Advertisement
০১ মে ২০২৪

অসহিষ্ণুতা কি শীতেও অচল রাখবে সংসদ

সংসদের বাদল অধিবেশনের গোটাটাই প্রায় জলে গিয়েছে ললিত-কাণ্ড নিয়ে চাপানউতোরে। আগামী শীত অধিবেশনও কি যাবে শীতঘুমে! দেশে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরিতে শাসকের ভূমিকা নিয়ে বিরোধীরা যে রকম মুখর হয়ে উঠেছেন, তাতেই সংসদে ফের অচলাবস্থার মেঘ দেখছে রাজনৈতিক দলগুলি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:১০
Share: Save:

সংসদের বাদল অধিবেশনের গোটাটাই প্রায় জলে গিয়েছে ললিত-কাণ্ড নিয়ে চাপানউতোরে। আগামী শীত অধিবেশনও কি যাবে শীতঘুমে! দেশে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরিতে শাসকের ভূমিকা নিয়ে বিরোধীরা যে রকম মুখর হয়ে উঠেছেন, তাতেই সংসদে ফের অচলাবস্থার মেঘ দেখছে রাজনৈতিক দলগুলি।

খোদ রাষ্ট্রপতিও এ নিয়ে চিন্তিত। কারণ, দীর্ঘমেয়াদে এতে সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষতিই হচ্ছে। কংগ্রেসের একটি সূত্রের খবর, গত পরশু সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে এই প্রসঙ্গ উঠলে ফের তিনি সংসদ অচল করার পথে না হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কাঠগড়ায় তুলে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড আজ যে বার্তা দিয়েছে তাতে এই সন্দেহ জোরদার হয়ে উঠেছে যে, রাজনীতির আশু প্রয়োজনই হয়তো বেশি গুরুত্ব পেতে চলেছে শীতকালীন অধিবেশনেও।

বিহার ভোট মেটার সপ্তাহ দুই পরেই সংসদের অধিবেশন বসার কথা। সরকারের মাথারা এখন থেকেই বার্তা দিচ্ছেন, সহযোগিতা ও আলোচনার পথেই তাঁরা সংসদ চালাতে চান। কংগ্রেস কিন্তু গোড়াতেই বল ঠেলে দিয়েছে সরকারের কোর্টে। তাদের সাফ কথা, সরকার অসহিষ্ণুতায় লাগাম না পরালে ও দেশে স্বাভাবিক অবস্থা না ফিরলে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার প্রশ্নই নেই।

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি কাল বলেছিলেন, এ যাত্রায় পণ্য পরিষেবা বিল পাশ করাতে প্রয়োজনে রাহুল গাঁধীর সঙ্গেও তিনি আলোচনায় প্রস্তুত। কিন্তু আজ কংগ্রেস জানিয়ে দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আগে সরকার ও শাসক দলের নেতাদের অসহিষ্ণু মন্তব্যে রাশ টানুন। নিজে বিরোধীদের উদ্দেশে কুমন্তব্য করা থেকে সংযত হোন। নয়তো সহযোগিতার আশা করা বৃথা।

এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রাজ্যসভায় কংগ্রেস উপ-দলনেতা আনন্দ শর্মা আজ মনে করিয়ে দেন, শাসক ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে গঠনমূলক সহযোগিতার বিষয়টি কেবল একটি বিল পাশের মতো ক্ষুদ্র পরিধিতে সীমিত নয়। সংসদীয় ব্যবস্থার তা অন্যতম স্তম্ভ। আনন্দ শর্মার কথায়, ‘‘আলোচনার জন্যও চাই সহিষ্ণু পরিবেশ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজেই পরিবেশ বিষিয়ে দিচ্ছেন সীমাহীন ঔদ্ধত্যে। তথৈবচ অরুণ জেটলি। এই যুগল এতটাই অসহিষ্ণু যে, সাধারণ মানুষের অসন্তোষ প্রকাশের মধ্যেও তাঁরা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র খুঁজছেন!’’

আনন্দর আরও অভিযোগ, ঘরোয়া রাজনীতিতে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজনই বোধ করেন না প্রধানমন্ত্রী। উল্টে রাজনৈতিক সৌজন্য জলাঞ্জলি দিয়ে দেশে বটেই, বিদেশ সফরে গিয়েও তিনি বিরোধীদের নিশানা করেন। ‘‘এর পরেও কি সহযোগিতা সম্ভব?’’ প্রশ্ন আনন্দ শর্মার।

দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতার আবহে গত কয়েক দিন ধরেই আশঙ্কা দানা বাধছিল যে বিরোধীরা হয়তো এ বার সংসদের শীতকালীন অধিবেশন চলতেই দেবেন না। তা ছাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশছোঁয়া দাম ও আর্থিক ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়গুলি তো রয়েছেই। পাশাপাশি নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে চলেছে বিহার ভোটের ফলও। বিহারে বিজেপি পর্যুদস্ত হলে আরও উজ্জীবিত হবে কংগ্রেস, বাম-সহ বিরোধী দলগুলি।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সংসদ অচল করে রাখলেই কি রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হবে কংগ্রেস? দলে কি এর কোনও বিরুদ্ধমত নেই!

কংগ্রেসের একটি সূত্রের মতে, আসলে সংসদ অচল করা নিয়ে দোটানায় রয়েছে দল। অতীতে ইউপিএ জমানায় অধিবেশনের পর অধিবেশন অচল করে রেখেছিল বিজেপি। কিন্তু সেই নজির থাকলেও দলের প্রবীণ নেতাদের অনেকেই মনে করেন, সময় বদলেছে। সংসদ একটানা অচল করে রাখলে রাজনৈতিক ভাবে তা কংগ্রেস সম্পর্কে ভাল বার্তা দেবে না। কংগ্রেসের এক বর্ষীয়ান নেতা জানান, গত পরশু রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সনিয়া গাঁধীর একান্ত বৈঠকেও এই প্রসঙ্গ উঠেছিল। কংগ্রেস যাতে সংসদ অচল করে না রাখে, সে জন্য সনিয়াকে ফের পরামর্শ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। কংগ্রেস সভানেত্রীকে তিনি বলেছেন, এতে সামগ্রিক ভাবে সংসদীয় ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে। এমনকী, সনিয়াকে প্রণববাবু এ-ও বলেছেন, অতীতে কংগ্রেসের রাজনীতিতে থাকার সময়েও এ ব্যাপারে বারবার তিনি সওয়াল করেছেন। কমলনাথরা সংসদ অচল করে রাখার পক্ষে মত দিলে তিনি রেগে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। দিগ্বিজয় সিংহের মতো কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারাও সংসদ সচল রাখার পক্ষেই মত দিচ্ছেন।

কিন্তু উল্টো মতও রয়েছে দলের অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের মধ্যে। তাঁদের মতে, সংসদ অচল করে সরকারকে আরও বিপন্ন করে দেওয়াটাই রাজনীতির দাবি। তা ছাড়া খোদ প্রধানমন্ত্রীই সংসদে উপস্থিত থাকেন না। আগে লোকসভার নেতা হিসেবে প্রণববাবু যেমন নিয়ম করে সুষমা স্বরাজ, জেটলিদের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতেন— সেই শিষ্টাচারও বিজেপির নেই। এর পরেও সংসদ সচল রেখে সরকারকে সুবিধা করে দিয়ে কংগ্রেসের কী লাভ?

কিন্তু সংসদ অচল করে রাখলে তার দায়ও তো নিতে হবে! কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য সেই দায় আগেভাগেই বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল নিয়েছেন। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী আগে বিনীত হয়ে বিরোধীদের সঙ্গে কথা বলুন। আলোচনার আবহ তৈরি করুন। তা না করলে সংসদও সুষ্ঠু ভাবে চলা সম্ভব নয়। এবং সরকারকে এই বার্তা দিতেই আজ আনন্দ শর্মা বলেন, ‘‘সংঘাতের মনোভাব ছেড়ে বিরোধীদের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার প্রকৃত চেষ্টা করুন জেটলি। সংবাদমাধ্যমে প্রস্তাব দিয়ে আলোচনা হয় না। বরং সেই সম্ভাবনাটাই ঘেঁটে দেওয়া হয়।’’

কংগ্রেস নেতাদের ধারণা, এই কৌশল নিলে দু’দিকেই লাভ।

এক, এতে প্রধানমন্ত্রীকে নরম অবস্থান নিতে বাধ্য করিয়ে তাঁর ঔদ্ধত্য চুরমার করে দেওয়া যাবে।

দুই, প্রধানমন্ত্রী যদি নরম না হয়ে পাল্টা আক্রমণ শানিয়ে যান, তবে সংসদ অচল করে রাখার পক্ষে যুক্তি থাকবে কংগ্রেসের কাছে। সংসদ অচল করে রাখার দাগ লাগবে না।

পছন্দটা মোদী-জেটলির!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE