Advertisement
E-Paper

উত্তরাখণ্ড বা হিমাচলের মতো হিমালয় অঞ্চলের রাজ্যগুলি কেন বিপর্যয়ের ‘হটস্পট’ হয়ে উঠেছে? ‘উন্নয়ন’-ই কি দায়ী?

হিমাচলে গত কয়েক বছর ধরেই দুর্যোগের চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। অতিবৃষ্টির জেরে রাজ্যের জায়গায় জায়গায় ধস নামছে। ধসপ্রবণ এলাকার সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০২৫ ১৪:৩৮
হড়পা বানে বিধ্বস্ত জম্মু-কাশ্মীরের চশোতী গ্রাম।

হড়পা বানে বিধ্বস্ত জম্মু-কাশ্মীরের চশোতী গ্রাম। ছবি: রয়টার্স।

ধরালী, হর্ষিল, কিশ্তওয়াড় এবং কাঠুয়া— গত দু’সপ্তাহের মধ্যে উত্তরাখণ্ড এবং জম্মু-কাশ্মীরের এই চার জায়গায় অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর মেঘভাঙা বৃষ্টি এবং তার জেরে হড়পা বান নেমে আসে। আর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ড এবং জম্মু-কাশ্মীর। শুধু উত্তরাখণ্ডই নয়, আর এক রাজ্য হিমাচলেও বর্ষার মরসুমে প্রায় প্রতি দিনই কোথাও না কোথাও মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়েছে, হড়পা বান নেমেছে। ধসের পর ধস নেমে রাজ্য জুড়ে রাস্তা বন্ধ। হিমাচল, উত্তরাখণ্ডে এই দৃশ্য খুব একটা নতুন নয়। বিশেষ করে বর্ষার মরসুমে। কিন্তু দুর্যোগের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে হিমালয় অঞ্চলের এই রাজ্যগুলিতে।

জম্মু-কাশ্মীরে ধস নামে। তবে মেঘভাঙা বৃষ্টি বা হড়পা বানের মতো ঘটনা ঘন ঘন হয়েছে, এমনটা আগে দেখা যায়নি বলে দাবি স্থানীয়দের। তবে কিশ্তওয়াড় এবং কাঠুয়া, জম্মু-কাশ্মীরের এই দুই জায়গায় অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর মেঘভাঙা বৃষ্টি আর হড়পা বানের ঘটনায় আশঙ্কার মেঘ ঘনাতে শুরু করেছে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেরে মৃতের সংখ্যাও উত্তরোত্তর বাড়ছে। এ বছরে এখনও পর্যন্ত ভয়াবহ হড়পা বান নেমেছে উত্তরাখণ্ডের ধরালী এবং জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়ায়। হর্ষিল উপত্যকায় উত্তরকাশীর এই ছোট পাহাড়ি গ্রামটির বেশির ভাগটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পার্শ্ববর্তী গ্রাম হর্ষিলও। এখনও ধ্বংস্তূপের নীচে প্রাণের খোঁজ চলছে ধরালীতে। অন্য দিকে, কিশ্তওয়াড়েও সম্প্রতি নেমে আসে ধরালীর মতো ভয়াবহ হড়পা বান। চশোতী গ্রামের অনেকাংশই সেই হড়পা বানে তছনছ হয়ে গিয়েছে। বহু মানুষ নিখোঁজ। উল্লেখ্য দু’টি ক্ষেত্রেই আগাম কোনও আঁচ পাননি বাসিন্দারা। ফলে মৃত্যু এবং নিখোঁজের সংখ্যা বেড়েছে।

কিশ্তওয়াড়ের চশোতী গ্রামে হড়পা বানে ভেসে গিয়েছে ঘরবাড়ি।

কিশ্তওয়াড়ের চশোতী গ্রামে হড়পা বানে ভেসে গিয়েছে ঘরবাড়ি। ছবি: পিটিআই।

হিমালয় অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে কেন এই ধরনের বিপর্যয় ঘটছে বার বার? বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এবং পশ্চিমি ঝঞ্ঝার জোড়া ধাক্কাতেই পাহাড়ি রাজ্যে এমন লাগাতার বৃষ্টি। পাহাড়ে অবশ্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় নতুন নয়। আচমকা বন্যায় এক রাতে ভেসে গিয়েছে আস্ত জনপদ— এমন ঘটনা বহু বার ঘটেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ঘন ঘন মেঘভাঙা বৃষ্টি, হড়পা বানের যে ঘটনা ঘটছে, তার নমুনা আগে বিশেষ দেখা যায়নি। বিশেষত গত দশ বছরে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নিরিখে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসা যেন নিয়ম করে ফেলেছে উত্তরাখণ্ড এবং পার্শ্ববর্তী হিমাচল প্রদেশ। এর মধ্যে ভয়ঙ্করতম অবশ্যই ২০১৩ সালের কেদারনাথের হড়পা বানের ঘটনা।

২০১৩ সালে কেদারনাথে হড়পা বানের পর ধ্বংসচিত্র।

২০১৩ সালে কেদারনাথে হড়পা বানের পর ধ্বংসচিত্র। ফাইল ছবি।

ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে ভারতের হিমালয়-লাগোয়া অঞ্চল এবং উপকূলবর্তী এলাকা। সেই পরিণতিই ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। তার জলজ্যান্ত নমুনা দেখা যাচ্ছে উত্তরাখণ্ড, হিমাচলে ঘন ঘন হড়পা বান, ধস, মেঘভাঙা বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনায়। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই মত, হিমালয় অঞ্চলের রাজ্যগুলিতে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতখানি দায়ী, তার থেকেও বেশি দায়ী মানুষের কাজকর্ম। অনিয়ন্ত্রিত ভাবে এবং কোনও আইন না মেনে পাহাড়ের কোলে যথেচ্ছ ভাবে নির্মাণকাজ। এ ছাড়াও দেখা যাচ্ছে, পর্যটনের উন্নয়নের স্বার্থে ভূপ্রাকৃতিক গত ভাবে স্পর্শকাতর এলাকায় নানা ভাবে নির্মাণকাজ হচ্ছে। যার জেরে পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঘন ঘন ধস নেমে আসছে। নদীর ঠিক ধার ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে হোটেল, রাস্তা। চওড়া দেওয়াল তুলে পাহাড়ি নদীর স্বাভাবিক স্রোতকে ব্যাহত করে তাকে সঙ্কীর্ণতর করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে অতিবৃষ্টিতে জল যখন বাড়ছে, তখন মানুষ-নির্ধারিত গণ্ডি ছাপিয়ে জল ভাসিয়ে দিচ্ছে আশপাশের এলাকা।

২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’-এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাকৃতিক কারণে হিমালয় অঞ্চলে ঘন ঘন হড়পা বান যেমন হচ্ছে, তার সঙ্গে মানুষের কাজকেও দায়ী করা হয়েছে এই দুর্যোগের জন্য। এ ছাড়াও ভূপ্রকৃতিগত অবস্থান, হিমবাহসৃষ্ট হ্রদ, খাড়াই পাহাড়, যথেচ্ছ পরিমাণে গাছ কাটা, জমির ব্যবহারে বদল আনা এবং বর্ষার মরসুমকেও এই দুর্যোগের নেপথ্য কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান, ধরালীতে যে হড়পা বান নেমে এসেছিল, তা মেঘভাঙা বৃষ্টির কারণে নয়। যে বিপুল জলরাশি নেমে এসেছিল পাহাড় বেয়ে, তা হিমবাহসৃষ্ট হ্রদে ফাটলের কারণেই হতে পারে। অন্তত, দুর্যোগের প্রকৃতি দেখেই তা সন্দেহ করছেন ওই বিশেষজ্ঞরা। যদিও এর প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। ঘূর্ণিঝড়ের মতো মেঘভাঙা বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে। তাই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা পাওয়া গেলেও অনেক ক্ষেত্রে মেঘভাঙা বৃষ্টির তেমন কোনও সতর্কতা থাকে না বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। তবে কিশ্তওয়াড়ের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে, মেঘভাঙা বৃষ্টি না কি হিমবাহসৃষ্ট হ্রদে ফাটলের জের— তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

উত্তরাখণ্ডের ধরালী গ্রাম।

উত্তরাখণ্ডের ধরালী গ্রাম। ছবি: পিটিআই।

বছর চারেক আগে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছিল, ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে উত্তরাখণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল। সে ক্ষেত্রে দায়ী হতে পারে হিমবাহ সৃষ্ট বন্যা। ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নন্দাদেবী পাহাড় থেকে তুষারধস নেমে এসে হড়পা বানের সৃষ্টি করেছিল ধৌলিগঙ্গা এবং ঋষিগঙ্গায়। যার জেরে ভয়ঙ্কর ক্ষতির মুখে পড়ে চামোলি জেলার জোশীমঠ, তপোবন এবং বিষ্ণুপ্রয়াগ। বহু মানুষের মৃত্যু হয়। সেই সময় বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, ভারতীয় ভূখণ্ডের হিমালয় অঞ্চলে ৫ হাজার হিমবাহ সৃষ্ট হ্রদ রয়েছে। তার মধ্যে ৫০০-র বেশি হ্রদ রয়েছে শুধুমাত্র উত্তরাখণ্ডেই।

সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, উত্তরাখণ্ডের ৭৮টি তহসিলের মধ্যে ২৬টি হিমবাহ সৃষ্ট হ্রদের কারণে ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়তে পারে। যাকে ভূগোলের পরিভাষায় ‘গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’ বলা হয়। বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা নেচার-এর রিপোর্ট বলা হয়েছে, ১৯৯০-২০১৮ সালের মধ্যে এ ধরনের হ্রদের সংখ্যা ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, উত্তরাখণ্ডে যে সব হিমবাহ সৃষ্ট হ্রদ তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ হ্রদের বাঁধন খুবই আলগা। যেগুলি অতি সহজে ভেঙে গিয়ে হড়পা বানের সৃষ্টি করতে পারে। পর্বতশিখরে জমে থাকা তুষার উষ্ণায়নের কারণে দ্রুত গলছে। হিমবাহগুলি গলে যাওয়ার কারণে পাহাড়ের কোলে থাকা হ্রদগুলির জলস্তর বাড়ছে। হ্রদের আশপাশে জমে থাকা তুষার, পাথর এবং কাদার বাঁধন কোনও কারণে আলগা হয়ে গেলে হ্রদের জলের চাপ ধরে রাখতে পারছে না। ফলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমেন আসছে জল-কাদার স্রোত।

উত্তরাখণ্ডের ধরালী গ্রামে ভেসে গিয়েছে সেতু।

উত্তরাখণ্ডের ধরালী গ্রামে ভেসে গিয়েছে সেতু। ছবি: পিটিআই।

হিমাচলে গত কয়েক বছর ধরেই দুর্যোগের চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। অতিবৃষ্টির জেরে রাজ্যের জায়গায় জায়গায় ধস নামছে। ধসপ্রবণ এলাকার সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে। আর এর জন্য বিজ্ঞানীরা দায়ী করছেন, অনিয়ন্ত্রিত ভাবে নির্মাণকাজকে। তার সঙ্গে অতিবৃষ্টিও জুড়েছে। এ বছরে বর্ষার মরসুমে এখনও পর্যন্ত রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হল মন্ডী, কুলু, মানালি এবং উনা। এ ছাড়াও শিমলা-সহ বেশ কয়েকটি জেলাতেও প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও ধস, হড়পা বান হচ্ছে। আবহবিদেরা বলছেন, হিমাচলে গড় বৃষ্টির তুলনায় বর্ষণের মাত্রা বেড়েছে। গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় এখনও পর্যন্ত ১১ শতাংশ বেশি বর্ষণ হয়েছে। ৩৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টি স্বাভাবিক, কিন্তু এখনও পর্যন্ত ৪৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। শিমলা, মন্ডী, কুলু এবং উনায় স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টি বেশি হয়েছে এ বছর। মন্ডীতে ৫৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। শিমলায় ৬২ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কুলুতে ৪৩ শতাংশে বেশি এবং উনায় ৪৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিরিক্ত বৃষ্টির জেরে ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ বাড়ছে। তার জেরে ধসের প্রবণতাও বাড়ছে। নদীগুলিতে জলের পরিমাণ বড়তে থাকায় দুর্যোগকে আরও ঘোরালো করে তুলছে। হিমালয় অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি কারণেই এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বাড়ছে। ‘ডাউন টু আর্থ’কে জম্মু সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অফ লাইফ সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক সুনীল ধর জানিয়েছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনই বৃষ্টির ধরনকে বদলে দিচ্ছে এবং হড়পা বানের মতো ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। তিনি জানিয়েছেন, হিমাচলের গড় তাপমাত্রা গত ২৫ বছরের তুলনায় এ বছর সবচেয়ে বেশি। গরম হাওয়া পাহাড়ি ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে মিশে হঠাৎ এবং ভারী বৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

হিমাচলের মন্ডী।

হিমাচলের মন্ডী। ছবি: পিটিআই।

হিমাচলের পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। তাদের পর্যবেক্ষণ, সেই দিন আর বেশি দূরে নেই, যে দিন দেশের মানচিত্র থেকে মুছে যাবে হিমালয় অঞ্চলের এই রাজ্য। আদালতের আরও পর্যবেক্ষণ, হিমাচলে দুর্যোগের জন্য শুধু প্রকৃতিকে দোষ দেওয়া ঠিক নয়। এই দুর্যোগের জন্য দায়ী মানুষ। তাই কোনও উন্নয়নমূলক কাজের আগে ভূতত্ত্ববিদ, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয়দের মতামত নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

cloudburst Flashflood Himalaya Uttarakhand himachal pradesh Jammu and Kashmir
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy