উদ্ধারের পথ এখনও মেলেনি। তবে ইরাকের মসুল থেকে অপহৃত ৪০ জন ভারতীয় শ্রমিককে কোন এলাকায় রাখা হয়েছে, তা জানা গিয়েছে বলে দাবি করল বিদেশ মন্ত্রক। এ বিষয়ে অবশ্য বিস্তারিত জানায়নি দিল্লি। কূটনৈতিক সূত্রে খবর, নানা বন্ধু রাষ্ট্রের সাহায্যে অপহৃতদের ফেরানোর মরিয়া চেষ্টা জারি রয়েছে। বিশেষত ইজরায়েল বড় ভরসা দিল্লির। অপহৃতদের ফেরানোর ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপের আর্জি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়েছেন সনিয়া গাঁধী। জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে কূটনৈতিক ভাবে কংগ্রেসও সরকারকে সাধ্যমতো সাহায্য করবে।
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি অল-মালিকির বিরোধী আল-কায়দাপন্থী আইএসআইএস জঙ্গিরাই ওই অপহরণের নেপথ্যে রয়েছে বলে মনে করছে কেন্দ্র। আজ বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, “সরকার সব রকম চেষ্টা করছে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে।” অপহৃতদের অন্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরুদ্দিন। অপহৃত কয়েক জনের আত্মীয় আজ বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। এক শ্রমিকের দিদি, অমৃতসরের কাছে মাঝিতা গ্রামের বাসিন্দা গুরপিন্দর কৌর জানান, দিন দুয়েক আগে তাঁর ভাই বাড়িতে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, জঙ্গিরা তাঁদের যত্নে রেখেছে। প্রাণের ভয় নেই। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র যদিও সেই কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, “বন্দি অবস্থায় যত্নে রাখার কোনও প্রশ্নই উঠছে না।”
ঠিক এইখানেই পঞ্জাবের মাঝিতা-র সঙ্গে মিলে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া। কেউ অপহৃত হননি ঠিকই, কিন্তু কর্মসূত্রে ইরাকে গিয়ে আটকে পড়েছেন সংঘর্ষে। অনেকের সঙ্গেই ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এঁরা কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ কাঠের মিস্ত্রি। কেউ বা হোটেলে কাজ করেন। থাকা-খাওয়ার খরচ দেয় অফিস। তাই বাড়িতে মোটা টাকা পাঠানোর জন্য প্রতি বছর তাঁরা পাড়ি দেন পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। তেমনই কিছু কিছু বাঙালির পরিবারের এখন দিন কাটছে গভীর উদ্বেগে।
রবিবার মিনিট খানেকের জন্য তেহট্টের বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম ইলসেমারির বাড়িতে ফোন করেছিলেন খোকন শিকদার। স্ত্রী নমিতাদেবী জানালেন, ফোনে স্পষ্ট গুলি-বোমার শব্দ পেয়েছেন তাঁরা। ভয়ার্ত গলায় খোকনবাবু বলেছিলেন, “কী জানি, হয়তো আর কোনও দিন তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না।” এখন আর ফোনে সাড়া মিলছে না তাঁর।
বছর আড়াই আগে কাঠের মিস্ত্রির কাজ নিয়ে মসুলে গিয়েছিলেন সমর টিকাদার। বাড়ি চাপড়ার সীমান্ত-লাগোয়া এলাকা মহখোলায়। রবিবার রাতে তিনিও বাড়িতে ফোন করে বলেছিলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেরার চেষ্টা করবেন। কিন্তু বুধবার রাত থেকে ফোন বন্ধ। সমরবাবুর স্ত্রী দীপালিদেবী বললেন, “কিছুই বুঝতে পারছি না। কোন খবরটা বিশ্বাস করব বলতে পারেন?”
খোকন শিকদার
বিদেশে যাঁরা কাজের ব্যবস্থা করে দেন, তেমনই এক এজেন্ট বগুলার সমর বিশ্বাস। তাঁর মধ্যস্থতায় ইরাকে কাজ করতে গিয়েছেন ৮ জন। এঁদের কারও কারও সঙ্গে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সমরবাবু। তাঁর কথায়, “লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় দিল্লিতে পড়ে থেকে অনেক কষ্টে সকলকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলাম। বিদেশ মন্ত্রক সে বার
খুব সাহায্য করেছিল। আশা করছি এ বারও তেমনটাই হবে।” সমরবাবু জানালেন, তাঁর লোকেরা আছেন উপকূলবর্তী বসরা এলাকায়। সেখানে বিপদ এখনও কম। কারণ, গণ্ডগোল হচ্ছে বসরা থেকে প্রায় চার-পাঁচশো কিলোমিটার দূরে।
নদিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি তৃণমূলের বাণীকুমার রায় জানান, জেলা থেকে ঠিক কত জন এখন ইরাকে আছেন তা তাঁদের জানা নেই। তিনি বলেন, “যাঁরা ইরাকে গিয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে অনুরোধ করছি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।” বাণীকুমার জানান, জেলার সাংসদ ও রাজ্য সরকারের মাধ্যমে ইরাকের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করে সকলকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। একই কথা বলেছেন জেলাশাসক পি বি সালিম।
দিল্লি অবশ্য ইতিমধ্যেই ইরাকে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত সুরেশ রেড্ডিকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে ফের সে দেশে পাঠিয়েছে। আজই সাউথ ব্লকে দু’বার ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ’-এর বৈঠক বসে। তাতে বিদেশমন্ত্রী ছাড়াও হাজির ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। পরে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদলের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকও করেন সুষমা। অপহৃতদের উদ্ধারের ব্যাপারে মালিকি সরকারের পাশাপাশি বেশ কিছু দেশের সঙ্গে আলোচনা করছে নয়াদিল্লি। তারই অন্যতম ইজরায়েল।
মুসলিম মৌলবাদের সঙ্গে ইজরায়েলের সংঘর্ষের ইতিহাস বহু পুরনো। আজও সেই লড়াই থামেনি। সম্প্রতি প্যালেস্তাইনে ছ’জন ইজরায়েলি তরুণকে অপহরণ করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী হামাস। ইজরায়েলি দূতাবাস সূত্রের বক্তব্য, ইরাক বা তার আশপাশের অঞ্চলে ইজরায়েলের কোনও উপস্থিতি নেই ঠিকই। কিন্তু জঙ্গি গোষ্ঠীর হাতে নিজেদের নাগরিকের অপহৃত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রচুর। সেই অভিজ্ঞতা দিয়েই নয়াদিল্লিকে সাহায্য করতে চান ইজরায়েলি কর্তারা।
ফিরে এসো বাবা। বাবার ছবি হাতে ছোট্ট দিভমের আর্তি। ইরাকে ৪০ জন অপহৃতদের মধ্যে তিন বছরের দিভমের বাবাও এক জন। বৃহস্পতিবার জম্মুতে। ছবি: এএফপি।
কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, ২৬/১১-র হামলার সময়ে ভারতকে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল ইজরায়েল। তখন সে দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উচ্চ পদে ছিলেন আলোন উশপিজ। সম্প্রতি দিল্লিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে ইজরায়েলে ফিরে গিয়েছেন তিনি। এখন উশপিজের পরামর্শ দিল্লির কাছে অত্যন্ত মূল্যবান হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। দিল্লি ছাড়ার আগে আনন্দবাজারকে উশপিজ বলেছিলেন, “২৬/১১-এর হামলার সময় ভারতের পাশে ছিল ইজরায়েল। আমাদেরও একই ভাবে নানা জায়গায় আক্রান্ত হতে হয়। ফলে আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না, ভারত কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।” সন্ত্রাসবাদ দমনে অংশীদারিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়ে প্রযুক্তিগত, প্রশিক্ষণগত ও অনুসন্ধানে সহায়তা সংক্রান্ত সহযোগিতার উপরে জোর দিয়েছিলেন উশপিজ। নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রতি আস্থা রেখে বলেছিলেন, “কোনও সন্দেহ নেই যে এই সরকার, বিশেষত মোদীর সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ।” দু’বছর আগে দিল্লিতেই সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিল ইজরায়েল। তার পিছনে ইরান সরকারের মদত ছিল বলে দাবি করে তারা। এই সন্ত্রাসের ষড়যন্ত্রীদের দাম চোকাতে হবে বলে সাফ জানিয়েছিলেন উশপিজ। এ হেন ইজরায়েলের সাহায্য পেতে উৎসাহী ভারতও।
তবে কূটনৈতিক সূত্রের খবর, ইজরায়েলের পাশাপাশি আইএসআইএস জঙ্গিদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারবে, এমন দেশগুলির সঙ্গেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। যেমন, কাতার ও সৌদি আরব। সুন্নি মুসলিম মৌলবাদের সঙ্গে সৌদি আরবের যোগাযোগের অভিযোগ নতুন নয়। তারা আইএসআইএসের সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে কি না তা খতিয়ে দেখছে কেন্দ্র। যোগাযোগ রাখা হচ্ছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও।
তথ্য সহায়তা: কল্লোল প্রামাণিক