Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অপরাধ হবে না আত্মহত্যার চেষ্টা

স্বেচ্ছা-মৃত্যুর অধিকার না-দিক, আত্মহত্যাকে অপরাধের তকমা থেকে অন্তত বের করতে চলেছে কেন্দ্র। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যার চেষ্টা দণ্ডনীয় অপরাধ। এতে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। এই ধারাটিই বিলোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। বুধবার রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে সরকারের এই অভিপ্রায় জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হরিভাই চৌধুরী। খুব শীঘ্রই সংসদে প্রয়োজনীয় সংশোধনী বিলটি আনবে মন্ত্রক। কেন্দ্রীয় আইন কমিশন ইতিমধ্যেই তার সুপারিশ জানিয়েছে কেন্দ্রকে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:২২
Share: Save:

স্বেচ্ছা-মৃত্যুর অধিকার না-দিক, আত্মহত্যাকে অপরাধের তকমা থেকে অন্তত বের করতে চলেছে কেন্দ্র। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যার চেষ্টা দণ্ডনীয় অপরাধ। এতে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। এই ধারাটিই বিলোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র।

বুধবার রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে সরকারের এই অভিপ্রায় জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হরিভাই চৌধুরী। খুব শীঘ্রই সংসদে প্রয়োজনীয় সংশোধনী বিলটি আনবে মন্ত্রক। কেন্দ্রীয় আইন কমিশন ইতিমধ্যেই তার সুপারিশ জানিয়েছে কেন্দ্রকে। রাজ্যগুলিও তাদের মতামত দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশের ১৮টি রাজ্য ও চারটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল এই ধারা বিলোপের ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছে। আর তার ভিত্তিতেই মন্ত্রক সংশ্লিষ্ট সংশোধনী বিলটি তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছে।

অর্থাৎ? ‘জাগিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম অবিরাম ভার’ যদি কারও কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে, অদূর ভবিষ্যতে তাঁকে অন্তত ‘অপরাধী’ বলে জেলে পুরতে পারবে না রাষ্ট্র। তবে কেউ যদি কাউকে আত্মঘাতী হতে উৎসাহিত করে বা মানসিক-শারীরিক নির্যাতন করে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়, তাকে কিন্তু ‘প্ররোচনা’র দায়ে কঠোর শাস্তি পেতেই হবে। অর্থাৎ দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারার কিন্তু কোনও নড়চড় হবে না বলেই সুপারিশ করা হয়েছে।

মানবাধিকারকর্মী, চিকিৎসক এবং আইনজ্ঞদের বড় অংশই এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বলছেন, মানসিক বা শারীরিক ভাবে বিপর্যস্ত ব্যক্তিই আত্মহত্যার কথা ভাবেন। আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে সেই বিপর্যস্ত মানুষটিকেই শাস্তি দেওয়াটা অত্যন্ত অমানবিক প্রথা। আইন কমিশনেরও বক্তব্য: যখন কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন, তখন তাঁকে সেই ব্যর্থতার সাজা দেওয়া রাষ্ট্রের তরফে চরম অযৌক্তিক ও নিষ্ঠুর পদক্ষেপ।

৩০৯ বিলোপের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেই কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই দণ্ডবিধি অনেক আগেই তুলে দেওয়া উচিত ছিল। এই দণ্ডবিধি থাকা আর আমিআমার সম্পত্তি বিক্রি করতে পারব না বলা, একই কথা।” আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের কথায়, “দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, নিজের কলম ভেঙে ফেলতে কারও অনুমতি না লাগলে নিজের জীবন শেষ করতে অসুবিধা কীসের। দেরিতে হলেও এই সিদ্ধান্ত স্বাগত।”

পৃথিবীর বহু দেশ ইতিমধ্যেই আত্মহত্যাকে ‘অপরাধ’-এর তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। নেদারল্যান্ডস, সুইৎজারল্যান্ডের মতো কিছু দেশ স্বেচ্ছা-মৃত্যুর অধিকারকেও স্বীকৃতি দিয়েছে। সামগ্রিক ভাবেই মরণের অধিকারকে মৌলিক মানবাধিকার বলে গণ্য করা উচিত কি না, তা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে তর্কবিতর্ক চলছে। ভারতেও আত্মহননের চেষ্টাকে অপরাধ বলে দেগে দেওয়া উচিত কি না, এই নিয়ে বিতর্ক বহু পুরনো। ১৯৭১ সালে তার ৪২তম রিপোর্টেই ৩০৯ ধারা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল আইন কমিশন। সাত বছর পর ১৯৭৮ সালে কমিশনের সুপারিশ মেনেও নেয় তৎকালীন জনতা পার্টি সরকার। তৈরি হয় ভারতীয় দণ্ডবিধি (সংশোধনী) বিল, ১৯৭৮। ওই বছরই ৩০৯ ধারা বিলোপের সেই বিলে অনুমোদনের সিলমোহরও দেয় রাজ্যসভা। কিন্তু বিলটি লোকসভায় পেশ করার আগেই ভেঙে যায় জনতা সরকার। রাজ্যসভার অনুমোদিত বিলটিও খারিজ হয়ে যায়।

তার পরে দীর্ঘ দু’দশকের বিরতি। ১৯৯৭ সালে ১৫৬ তম রিপোর্টে কমিশন ফের একই সুপারিশ করে। তারও এক দশক পরে, ২০০৮ সালের অক্টোবরে কমিশন তাদের ২১০ তম রিপোর্টে আরও নির্দিষ্ট ভাবে ৩০৯ খারিজের সুপারিশ করে। রিপোর্টটি জমা পড়ে আইনমন্ত্রী হংসরাজ ভরদ্বাজের কাছে। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার এই সুপারিশ নিয়ে আলোচনার পর ঠিক করে, যে হেতু আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের অধিকারভুক্ত বিষয়, সেই কারণে এ ব্যাপারে রাজ্যগুলির মতামত নেওয়া হবে। সেই মতামতই এসে পৌঁছেছে এবং তার ভিত্তিতেই এ বার পদক্ষেপ করছে কেন্দ্র।

গত বছর রাজ্যসভায় যে ‘মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা বিল, ২০১৩’ বিল পেশ হয়, তাতেও এই পথ-নির্দেশই ছিল। ওই বিলে নির্দিষ্ট করে বলা হয়, অন্য উদ্দেশ্যের প্রমাণ না থাকলে আত্মহত্যার ইচ্ছাকে মানসিক অসুস্থতা বলেই গণ্য করতে হবে। ৩০৯ ধারায় তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।

স্বাস্থ্য মন্ত্রকের আনা এই বিল নিয়ে আলোচনার সময়েই সরকার জানিয়েছিল, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারা বিলোপের ব্যাপারে সংশোধনী আনার কথা ভাবা হচ্ছে। বর্তমান সরকারের উদ্যোগ তারই ফল। গত কয়েক বছরে রোগযন্ত্রণা থেকে স্বেচ্ছা-মুক্তি বা নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অধিকার থাকা উচিত কিনা, তা নিয়েও বহু আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ৩০৯ ধারাটি সেখানেও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে। ৩০৯ ধারা বিলোপ হলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নিষ্কৃতি-মৃত্যুর অধিকার মিলবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছে।

বিরুদ্ধ মতও যে নেই, তা নয়। কমিশনের কাছে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, শাস্তি তুলে দিলে আত্মহত্যার হার বেড়ে যেতে পারে। ভারতে আত্মহত্যার চল যথেষ্ট বেশি। ২০১২-র জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র তথ্য অনুযায়ী, সে বছর দেশে এক লক্ষ ৩৫ হাজার ৪৪৫ জন আত্মঘাতী হন। ২০১২-র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষাতেও আত্মহত্যাপ্রবণ দেশগুলির মধ্যে ভারতের স্থান ছিল প্রথম সারিতেই। তবে এর বিরুদ্ধ যুক্তি হিসেবে মনোবিদ-আইনজীবী-সমাজবিজ্ঞানীরা কমিশনকে বলেছেন, আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার সময় মানুষ ৩০৯-এর কথা ভাবে না। যাঁরা আত্মহত্যায় সফল, তাঁরা যখন আইনের ঊর্ধ্বে, ব্যর্থতার জন্য শাস্তি বরাদ্দ হবে কেন? এ তো জীবিত থাকার জন্য শাস্তি পাওয়ার সামিল!

কমিশন মনে করে, মানসিক ভাবে অসুখী মানুষটির চিকিৎসা ও যত্নের প্রয়োজন। তার বাঁচার ইচ্ছা ফিরিয়ে আনাটাই সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবারের কর্তব্য। তাকে জেলে পাঠানোটা কোনও ভাবেই কাম্য নয়। কমিশন বরং মনে করছে, এই ধারার বিলোপ আত্মহত্যায় ব্যর্থ বহু মানুষকে নতুন করে বাঁচতে সাহায্য করবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE