Advertisement
E-Paper

চৌত্রিশ বছর পর বাড়ি ফিরে ফের প্রস্থান গৃহকর্তার

৩৪ বছর অজ্ঞাতবাসের পর ‘গৃহকর্তা’ ফিরলেন ছেড়ে আসা ঘরে। কিন্তু পারিবারিক মিলনের মেয়াদ ২৪ ঘণ্টাও পেরোল না। স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ও গ্রামবাসীদের শেষ বারের মতো কাঁদিয়ে ফের ‘অজ্ঞাতবাসে’ গেলেন বৃদ্ধ নরেশ্বর। স্ত্রীর উপরে গোঁসা করে নগাঁওয়ের চাপড়মুখের বাসিন্দা নরেশ্বর ওরফে হরেন নাথ ওরফে নকুয়া ঘর ছাড়েন সেই ১৯৮০ সালে। ৩৪ বছর পর ঘরের টানে ফের ফিরে এসেছিলেন এই বৃহস্পতিবার। বৈধব্য মেনে নেওয়া স্ত্রী মঙলি দেবী স্বামীকে জলজ্যান্ত চোখের সামনে দেখে রুদ্ধবাক!

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৪১

৩৪ বছর অজ্ঞাতবাসের পর ‘গৃহকর্তা’ ফিরলেন ছেড়ে আসা ঘরে। কিন্তু পারিবারিক মিলনের মেয়াদ ২৪ ঘণ্টাও পেরোল না। স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ও গ্রামবাসীদের শেষ বারের মতো কাঁদিয়ে ফের ‘অজ্ঞাতবাসে’ গেলেন বৃদ্ধ নরেশ্বর।

স্ত্রীর উপরে গোঁসা করে নগাঁওয়ের চাপড়মুখের বাসিন্দা নরেশ্বর ওরফে হরেন নাথ ওরফে নকুয়া ঘর ছাড়েন সেই ১৯৮০ সালে। ৩৪ বছর পর ঘরের টানে ফের ফিরে এসেছিলেন এই বৃহস্পতিবার। বৈধব্য মেনে নেওয়া স্ত্রী মঙলি দেবী স্বামীকে জলজ্যান্ত চোখের সামনে দেখে রুদ্ধবাক! দুই পুত্র তাঁদের অতিশৈশবে হারানো বাবাকে ফিরে পেয়ে পাগলপারা! গ্রামে শোরগোল, বাজারে হইচই! সিদ্ধান্ত হল, রাত কাটলে ফের স্বামীর হাতে সিঁদুর পরবেন মঙলিদেবী। কিন্তু পরের দিন স্ত্রীকে সিঁদুর পরাবার আগেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন নরেশ্বর। উৎসবের আবহ মিলিয়ে গেল শ্মশান-যাত্রার কান্নায়।

বৃহস্পতিবার আর পাঁচদিনের মতোই হাজিরার কাজে বের হন চাপড়মুখ গাছপাড়ার বাসিন্দা ধনেশ্বর নাথ। লোকের বাড়ি রং করার কাজে বের হন ভাই ধর্মেশ্বর নাথ। সকাল গড়িয়ে যখন প্রায় দুপুর, ধর্মেশ্বরের অটোচালক বন্ধু অশোকের চোখে পড়ল পারঘাটে এক বৃদ্ধ পুঁটলি নিয়ে বসে। অশোকবাবু ও অন্য এক যুবক তাঁর নাম জানতে চান। জানতে চান গন্তব্য। বৃদ্ধ কেবলই বলেন, ‘‘টাকা নেই। বাড়ি যাব।’’ অশোকবাবু বলেন, “অতি কষ্টে দাদু বললেন গাছপাড়ায় তাঁর বাড়ি। জানতাম, গাছপাড়ার ধর্মেশ্বরের বাবা নকুয়াকাকা অনেকদিন ধরে নিখোঁজ। সঙ্গে সঙ্গে ধর্মেশ্বরের বাড়িতে খবর পাঠাই। দাদুকে দোকানে চা-বিস্কুট খাইয়ে অটোয় ওঠাই।”

‘বাবা এসেছেন’ খবর পেয়ে ধর্মেশ্বর যে বাড়িতে রং করছিলেন সেই বাড়ির মালিকের সাইকেল নিয়েই ঊর্দ্ধশ্বাসে রওনা হন। তাঁর কথায়, “বাবা যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তখন আমার ২ বছর বয়স।” ‘বাপ পালিয়েছে’ বলে সারা জীবন লোকের খোঁটা শুনতে হয়েছে। তাঁর কথায়, “সেই বাবা সত্যি ফিরে এসেছেন, ভাবতেই পারছিলাম না। পারঘাটে গিয়ে বাবাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরি। তিনি ভাল করে কথা বলতে পারছিলেন না। দু’জনেই কেঁদে ফেলি। বাড়ি আসার পরেও বাবা বাড়ি চিনতে পারছিলেন না। আমি বোঝাই, যে গ্রাম আর বাড়ি তিনি ৩৪ বছর আগে ছেড়ে গিয়েছিলেন তা অনেক বদলে গিয়েছে। এটাই সেই বাড়ি। বাবা জানতে চান, তাঁর বাঁশগাছ, নারকেল গাছগুলো আছে কী না? সে সব আছে জেনে নিশ্চিন্ত হন।”

নরেশ্বরবাবুর স্ত্রী মঙলি দেবী বললেন, “তখন চাল বাছছিলাম। বউমা বলে, মানুষটা নাকি ফেরত এসেছে। শুনে বিশ্বাসই হয়নি। দুই ছেলে বাড়ি নেই। একটু পরেই ছোট ছেলের সঙ্গে অটো থেকে মানুষটা বাড়ির সামনে নামল। হাসব না কাঁদব, না অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাব তাই ভাবছিলাম।” আরও বলেন, “স্বামীর সামনে গিয়ে প্রথমে জানতে চাইলাম, কী দোষ ছিল আমাদের? কেন এতদিন আসনি? সে শুধু বলল, “সব দোষ আমার। ক্ষমা করে দাও।” এরপর রাগ করে থাকা যায়? পরের সময়টা স্বপ্নের মতো কাটল নাথ পরিবারের। গোটা গ্রাম ভেঙে পড়ল বাড়িতে। কত আনন্দ, কত গল্প! ঠিক হল, সাদা শাড়ি, সাদা সিঁথি আর নয়। পরের দিন স্বামীর হাতেই ফের এয়ো হবেন মঙলি দেবী। সিঁদুর উঠবে মাথায়। বড় ছেলে ধনেশ্বর জানান, “বাবা যাওয়ার সময় আমি প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। এতদিন পরে ফিরে আসা মানুষটার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। কেবল বলে, এতদিন নাগাল্যান্ডের কোহিমায় ছিল।”

শুক্রবার নাথ বাড়িতে উৎসবের পরিবেশ। সকালে বাবা-মার সঙ্গে চা-জলখাবার খেয়ে দুই ছেলে বের হন উদ্যোগ-আয়োজনে। মঙলি দেবী ও নাতনি তখন বাড়িতে। সিঁদুর ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় অধীর মঙলি দেবী নরেশ্বরবাবুকে স্নানে যাওয়ার তাড়া দেন। গরম জলও তৈরি। নাতনি তৈরি তেল মাখাবে বলে। আচমকাই হেলে পড়েন নরেশ্বর। মঙলি দেবী স্বামীকে বিছানায় শুইয়ে দেন। স্ত্রীর কোলে মাথা রেখেই বন্ধ হয়ে যায় শ্বাস। সকালে ‘মিলন’ উৎসবের তোড়জোড় করা গাছপাড়ার বাসিন্দারা সন্ধ্যায় নরেশ্বরবাবুর অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দেন। কেঁদে আকুল মঙলি দেবীর প্রশ্ন, “নিজেকে তো সামলেই নিয়েছিলাম। ফের কাঁদাবে বলে ফিরে এলে?”

rajibaksha rakshit nareshwar guwahati
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy