Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
মুম্বই মনতাজ

দিওয়ালি মানেই মুম্বই-জুয়া

দিওয়ালিতে বাণিজ্য নগরী মুম্বইয়ে কোটি কোটি টাকা ওড়ে জুয়ায়। কেউ কেউ জেতে, বেশির ভাগই হারে। জুয়ার যা নিয়ম। এক জন কোটি টাকা লোটে তো নিরানব্বই জন কয়েক কোটি হারে। তবু খেলা চলে। মিলন মুখোপাধ্যায়সোডা, কাঠকয়লা, গন্ধক, লোহাচুড়। কালীপুজো বা দিওয়ালি উত্‌সব পালনে মশলার নামাবলি। ভাগ বলতে, ষোলো-আট-চার-তিন বা দুই। এ ছাড়া ‘উড়ন’ তথা ‘ছুঁচো’র ভাগ ছিল পাঁচ-আড়াই-এক। এ বারের কালীপুজো-দিওয়ালির আর কুল্যে দশ দিন বাকি।

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

সোডা, কাঠকয়লা, গন্ধক, লোহাচুড়। কালীপুজো বা দিওয়ালি উত্‌সব পালনে মশলার নামাবলি। ভাগ বলতে, ষোলো-আট-চার-তিন বা দুই। এ ছাড়া ‘উড়ন’ তথা ‘ছুঁচো’র ভাগ ছিল পাঁচ-আড়াই-এক। এ বারের কালীপুজো-দিওয়ালির আর কুল্যে দশ দিন বাকি। এই রকম সময় থেকেই লেগে যেত বাজি বানাবার তোড়জোড়। বসন, উড়ন তুবড়ি ছাড়াও নানান আকারের বোমা-পটকা বাঁধবার ধুম লেগে যেত ছেলেছোকরাদের মধ্যে। টালিগঞ্জ পাড়ার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ভিড়ে যেত এই অধমও। হিড়িক বলে কথা।

মশলাপাতি, দু’রকম তুবড়ির দু’সাইজের খোল ইত্যাদি কেনার পুঁজি জোগাড় হত সকলের কাছে চাঁদা নিয়ে। তারপর সেই ‘চালাও পানসি বেলঘরিয়া’র কায়দায় সদলবল হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতুম মুদিয়ালি ছাড়িয়ে তখনকার রসা রোড (এখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড) এবং সাদার্ন অ্যাভেন্যুর কাছে সাদার্ন মার্কেটে। পাড়ার বাজার চারু মার্কেটেও সরঞ্জাম সব পাওয়া যেত বটে, তবে বাছাই করে নেবার মতন ‘চয়েস’ ছিল না। খদ্দেররা এখানে নিজেদের হাতে হাতে পরখ করে দেখার সুযোগ পেত। ফুটোফাটা খোল বাদ দিয়ে, ভাল খোল সব আলাদা করে রাখার সময় আমাদের দলের ক’জন ‘ডেয়ার ডেভিল’ হাত সাফাইয়ের কায়দায় নিজের কাঁধের থলের মধ্যে দশ-বারোটা করে খোল পাচার করে দিত। পরে ‘বড়াই’ করার সময় ঘোষণা করত, কে ক’টি হাপিস করে দিয়েছে দোকানির নজর এড়িয়ে। আমার গর্ব না হলেও, কেমন যেন ঈর্ষা হত। কেন আমিও পারি না দু’চারটে হাপিস করে দিতে। সেই বয়েসে নিজেকে ভীরু-কাপুরুষ মনে হত।

তা, এ তো ছিল দশক চার-পাঁচ কী তারও কিঞ্চিত্‌ আগের কথা। আজকের মাঝবয়সিদের বাল্যকালের কথা। এ বার পেছুতে পেছুতে যদি একেবারে পুঁথিপুরাণের সময়ে চলে যাই, সেই পৌরাণিক কালে, ‘দিওয়ালি বা ‘দীপাবলি’ উত্‌সবের উত্‌সে, তাহলে পাব আমরা নানান গল্পকথার ভাণ্ডার।

আমাদের বঙ্গসন্তানদের কাছে ‘দিওয়ালি’ কালীপুজোর অঙ্গ। অথচ, যদিও নানা রূপে মা কালী বা মহাকালীর উপস্থিতি অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যগুলিতে যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ, তথাপি কালীপুজো আসলে দীপাবলির একটি অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত। ‘দীপ’-এর আওয়ালি বা আবলি, অর্থাত্‌ ছটার বিন্যাস দীপাবলি। সোজা বাংলায় মূলত এটিকে আলোর উত্‌সব বলা যায়। এক্ষেত্রে ‘আলো’ মানে জ্ঞানের আলো। অজ্ঞানতার অন্ধকার চুরমার করে দিয়ে আলো ফুটুক সকল মানুষের হৃদয়ে। ‘অন্ধকার’কে পুরাণে উল্লেখ করেছে ‘দুষ্ট-কুত্‌সিত-ক্ষতিকারক জাতীয় বিশেষণে।

আজকের জগতে ‘অন্ধকার’কে যদি আমরা ‘অশিক্ষা’র পর্যায়ভুক্ত করি তাহলেই নানান রাজনৈতিক হাত-পা গজিয়ে যাবে এবং বক্তব্যটি ধামাচাপা দিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন ওপরমহলের কর্তাব্যক্তিরা। আমাদের হাতে, আমজনতার পাতে ফেলে দেবেন তেল-সলতে-প্রদীপ। বলবেন, এই নাও। কত আলো জ্বালবে, জ্বালো। তখন গন্ডগ্রামের চাষি-মজুররাও আমাদের দেখাদেখি আমাদের সঙ্গেই গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠবেন কবির গানআলো আমার আলো, ওগো আলোয় ভুবনভরা/আলো নয়নধোয়া, আমার আলো হৃদয়-হরা’ ইত্যাদি। দুঃখ, অত্যাচার, অশিক্ষার অন্ধকার জাপটে থাকবে আমাদের শতকরা সত্তর-আশি ভাগ ভারতবাসীর ছোট ছোট হৃদয়কে। দিওয়ালির তথাকথিত প্রতীকী আলো হারিয়ে যাবে বীভত্‌স অন্ধকারে। সেই অন্ধকারের খলনায়ক-সুলভ কুত্‌সিত হাসি আমি শুনতে পেয়েছি ঘনিষ্ঠ কিছু অপুষ্ট-পালিত মানুষের মনে।

দিওয়ালির পুজো-জড়িত উত্‌সবাদি রীতিমতো ঘটা করে পালিত হয় প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতে। গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ ও দাক্ষিণাত্যের বেশ কয়েকটি রাজ্যে।

চার-পাঁচ দিনের পুজোর প্রথম দিনটিকে উল্লেখ করা হয় ‘ধন ত্রয়োদশী’ বা চলতি কথায় ‘ধনতেরাস’। ধনদৌলত তথা মা লক্ষ্মীর মান ভজানোর পুজো। দ্বিতীয় শুদ্ধ দিনটির নাম ‘নরক চতুর্দশী’। এই দিন নাকি কেষ্টঠাকুর ‘নরকাসুর’বধ করেছিলেন। তৃতীয় দিন দীপাবলি। ভারতের অধিকাংশ হিন্দুই (অনেকটা বাঙালিদের দুর্গাপুজোর মতোই) নতুন বস্ত্রে ভূষিত হয়ে (অবিশ্যি আমাদের মহান দেশের শতকরা কতজন মানুষ-মানুষি লজ্জা ঢাকার জন্যে একচিলতে সাঁতরাগাছির গামছা আজ কিনতে পারেন সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ বর্তমান) লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন করেন।

আর যাই হোক, এই দিনটি আপামর ব্যবসায়ী পুজোআচ্চা সেরে, প্রদীপাদি জ্বালিয়ে ‘জুয়া’ খেলতে বসেন। তার কারণ আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রমতে দেবী পাবর্তী নাকি তাঁর কর্তা পরমেশ্বরের সঙ্গে ‘পাশা’ খেলেছিলেন (মহাভারতের সেই কুখ্যাত অক্ষক্রীড়ায় পাণ্ডবরা সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন) এবং বিধান দিয়েছিলেন, যে যে বা যারা জুয়ো খেলবে এই দিন, সারা বচ্ছর তার বা তাদের অর্থোন্নতি অবশ্যম্ভাবী। কোন আদি জুয়াড়ি ছিলেন সে যুগে যে, এমন গপ্পো বেঁধে বাজারে চালু করে দিলেন এই বিধির বিধান (?), কে জানে? এখন মুম্বইয়ের বায়োস্কোপওলাদের মধ্যে এটি অতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়। লাইনটাই যে জুয়াখেলা-টাইপের। ‘বই’ হিট তো রাজা, ‘বই’ ডুবল তো ভিখিরি। লাইনে নাম লেখালে আর গতি নেই। কপাল ঠুকে দানের পর দান তাস পিটিয়ে খেলে যাও। লাগে লাক, না লাগে তাক। তারই মূর্ত চেহারা দেখা যায় ঘরে ঘরে। বায়োস্কোপের স্টুডিওর সেটে। কারও দেওয়ালি, কারও দেউলিয়া দশা।

দিওয়ালিতে বাণিজ্য নগরী মুম্বইয়ে কোটি কোটি টাকা ওড়ে জুয়ায়। কেউ কেউ জেতে, বেশির ভাগই হারে। জুয়ার যা নিয়ম। এক জন কোটি টাকা লোটে তো নিরানব্বই জন কয়েক কোটি হারে। তবু খেলা চলে।

মনে পড়ে, রাজসায়েবের মানে আজকের রণবীর কপূরের দাদু বা ঋষি কপূরের পিতৃদেব রাজকপূর তখনকার মোহন স্টুডিওতে শুটিং করছিলেন জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত ‘তিসরি কসম’ ছবিটির। ঘটনাচক্রে সে দিনটি ছিল চার দিনের দিওয়ালির একটি দিন। যদ্দুর মনে হয় ধনতেরাসের দিন। শুটিং চলছে। সকাল থেকেই সে দিন স্টুডিও চত্বরে ছিলুম। ছবিটির নায়িকা ওয়াহিদাজির সঙ্গে চা-সমেত গল্পগাছা হচ্ছিল। হেটো আধময়লা ধুতি ও ফতুয়া পরনে রাজাসাহেব সেটে ঢুকতেই সব তটস্থ। হেসে নমস্কার করতেই কাঁধে হাত রাখলেন। কিঞ্চিত্‌ অবাঙালি উচ্চারণে বাংলায় মন্তব্য করলেন, “আরে বঙ্গালিমোশাইও এসে গেছো।’ পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাসুদা ও তাঁর বাঙালি সহকারী যারা স্ক্রিপ্ট-লাইট-ক্যামেরা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, সে দিকে দেখিয়ে বললেন, “পুরা বঙ্গালদেশই তো এইখানে হাজির।” হাঁটছেন আমার কাঁধে হাত রেখে।

দু’ধারের সব কলাকুশলী, স্টুডিও কর্মীরা মাথা ঝুঁকিয়ে ওঁকে নমস্কার-প্রণাম-শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। উনিও ঝুঁকে সে সব গ্রহণ করতে করতে গলা তুলে বললেন, অনেকটা বাসুদাকে শুনিয়ে, “তো আজ দুপুরের লাঞ্চে মাছের ঝোল-ভাত হোক।” বলেই আর একজনকে শুধোলেন, “আরে! ধনতেরাস মহল কিধর লাগায়া”? অর্থাত্‌ জুয়োর আড্ডা কোথায় বসেছে। কে একজন জানাল “এখনও বসেনি।” “সে কী! বেলা এগারোটা। শিগগির লাগাও। সেটের কাছেপিঠে লাগিয়ে দাও। গাড়িতে নতুন তাসের প্যাকেট আছে। ড্রাইভারকে বলো নিয়ে আসতে। আরে কত্তো বেলা হয়ে গেল!”

ব্যস, বসে গেল তাসপার্টি। ছবির প্রয়োজক-গীতিকার শৈলেন্দ্রজি, সুরকার জয়কিষন, রাজসাব স্বয়ং এবং ওঁদের দু’তিনজন সঙ্গী। সবাই ধুলোমাটিতে লেপ্টে বসেছেন। ‘শট রেডি’ হতেই শতরঞ্জির ওপর তাসক’টি উপুড় করে রেখে উঠে যান ‘শট’ দিতে। খাবার সময়ে প্রায় সহচরের মতো পাশে-বসে-থাকা এই বঙ্গালিমোশাইকে বলেন, ‘আমার দানটা দিও ভাই।’

ক্যামেরার সামনে গিয়ে মুহূর্তে একেবারে অন্য মানুষ। কোথায় তাসপিটোনো হিরো রাজ কপূর? কাঁধের গামছায় মুখ মুছে নিলেই সরাসরি মধ্যভারতের গরুর গাড়ির ‘টাঙ্গেওলা’। সে দিন প্রায় সারাক্ষণই ওঁর সঙ্গে থাকতে হয়েছিল। কারণ আমার পরামর্শেই নাকি উনি প্রতি দানে অঢেল টাকার বাজি জিতছিলেন। ‘মেরা আজকা লাকি ম্যাস্কট, তুম হো, বঙ্গালিভাই। পাশ থেকে একদম নড়বে না।”

আপন ‘কপাল’ তো বরাবরই ‘গোপাল’। যাক, তবু কারও একজনের জুয়াভাগ্যে আমার সঙ্গ কাজে লাগছে ভেবে গর্বই হচ্ছিল। তাও আবার কার? সে যুগের মহানায়ক-পরিচালক-প্রযোজক-ইন্ডিয়ান চ্যাপলিন রাজকপূর বলে কথা।

দীপাবলির চতুর্থ দিন বিক্রমাদিত্য প্রচলিত সংবত্‌ অনুসারে বছরের প্রথম দিন। প্রতিপদ। গোবর্ধনপুজো ও অন্নকূট পর্ব। এই উত্‌সবের অঙ্গ হিসেবে অমাবস্যার দিনই বঙ্গসন্তানদের কালীপুজো। হিন্দুদের প্রত্যেকটি পুজোপার্বণের উত্‌স বা ব্যুত্‌পত্তির খোঁজে বেরুলে পাবেন অজস্র গল্পগাথা-পুরাণ-লোকগীতির ছড়াছড়ি। ইচ্ছেমতো বাছাই করে পুজোয় বসুন। বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহুদূর। এছাড়া ঠাকুরের কথায় এগিয়ে যাই যত মত তত পথের যে কোনও একটিকে ধরে। সকলই তোমার ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি....।

কার কর্ম কে যে করে! তিন কুড়ি পার করেও বুঝলাম না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mumbai milan mukhopadhay diwali gambling
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE