E-Paper

মধ্যদিনের রাখাল

হিমালয়-যাত্রার গল্প শোনাতে গিয়ে জীবনস্মৃতি-তে তাঁর মনে পড়ে ঘুমে ঢুলে পড়ে বাবা মহর্ষির কাছে দুপুরে পড়তে বসার ছবি।

নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:৪৮
আবিষ্ট: রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি। রবীন্দ্রভবন, বিশ্বভারতীর সৌজন্যে প্রাপ্ত

আবিষ্ট: রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি। রবীন্দ্রভবন, বিশ্বভারতীর সৌজন্যে প্রাপ্ত

আট দশকের দুপুরবেলা কী ভাবে কাটাতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? শীত এলে, সেই জল্পনা মিঠে রোদের মতো এক কৌতূহলের উত্তাপ এনে দিয়ে যায়। বালকবয়সের স্মৃতিকথা ছেলেবেলা-য় রয়েছে তাঁর হারিয়ে যাওয়া দুপুরবেলার ছবি। জোড়াসাঁকোর বাড়ির জানলার নীচেই ঘাট-বাঁধানো পুকুর, আর প্রকাণ্ড এক চিনা বট। স্নান সমাপনান্তে, দ্বিপ্রহরের কোলাহল থেমে গেলে, সেই বটবৃক্ষের আঙিনা কবির সমস্ত মন অধিকার করে নিত। তাঁর জ্যোতিদাদা দুপুরবেলা চলে যেতেন বাড়ির নীচের তলায় কাছারিতে। বৌঠাকরুন যত্ন করে কাটা ফল নিজের হাতে তৈরি মিষ্টির সঙ্গে রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে, গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে ‘সমস্তটার উপর একটা ফুলকাটা রেশমের রুমাল ঢেকে মোরাদাবাদি খুঞ্চেতে করে’ রওনা করে দিতেন কাছারিতে। তখন বাড়ি বাড়ি বঙ্গদর্শন পড়ার ধুম লেগেছে। মধ্যাহ্নের তন্দ্রা হরণ করে নেওয়া এই পত্রিকা রবি হাতে পেতেন অনায়াসেই, কেননা তিনি ‘ভাল পড়ে শোনাতে’ পারতেন। তিনি লিখছেন, “আপন মনে পড়ার চেয়ে আমার পড়া শুনতে বউঠাকরুন ভালোবাসতেন।” রবীন্দ্রনাথ তপ্ত দুপুরে পড়ে চলেছেন, কাদম্বরী শুনছেন, তাঁর হাতপাখার বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে বালক রবির মনপ্রাণ।

জ্যোতিদাদার সঙ্গে চন্দননগরে গঙ্গার ধারে এক বাড়িতে বসবাসের সময়, ঘনঘোর বর্ষায় বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ পদটিতে মনের মতো সুর বসিয়ে ‘বর্ষার রাগিণী গাহিতে গাহিতে বৃষ্টিপাতমুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন খ্যাপার মতো’ কাটিয়ে দেওয়ার কথা স্মরণ করেছেন তিনি। আবার শরৎ-মধ্যাহ্নে দেওয়াল ভেদ করা ‘সোনালি রঙের মাদকতা’য়, জাজিম-বিছানো কোণের ঘরে একটা ছবি আঁকার খাতা নিয়ে আঁকতে বসার কথা লিখেছেন জীবনস্মৃতি-তে। এটাই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার প্রথম কোনও প্রয়াসের উল্লেখ। জীবনের উপান্তে যখন পুরোদস্তুর চিত্রশিল্পী হয়ে তাঁর সৃষ্টি নব ঝর্নাধারার মতো প্রবাহিত হল, সেই দুপুরবেলাই তখন যেন এক নিঃসঙ্গতায় দৃশ্যমান, মিশ্র মাধ্যমে আঁকা তাঁর নানা নিসর্গের উজ্জ্বল, বিষণ্ণ রোদের ভিতর।

হিমালয়-যাত্রার গল্প শোনাতে গিয়ে জীবনস্মৃতি-তে তাঁর মনে পড়ে ঘুমে ঢুলে পড়ে বাবা মহর্ষির কাছে দুপুরে পড়তে বসার ছবি। বাবা ছুটি দিলেই তাঁর ঘুম যেত ছুটে। কখনও দুপুরবেলা লাঠি হাতে এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে একা চলে যেতেন রবীন্দ্রনাথ। উদ্বিগ্ন হতেন না মহর্ষি। কেননা “তিনি জানিতেন, সত্যকে ভালবাসিতে না পারিলে সত্যকে গ্রহণ করাই হয়না।” জোড়াসাঁকোর বাড়ির ছাদে কোনও মধ্যাহ্নে, বন্দি খাঁচার পাখি রবীন্দ্রনাথকে ডাক দিয়ে যেত মুক্ত বনের পাখির মতো বিশ্বপ্রকৃতি: “দূরে দেখা যাইত তরুচূড়ার সঙ্গে মিশিয়া কলিকাতা শহরের নানা আকারের ও নানা আয়তনের উচ্চনীচ ছাদের শ্রেণী মধ্যাহ্নরৌদ্রে প্রখর শুভ্রতা বিচ্ছুরিত করিয়া পূর্ব দিগন্তের পাণ্ডুবর্ণ নীলিমার মধ্যে উধাও হইয়া চলিয়া গিয়াছে।” জজ মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথ আদালতে চলে গেলে শাহিবাগের প্রাসাদোপম প্রকাণ্ড বাড়িতে একাকী রবীন্দ্রনাথ শুনতেন পায়রাদের ‘মধ্যাহ্নকূজন’। দাদার বইয়ের ভিতর কাব্যসংগ্রহঃ-এর সংস্কৃত কবিতাগুলো না বুঝলেও তাদের ধ্বনি এবং ছন্দের গতি কিশোর কবিকে কত মধ্যাহ্নে ‘অমরুশতকের মৃদঙ্গঘাতগম্ভীর শ্লোকগুলির মধ্যে ঘুরিয়া ফিরিয়াছে’।

কাদম্বরীকে তাঁর জীবদ্দশায় উৎসর্গ করা ছবি ও গান কাব্যগ্রন্থের ‘মধ্যাহ্ন’ কবিতায় আকাশ-সমুদ্র, উঁচু-নিচু পথ, সুদূর বনরেখা, গাছের ছায়াঘেরা স্তব্ধ দুপুরের ছবি দেখতে দেখতে কবির অনুভব, “ভালোবাসা আজি কেন সঙ্গীহারা পাখি যেন/ বসিয়া গাহিছে একেলাটি।” অচিরেই তাঁর নিজের কাছেই যেন প্রশ্ন: “কাছে কারে পেতে চায়, সব তারে দিতে চায়/ মাথাটি রাখিতে চায় কোলে।” বিলেতে বেলা দুটোয় দেশের শীতের দুপুরবেলার মতো মিঠে বাতাস আর ঝাঁ ঝাঁ রোদ রবীন্দ্রনাথের মনকে যেন উতলা করে তোলে: “এমন ভালো লাগছে আর এমন একটু কেমন উদাস ভাব মনে আসছে যে কী বলব।” (য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র)। ছিন্নপত্রাবলী-র এক পত্রে (১৯ জানুয়ারি ১৮৯১) দেখা যায়, জমিদার রবীন্দ্রনাথ বেলা দেড়টায় বোটে ভেসে চলেছেন কাছারির দিকে। বহু বছর পরে, নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখছেন বাল্যের খেলাঘরের মতো কর্তব্যহীন চোখে প্রকৃতির রূপ দেখার কথা: “…শান্তিনিকেতনে আমার জানলায় বসে সবুজ মাঠ ও নীল আকাশের উপর শীত মধ্যাহ্নের ছায়ালোকের তুলি বোলানো দেখে সব কাজ ছেড়ে বেলা কাটিয়েছি।” (২ মার্চ ১৯৩০)

গড়পড়তা বাকি সকলের মতো, দুপুরে কি ঘুম পেত না রবীন্দ্রনাথের? এক বার রাণুকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আজ দুপুরবেলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে খানিকটা ঘুমচ্চি— খানিকটা জেগে আছি, খানিকটা চেয়ে চেয়ে আকাশ দেখচি…” নির্মলকুমারীকে লিখছেন, ঘুমে-ঢলা দুপুরবেলা ‘চিঠি লিখতে লিখতে আঙুলের ডগার উপর ঘুম এসে ভর করে’ (১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৮)। আবার এক মন্থর, অলস ‘তন্দ্রাবিষ্ট’ শরৎ-মধ্যাহ্নে তাঁকেই লিখছেন, সেই নির্জন মধ্যাহ্ন ‘কালের পথ ধরে নিরুদ্দেশ নিরর্থকতার দিকেই চলেছে’।

সম্ভবত প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজে প্রেমতোষ বসুর জন্য এক দুপুরে অপেক্ষায় বিরক্ত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “দুপুরের পর শব্দটা সময় হিসাবে অত্যন্ত অনির্দিষ্ট— তাই সুদীর্ঘ কাল আপনার জন্য অপেক্ষা করিয়া আমি বাহিরে যাইতে বাধ্য হইলাম” (৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৭)। বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা কয়েকটা চিঠিতে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রায়ই বাড়িতে ডাকছেন ব্যস্ততাহীন দুপুরগুলোয়: “কাল সমস্ত দুপুর বেলা— আমার সময় আছে— যখন ইচ্ছা আসবেন।” শোনাতে চাইছেন নিজের কবিতা, কখনও মধ্যাহ্নে কাজে বেরোনোর কথা জানাচ্ছেন। কন্যা মীরাকে শান্তিনিকেতন থেকে লেখা এক চিঠিতে (চৈত্র ১৩১৭) দেখা যাচ্ছে রোজ দুপুরবেলা অধ্যাপকদের কবিতার ক্লাস নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যাখ্যা করছেন তাঁর কবিতা। দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লেখা চিঠিতে দেখা যায় বৌমা প্রতিমাকে নিয়ে দুপুরের গাড়িতে রেলপথে সম্ভবত কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরছেন কবি।

মা, বাবা, অগ্রজ ভ্রাতৃবৃন্দ এবং সর্বোপরি প্রিয়তমা বৌঠাকরুনের স্মৃতিবিজড়িত কৈশোর আর দুপুর, সেই সঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাড়ির ছাদ যেন একাকার হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের চেতনার গভীরে। মায়ের মৃত্যুর নয় বছরের মাথায়, তাঁর চব্বিশ বছর বয়সে, কাদম্বরীর আত্মহনন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে গেল বাকি জীবনের দ্বিপ্রহরের বিরামহীন দীর্ঘশ্বাস। সেই নিদারুণ মৃত্যুশোকের অভিঘাতে তাঁর দুপুরগুলো কি হয়ে রইল ‘যাহা আছে আর যাহা রহিলনা’র (জীবনস্মৃতি) বিব্রত দোলাচল? তাঁর কিছু গান আর কবিতার দিকে তাকালে অন্তত সেই কথাই মনে হয়।

সঙ্গীহারা মধ্যদিনের পাখির সঙ্গীত থেমে আছে তাঁর এক গানে। প্রকৃতি আর সৃষ্টির অন্তহীন আনন্দময় ভুবনে ডুবে থেকেও সেই অসমাপ্ত সঙ্গীতের রেশ ধরে রাখা বিমর্ষ কবি যেন নিজেকেই বোঝান, ‘হে রাখাল, বেণু তব বাজাও একাকী’ (১৩৩১)। এখানে কবি রাখাল হলে, কে সেই মধ্যদিনের সঙ্গীতহারা পাখি? আর একটি গান। গ্রীষ্মের খরমধ্যাহ্নের ‘বিজন বাতায়নে’, কৈশোরের ‘সলাজ কানাকানি’ আর প্রথম প্রেমের বাণীর স্মৃতিভারাতুর কবি আবৃত এক ‘ক্লান্তিভরা’ অনুক্ত বেদনার মায়ায়: ‘আজ কেন তাই তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায় মর্মরিছে গহন বনে বনে।’

ইন্দিরাদেবীকে ‘আজকাল দুপুর বেলাটা বেশ লাগে’ (১০ আষাঢ় ১২৯৮), জানিয়েও নিস্তব্ধ দুপুরে রেখেছিলেন কৌতূহল জাগিয়ে দেওয়া এক প্রশ্ন, “আমাদের দেশের মাঠ ঘাট রোদ্দুরের মধ্যে এমন একটা সুগভীর বিষাদের ভাব কেন লেগে আছে?” ১৮৯৫-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ইন্দিরাকেই ভ্রমরগুঞ্জনে বিরহী হৃদয় আন্দোলিত হওয়ার প্রসঙ্গে লিখছেন, “মধ্যাহ্নটা মাঠের উপর প্রসারিত হয়ে পড়েছিল এবং গাছের নিবিড় নিভৃত পল্লবরাশির মধ্যে একটি শান্ত নিস্তব্ধতা ছায়া বিস্তার করে বিরাজ করছিল— বুকের ভিতরে একটা ব্যথা বোধ হচ্ছিল, আর সেই সময়ে বারান্দার নিকটবর্তী একটা নিম গাছের কাছে ভ্রমরের অলস গুঞ্জনধ্বনি সমস্ত উদাস উদার মধ্যাহ্নের একটা সুর বেঁধে দিচ্ছিল। সেইদিন বেশ বুঝতে পারলুম, মধ্যাহ্নের সমস্ত অনির্দিষ্ট শ্রান্ত সুরের মূল সুরটা হচ্ছে ঐ ভ্রমরের গুঞ্জন।”

প্রবাস থেকে চিঠিতে নিজের ছবি আঁকার কথা জানিয়ে, নদীর ধারে এক দুপুরবেলায় দেখা পুত্রবধূ প্রতিমার স্টুডিয়োর কথা ভেবে লিখছেন, “বাইরে একটা তালগাছ খাড়া দাঁড়িয়ে, তারই পাতাগুলোর কম্পমান ছায়া সঙ্গে নিয়ে রোদ্দুর এসে পড়েচে আমার দেওয়ালের উপর,— জামের ডালে বসে ঘুঘু ডাকছে সমস্ত দুপুর বেলা…” (১৮ অগস্ট ১৯৩০)। দেশে, প্রবাসে, নগরে, প্রান্তরে আলো-ছায়ার মায়ার ভরা দুপুরবেলার সৌন্দর্য এক দিকে হাতছানি দিয়েছে কবিকে, অন্য দিকে সেই মধ্যাহ্নকেই কেন্দ্র করে পুঞ্জীভূত এক অপার রিক্ততার আবেশ প্রায়শই ঘিরে রেখেছে তাঁকে।

কৈশোরে যে বাড়ির ছাদের দুপুরবেলার স্মৃতি তছনছ করেছিল তাঁর ‘পরাণ-মন’, ১৯৪১-এর ৭ অগস্ট, কলকাতার সেই বাসভবনেই কবির প্রয়াণ। তখন সবে মধ্যাহ্ন— ঘড়িতে বারোটা বেজে দশ মিনিট। কোন বিরহিণীর অলস দ্বিপ্রহরের উদ্দেশে রাখাল কবি রেখে গেলেন তাঁর দুপুরবেলার বিষণ্ণ সেই দীর্ঘশ্বাসের গান: ‘যখন যাব চলে ওরা ফুটবে তোমার কোলে,/ তোমার মালা গাঁথার আঙুলগুলি মধুর বেদনভরে/ যেন আমায় স্মরণ করে’!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Winter noon

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy