Advertisement
E-Paper

তিন নেত্রীর মন পেতে চেষ্টা সনিয়ার

সামনে ভোট, জোর লড়াই। সুতরাং রাহুল গাঁধীর ‘একলা চলো’ নীতি আপাতত শিকেয়। শীর্ষ কংগ্রেস নেতাদের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন সনিয়া গাঁধী যে ভাবেই হোক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী ও জয়ললিতার সঙ্গে নতুন করে রাজনৈতিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলুন। সকলেই মনে করছেন, লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী হিসেবনিকেশে এই তিন নেত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছেন।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ ২১:৩৫

সামনে ভোট, জোর লড়াই। সুতরাং রাহুল গাঁধীর ‘একলা চলো’ নীতি আপাতত শিকেয়। শীর্ষ কংগ্রেস নেতাদের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন সনিয়া গাঁধী যে ভাবেই হোক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী ও জয়ললিতার সঙ্গে নতুন করে রাজনৈতিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলুন।

সকলেই মনে করছেন, লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী হিসেবনিকেশে এই তিন নেত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছেন। কিন্তু সনিয়া চাইলেও তাঁরা কি কংগ্রেসের সঙ্গে প্রাক্-নির্বাচনী বোঝাপড়ার পথে হাঁটবেন? অন্তত এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও ইঙ্গিত দিচ্ছেন না তিন নেত্রীর কেউই। তবে কংগ্রেস সূত্রের বক্তব্য, ভোটের আগে না-হোক, ভোটের পরে যাতে প্রয়োজনে ওঁদের সঙ্গে পাওয়া যায়, সে জন্য এখন থেকেই আলোচনার দরজা খুলে রাখা জরুরি।

মমতার সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব বর্তেছে সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেলের উপরে। তিনি এ দিন বলেন, “রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তা ছাড়া, এটা জোট রাজনীতির যুগ। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রোখার জন্য সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একজোট করাটাই কংগ্রেসের অগ্রাধিকার।”

মায়াবতীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব পেয়েছেন সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী রাজীব শুক্ল। গত ১৫ দিনে মায়াবতীর ঘনিষ্ঠ সাংসদ সতীশ মিশ্রের সঙ্গে তিন বার বৈঠক করেছেন তিনি। আবার, কখনও বিজেপি, কখনও বামেদের দিকে হেলে থাকা জয়ললিতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে তিন রাজ্যের রাজ্যপালের মাধ্যমে। কারণ, কংগ্রেস নেতাদের অনেকের সঙ্গেই জয়ার সম্পর্ক মধুর নয়। তবে এই সব দৌত্যে এখনও তেমন সুফল ফলেনি বলেই কংগ্রেস সূত্রের খবর।

পশ্চিমবঙ্গে যেমন তৃণমূল এখনও একলা চলার কথাই বলছে। আজই এবিপি আনন্দকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লোকসভা ভোটে রাজ্যের ৪২টি আসনেই প্রার্থী দেওয়া হবে বলে দাবি করেছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তাঁর কথায়, “আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। কিন্তু কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি ও রাজ্যের প্রতি আর্থিক বঞ্চনার কথাও মানুষ জানেন। ক্ষমতার জন্য বড় দলের লেজুড়বৃত্তি আমাদের অগ্রাধিকার নয়। আমাদের অগ্রাধিকার মা-মাটি-মানুষের স্বার্থ।” তৃণমূলের একটি সূত্র বলছে, ৩০ তারিখ ব্রিগেডের জনসভা থেকেই লোকসভা ভোটে একলা চলার কথা ঘোষণা করে দিতে পারেন মমতা।

তৃণমূলেরই অন্য একটি সূত্র অবশ্য ভোটের আগে সমঝোতার সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছে না। তাদের মতে, কংগ্রেস আগের বার যে ক’টি আসনে জিতেছিল, এ বার শুধু সেই ক’টি আসনে লড়তে রাজি থাকলে জোটের একটা দরজা খোলা থাকছে।

প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব, বিশেষ করে দুই কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী এবং দীপা দাশমুন্সি আবার তৃণমূলের সঙ্গে জোটের ঘোরতর বিরোধী। সম্প্রতি সোমেন মিত্রের কংগ্রেসে যোগদানের মঞ্চে দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অম্বিকা সোনিকে দীপা অনুরোধ করেছিলেন, তৃণমূলের সঙ্গে জোট না-হওয়ার কথা ঘোষণা করে দিতে। অম্বিকা অবশ্য সে দিন স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। কিন্তু দীপা-অধীরের মতে, জোট হলে কংগ্রেসের যত না লাভ, তার থেকে বেশি লাভ হবে তৃণমূলের।

মমতার বিরূপ মনোভাবের উদাহরণ হিসেবে আসন্ন রাজ্যসভা ভোটের প্রসঙ্গও তুলছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা। আগের বার রাজ্যসভার ভোটে প্রার্থী হিসেবে আব্দুল মান্নানের নাম ঘোষণা করেও শেষ মুহূর্তে তুলে নিয়েছিল কংগ্রেস। প্রশস্ত করা হয়েছিল তৃণমূল প্রার্থীর জয়ের পথ। তখন ঠিক হয়েছিল, পরের বার কংগ্রেসকে একটি আসন ছাড়বে তৃণমূল। এখন তৃণমূলের সঙ্গে জোট না-থাকলেও সেই সৌজন্যের প্রতিদান প্রত্যাশা করছিলেন কংগ্রেস নেতারা। কিন্তু মমতা রাজ্যসভার চতুর্থ আসনেও প্রার্থী দিয়েছেন।

প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের একটা অংশ বলছেন, মমতার এই অবস্থান সত্ত্বেও হাইকম্যান্ডের নির্দেশে যদি জোট হয়, তা হলে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কের সহায়তায় তৃণমূলের আসন বাড়বে। আর সেই বাড়তি আসনের জোরে মমতা যে বিজেপি-র সঙ্গে দর কষাকষি করে তাদের দিকে চলে যাবেন না, তার নিশ্চয়তা কী!

এখনও পর্যন্ত অবশ্য বিজেপি-র সঙ্গেও তৃণমূলের সমঝোতার কোনও ইঙ্গিত নেই। বরং হাওড়া লোকসভা ভোটে জাতীয় সভাপতি রাজনাথ সিংহের নির্দেশে প্রার্থী না-দেওয়া বিজেপি এখন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের লাইন মেনে মমতার কড়া সমালোচনায় সরব। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘও মনে করছে, রাজ্যে ভোট বাড়াতে গেলে শুধু সিপিএম নয়, বিজেপি-কে তৃণমূলের বিরোধিতাও করতে হবে। তবে নরেন্দ্র মোদী এখনও মমতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অরুণ জেটলিও মমতাকে পুরোপুরি চটানোর পক্ষে নন।

পশ্চিমবঙ্গের মতো জোটের ছবি অনিশ্চিত উত্তরপ্রদেশেও। রাজীব শুক্ল লেগে থাকলেও মায়াবতী জোট নিয়ে এখনও কোনও ইঙ্গিত দেননি। বরং জোট না-করার পক্ষে তাঁর দু’টি জোরালো যুক্তি রয়েছে। প্রথমত, তাঁর রাজনৈতিক গুরু কাঁসিরামের বারণ। কাঁসিরাম দলিত নেত্রীকে উপদেশ দিয়েছিলেন, প্রয়োজনে বিজেপি-র সঙ্গে সমঝোতা করতে পারো, কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে নয়। কারণ, বিএসপি-র দলিত ভোট কিছুতেই বর্ণহিন্দুর প্রতিভূ বিজেপি-র দিকে স্থায়ী ভাবে চলে যাবে না। কিন্তু কংগ্রেস থেকেই দলিত ভোট বিএসপি-তে এসেছে। ফলে তাদের সঙ্গে জোট হলে সেই দলিত ভোট ক্রমশ কংগ্রেস ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। দ্বিতীয় যুক্তি, সমস্ত প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষার ইঙ্গিত যখন বলছে, কংগ্রেসের ফল এ বার খারাপ হতে চলেছে, তখন তাদের সঙ্গে জোট করা কেন!

বসপা নেতা সতীশ মিশ্র বলেন, “এখনও পর্যন্ত সিদ্ধান্ত, উত্তরপ্রদেশে আমরা একাই লড়ব। আর ভোটের পরে কী হবে, তা তো নির্ধারণ করবে সংখ্যা।” অর্থাৎ সরকার গড়ার জন্য কার পক্ষে কত সংখ্যা থাকবে, তা দেখেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বিএসপি।

দক্ষিণে জয়ললিতার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করাটা তো কংগ্রেসের পক্ষে আরও কঠিন। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের সুসম্পর্ক একেবারেই নেই। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তো খুবই খারাপ। তবু কংগ্রেসের তরফে চেষ্টার খামতি নেই। সম্প্রতি চেন্নাইয়ে গিয়ে এডিএমকে-র এক সাংসদের সঙ্গে মঞ্চে উঠেছিলেন চিদম্বরম। কেন্দ্রীয় সাহায্যের ব্যাপারে উদারহস্ত হয়েও জয়াকে বন্ধুত্বের বার্তা দিতে চাওয়া হচ্ছে।

পাশাপাশি যে তিন রাজ্যপালের সঙ্গে জয়ার সম্পর্ক ভাল, রাজস্থানের সেই মার্গারেট আলভা, পশ্চিমবঙ্গের এম কে নারায়ণন ও তামিলনাড়ুর কে রোসাইয়ার মাধ্যমে ঘুরপথে একটা যোগসূত্র গড়ার চেষ্টা চলছে। তবে কংগ্রেসেরই একটা সূত্র বলছে, জয়া না করুণানিধি, কার হাত ধরা হবে সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। যে হেতু লোকসভা ভোটে জয়ার ফল ভাল হওয়ার সম্ভাবনা, তাই প্রাথমিক ভাবে তাঁর কথাই ভাবা হচ্ছে। কিন্তু তাঁকে না-পাওয়া গেলে করুণাতেই তুষ্ট থাকতে হবে।

কিন্তু ডিএমকে-র বর্তমান নেতা, করুণানিধি-পুত্র এম কে স্ট্যালিন ঘোষিত কংগ্রেস-বিরোধী। এই মুহূর্তে কংগ্রেসের সঙ্গে ফের জোট করার পক্ষপাতী নন তিনি। আবার বিজেপি-র সঙ্গেও এখনই হাত মেলাতে চাইছেন না। ডিএমকে সূত্রের খবর, বিএসপি-র মতো তাঁরাও ভোটের ফল দেখেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

একই রকম ভাবে সম্ভাবনার সব দরজা খোলা রাখছেন জয়ললিতাও। মোদীর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক হলেও জোটের ব্যাপারে বিজেপি-কে কোনও কথা দেননি তিনি। এমনকী, সম্প্রতি মোদীর চেন্নাই সফরের সময় তাঁর সঙ্গে দেখাই করেননি জয়া। উল্টে বামেদের ডাকা সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সমাবেশে প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। রাজ্যসভার নির্বাচনে দলের বাড়তি ভোট সিপিএম-কে দিচ্ছেন।

এই পরিস্থিতিতে তামিলনাড়ুর দায়িত্বপ্রাপ্ত কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ বলেছেন, “তামিল স্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে এমন কোনও দলের সঙ্গে কংগ্রেস জোট বাঁধতে আগ্রহী। আমরা খোলা মনেই গোটা বিষয়টা খতিয়ে দেখছি।”

কংগ্রেস সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, ঘরোয়া ভাবে জয়ললিতাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনের পরে যদি কংগ্রেসের পর্যাপ্ত সংখ্যা না থাকে এবং জয়ললিতা যদি প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হন, তা হলে কংগ্রেস তাঁকে বাইরে থেকে সমর্থন জানাবে।

জয়ললিতা, মায়াবতী, মমতা ছাড়াও ওড়িশায় নবীন পট্টনায়ক এবং বিহারে লালুপ্রসাদ ও রামবিলাস পাসোয়ানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলছে কংগ্রেস। জোট নিয়ে ইতিমধ্যেই সনিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন লালু। কংগ্রেস শিবির বলছে, আরজেডি-র সঙ্গে জোট হওয়া প্রায় নিশ্চিত। রামবিলাস ওই জোটে শরিক হবেন কি না, সেটাই এখন দেখার।

congress mayavati jayalalitha mamata banerjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy