মাত্র ৩২ সেকেন্ডের ব্যবধান। বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ৩৯ মিনিট ৬ সেকেন্ড থেকে দুপুর ১টা ৩৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ড! এর মধ্যেই বিমানবন্দরের চৌহদ্দি পেরিয়ে বস্তি এলাকা পার করে পড়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার। যেখানে পাঁচিল পেরোলেই জাভেরচাঁদ মেঘানী নগর রোড। ১০ ফুট চওড়া যে রাস্তা পার করলেই আমদাবাদের নিউ সিভিল হাসপাতালের ৮ নম্বর গেট।
বিমানটি আরও এগিয়ে গিয়ে পড়লে কী হত? সেখানেই তো আমদাবাদ সরকারের ১২০০ বেডের হাসপাতাল। আর বিমান যদি বিমানবন্দরের সীমানা ছাড়িয়েই দোতলা-তিনতলা বাড়ির ঘিঞ্জি বস্তিতে ভেঙে পড়ত? আমদাবাদ সিটি পুলিশের কমিশনার জ্ঞানেন্দ্রসিংহ মালিক বলছিলেন, ‘‘৫০ মিটার এ দিক ও দিক হলেই অন্তত এক হাজারের বেশি মানুষ মারা যেতেন।" তা এড়ানো গেল কী করে? পিছনে ঘন বসতি, সামনে হাসপাতাল ছেড়ে মাঝের এই অপেক্ষাকৃত ফাঁকা অংশে যে বিমান পড়ল, তার পিছনে কি দুই বিমানচালকের শেষ মুহূর্তের লড়াই না কি নিয়ন্ত্রণহীন বিমানের স্রেফ আছড়ে পড়া। ডিরেক্টর জেনারেল অব সিভিল এভিয়েশনের প্রাক্তন আধিকারিক সুধীর নায়ার বলছিলেন, ‘‘বিমান যখন ইঞ্জিনের জোর পাচ্ছে না, তখন সেটির পক্ষে অবতরণের জন্য কোনও জায়গা নির্ধারণ করা অত্যন্ত শক্ত। বিমানটি যে দিক থেকে উড়েছিল সেখানে প্রচুর ঘনবসতি। তার মধ্যে ফাঁকা জায়গা চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। তবে বিমানের যাত্রাপথেই ছিল ৩০ তলা আবাসন। সেটিকে কিন্তু এড়িয়ে গিয়েছে বিমানটি। তারপর এমন এক জায়গায় পড়েছে, যাতে পথচলতি বা বাড়িতে থাকা মানুষের তুলনামূলক কম মৃত্যু হয়েছে। এর জন্য আগামী দিনে হয়তো বিমানের দুই চালককে কৃতিত্ব দিতে হবে।’’
বাণিজ্যিক বিমানের চালক নেহা শর্মা বলছিলেন, ‘‘বিমানচালক ক্যাপ্টেন সুমিত সবরওয়াল স্যারের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছি আমরা অনেকেই। স্যর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাথা ঠান্ডা রাখার ব্যাপারে জোর দিতেন। তিনি ছিলেন বলে হয়তো সাহায্যহীন বিমানকেও এমন ভাবে নামিয়েছেন যাতে বিমানের কয়েকটি টুকরো হয়েছে। বিমানের গোটা দেহ যদি কয়েকটি টুকরো হয়ে যায়, সকলের একসঙ্গে বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঝুঁকি কিছুটা কমে যায়। বিপুল জ্বালানির বিস্ফোরণে এ ক্ষেত্রে তা কাজে লাগেনি। তার সুবিধা একমাত্র পেয়েছেন ১১এ আসনের যাত্রী বিশ্বাসকুমার রমেশ। ছাত্রাবাসের ক্যান্টিনে লেজের অংশ লেগে একটা টুকরো হয়ে যাওয়াতেই তিনি বিমানের পেটের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন।’’
প্রাক্তন বিমানচালক আশরাফ শেখ যদিও মনে করেন, ৩০-৩২ সেকেন্ডে বিমানচালকের তেমন কিছু করার থাকে না। তাঁর কথায়, ‘‘যে ক'টি ভিডিয়ো দেখেছি, তাতে বিমানটি রানওয়ের প্রায় শেষে গিয়ে শূন্যে উঠেছিল। সাধারণত রানওয়ের ৬০-৭০ শতাংশ ব্যবহার করেন বিমান চালক। কারণ, সমস্যা হলে যাতে বাকি অংশ ব্রেক কষে দাঁড়ানোর কাজে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এ বারে শেষ অংশে গিয়ে ধুলো উড়িয়ে বিমানটিকে উড়ে যেতে দেখা গিয়েছে ভিডিয়োয়। বিমানচালক কেন সেই সময়ে থামলেন না, সেটা প্রশ্ন। বিমানের ইঞ্জিন যখন কাজ করে না, তখন চালকের কাছে আগেই ধাক্কা লাগিয়ে নামিয়ে দেওয়া বা আরও কিছুক্ষণ নিয়ে গিয়ে গতি একেবারে কমিয়ে ধাক্কা লাগানোর সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই নামিয়ে দিলে যে গতিতে ধাক্কা খাবে এবং বিস্ফোরণ হবে, একটু পরে নামালে হয়তো গতি কমে যাওয়ায় ধাক্কার অভিঘাত কিছুটা কম হবে। তবে এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।’’
এয়ারবাস ৩২০-এর চালক অরিন্দম দত্ত বললেন, ‘‘আমদাবাদ থেকে বহু বার উড়ান শুরু করার অভিজ্ঞতা থাকায় বলতে পারি, ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এত বড় বিমানকে যে দিকে খুশি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। গাড়ির ব্রেক ফেল হলে স্টিয়ারিং ধরে যে ভাবে কাটিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় ধাক্কা লাগিয়ে থামানো যায়, কিছু ক্ষেত্রে বিমানেও তা করা সম্ভব। কিন্তু মাত্র ৩২ সেকেন্ডে কাজটা অত্যন্ত কঠিন। তবে বিমানচালকের ঘাড়ে দোষ চাপানো সহজ। দেখতে হবে ঠিক তদন্ত যেন হয়। না হলে যে চালকের কৃতিত্ব পাওয়ার কথা, তাঁকেই হয়তো কাঠগড়ায় তোলা হবে।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)