

‘টিম ট্রাম্প’ বারবার এটা তুলে ধরেছে যে, বেজিং ও পাকিস্তান দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে আমেরিকার পুঁজি দুইয়ে-দুইয়ে নিজেদের ভাঁড়ার ভরিয়েছে। আমেরিকায় যখন উৎপাদন শিল্পে কর্মসংস্থানের বিপুল ঘাটতি, এই ক্ষেত্রে তখন মিনার গড়েছে চিন। অন্য দিকে ট্রাম্পের অভিযোগ, তালিবানি সন্ত্রাস দমনের নাম করে বছরের পর বছর অনুদান আদায় করেছে পাকিস্তান। কাজের কাজ কিছু হয়নি, উল্টে মার্কিন রাজকোষ খালি হয়েছে। ক্ষমতায় এলে শুধু আইএস নয়, পাক জঙ্গি সংগঠনগুলির বিরুদ্ধেও যে ট্রাম্প কঠোর অবস্থান নেবেন, এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি।

প্রাক্তন বিদেশ প্রতিমন্ত্রী শশী তারুর বলছেন, ‘‘রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আমাদের পক্ষে সুবিধাজনক। বেশ কিছু ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটদের তুলনায় তাঁদের ছুঁৎমার্গ ও স্পর্শকাতরতা কম। মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরমাণু সম্প্রসারণের মতো বিষয় নিয়ে ওবামা সরকার যে ভাবে নয়াদিল্লির পিছনে পড়ে থাকত, এ ক্ষেত্রে তেমন বিষয় থেকে রেহাই পাবে ভারত।’’

রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও নয়াদিল্লির পক্ষে সুবিধের। একই সঙ্গে রাশিয়া ও আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাম দিতে হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে। রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের মৈত্রীতে খানিকটা চিড় ধরেছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিবাদ যখন তুঙ্গে, তার মধ্যেই পাকিস্তানের মাটিতে যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়েছে মস্কো। ওয়াশিংটন-মস্কো বোঝাপড়া থাকলে নয়াদিল্লির পক্ষেও তা স্বস্তির।

ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির প্রধান রূপকার এবং ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত রণেন সেন জানাচ্ছেন, তাঁর দীর্ঘ আমেরিকা বাসের সময় মাত্র এক বারই এক সামাজিক অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর দেখা ও আলাপ হয়েছিল। তিনি এবং কনওয়াল বা বর্তমানে আমেরিকায় কর্মরত ভারতীয় কূটনীতিকরা— কেউই আঁচ করে উঠতে পারছেন না, ভোটের সময় যা বলেছেন, কাজে তার চেয়ে কতটা নরম হবেন ট্রাম্প। পোড়খাওয়া প্রাক্তন কূটনীতিবিদ কনওয়ালের কথায়, ‘‘ট্রাম্প জেতায় ও দেশের সমাজে বিদ্বেষ-বৈরিতা-মেরুকরণের সমস্যা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার প্রতিফলন পড়তে পারে তাদের বিদেশনীতিতেও।’’ ফলে আমেরিকায় বসবাসকারী বা কর্মরত অসংখ্য ভারতীয়কে নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে। আপাতত কোন জল কতটা গড়ায়, নজর রাখছে দিল্লি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE