Advertisement
১৮ মে ২০২৪

নতুন বছরের প্রথম দিনেই জন্ম ‘নীতি’র

বছর শুরুর দিনেই যোজনা ভবনের কর্তাদের ডেকে পাঠিয়ে খবরটা দিলেন সচিব সিন্ধুশ্রী খুল্লর। জানালেন, “মেয়ে হয়েছে! নাম ঠিক হয়েছে নীতি।” প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লাল কেল্লার প্রাচীর থেকে দেওয়া প্রথম বক্তৃতাতেই নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন, যোজনা কমিশন তুলে দেওয়া হবে। সময়ের চাহিদা মেনে তার জায়গায় তৈরি হবে নতুন প্রতিষ্ঠান। নতুন বছরের প্রথম দিনেই অবশেষে আত্মপ্রকাশ করল সেই নতুন প্রতিষ্ঠান। নাম ‘নীতি আয়োগ’।

নতুন বছরের প্রথম দিনে ছোটদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী। নয়াদিল্লিতে বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।

নতুন বছরের প্রথম দিনে ছোটদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী। নয়াদিল্লিতে বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৩
Share: Save:

বছর শুরুর দিনেই যোজনা ভবনের কর্তাদের ডেকে পাঠিয়ে খবরটা দিলেন সচিব সিন্ধুশ্রী খুল্লর। জানালেন, “মেয়ে হয়েছে! নাম ঠিক হয়েছে নীতি।”

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লাল কেল্লার প্রাচীর থেকে দেওয়া প্রথম বক্তৃতাতেই নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন, যোজনা কমিশন তুলে দেওয়া হবে। সময়ের চাহিদা মেনে তার জায়গায় তৈরি হবে নতুন প্রতিষ্ঠান। নতুন বছরের প্রথম দিনেই অবশেষে আত্মপ্রকাশ করল সেই নতুন প্রতিষ্ঠান। নাম ‘নীতি আয়োগ’।

এ ক্ষেত্রে নীতি-র পুরো কথাটি হল ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া’। অর্থাৎ, দেশকে আমূল বদলে দেওয়ার প্রতিষ্ঠান। যার শীর্ষে (চেয়ারপার্সন) থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে সঠিক আর্থিক নীতি তৈরিতে সাহায্য করতে এবং সেখানে নতুন চিন্তা-ভাবনার জোগান দেওয়ার জন্য মূলত ‘থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক’ হিসেবেই কাজ করবে প্রতিষ্ঠানটি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে যেখানে সামিল করা হচ্ছে সমস্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের।

নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম, কাঠামো ও লক্ষ্য ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বার্তা, উন্নয়নের প্রশ্নে তিনি রাজ্যগুলিকে সঙ্গে নিয়েই চলতে চান। ট্যুইটারে তিনি জানান, যোজনা কমিশনের সঙ্গে নীতি আয়োগের সব থেকে বড় অমিল সেখানকার পরিচালন পরিষদে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের উপস্থিতি। তাঁর দাবি, এতে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে। মোদীর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী পদে ছিলাম বলে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আমি জানি। নীতি আয়োগ ঠিক সেটাই করবে।” মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেই যে এই নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, তা-ও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।

৬৫ বছরের পুরনো যোজনা কমিশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল দিল্লিতে বসে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার উন্নয়নের জন্য নীতি তৈরির। সেই নীতি চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে বরাবরই অসন্তোষ ছিল রাজ্যগুলির। প্রশ্ন উঠত, কাশ্মীরের নীতি যে কেরলের জন্য খাটে না, সেই বাস্তব মানা হবে না কেন? হয়তো সেই কারণেই আজ, বৃহস্পতিবার মোদী ট্যুইট করেছেন, “সব পায়ের জন্য একই মাপের জুতোর নীতিকে বিদায়। ভারতের বহুত্ব ও বৈচিত্র্য মেনেই কাজ করবে এই প্রতিষ্ঠান।”

কেন্দ্রের দাবি, এই নয়া প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রধান লক্ষ্যই আর্থিক নীতি তৈরির বিকেন্দ্রীকরণ। তাই যে সব এলাকায় উন্নয়নের সুবিধা পৌঁছচ্ছে না, সেগুলির দিকে বিশেষ নজর দিতে নীতি আয়োগে আঞ্চলিক পরিষদ তৈরি হবে। সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে তা তৈরি করবেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ করতে একেবারে সময় বেঁধে ওই পরিষদ তৈরি হবে।

তবে প্রধানমন্ত্রীর এমন হাজারো প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও নীতি-আয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা।

প্রথম প্রশ্ন, নয়া প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা কী ভাবে কাজ করবে, সেই দিশা কোথায়?

দ্বিতীয়ত, যোজনা কমিশনের প্রধান কাজ ছিল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি। এখন সেই পাঁচ বছরের পরিকল্পনা তৈরি জারি থাকবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর কই?

তৃতীয়ত, প্রতি বছর রাজ্যের জন্য বরাদ্দ নির্ধারণ করতে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে সমন্বয় রক্ষার কাজটি করত যোজনা কমিশন। কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সনের (শেষ জন মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া) সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে ওই বরাদ্দ চূড়ান্ত হত। এখন সেই কাজ কে করবেন?

পুরনো যোজনা কমিশনের কাঠামোর সঙ্গে নীতি আয়োগের পার্থক্য কোথায়, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও। বিরোধীদের যুক্তি, যোজনা কমিশনের মাথায় প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে তৈরি জাতীয় উন্নয়ন পরিষদ থাকত। এখানে তারই নাম পাল্টে করে দেওয়া হয়েছে পরিচালন পরিষদ। যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন বদলে হয়েছেন ভাইস চেয়ারপার্সন। সচিবের পদের নাম পাল্টে হয়েছে সিইও। বিরোধীদের অভিযোগ, আসলে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর হাতেই আরও বেশি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার বন্দোবস্ত হয়েছে নতুন প্রতিষ্ঠানে। একে তাই নিছক ‘গিমিক’ বা লোকভুলোনো বলে আখ্যা দিচ্ছেন তাঁরা।

যেমন এই প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি ‘অনীতি ও দুর্নীতি’র আখ্যা দিচ্ছেন সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি বলেন, “সরকার যদি বছরের প্রথম দিন থেকেই ভাঁওতা দিতে শুরু করে, তা হলে কিছু বলার নেই। অর্থ মন্ত্রক যদি কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যস্থতার কাজ করে আবার তারাই যদি আর্থিক নীতিও তৈরি করে, তা হলে শুধু স্বল্প মেয়াদি লক্ষ্যপূরণ হবে।”

কংগ্রেসের মনীশ তিওয়ারির আশঙ্কা, “এতে রাজ্যগুলির প্রতি বৈষম্য বাড়বে।” তৃণমূলের সৌগত রায়ের অভিযোগ, “এ বার কর্পোরেট সংস্থাগুলিই সব সিদ্ধান্ত নেবে।”

ট্যুইটারে প্রধানমন্ত্রীর অবশ্য পাল্টা যুক্তি, আগামী দিনে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে নীতি আয়োগ। তা কাজ করবে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে আর্থিক উন্নয়নের নীতি তৈরির জন্য। সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা, সংস্কারের পরে দু’দশক কেটে গিয়েছে। উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা অনেকটাই কমেছে। সরকারি লগ্নির বদলে বেসরকারি বিনিয়োগই এখন অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু সময়ের দাবি মেনে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেকে বদলাতে পারেনি যোজনা কমিশন। আর সেই কারণেই এই নতুন প্রতিষ্ঠান। রাজ্যের বরাদ্দ নির্ধারণ এখন অর্থ মন্ত্রকই করবে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ ঠিক হবে পরে।

নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়েও সাধারণ মানুষের মতামত চেয়েছিলেন মোদী। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে সেখানেও। কারণ, ‘নীতি আয়োগ’ নামটির মধ্যে ‘ইনস্টিটিউশন’ বা প্রতিষ্ঠান এবং ‘আয়োগ’ বা কমিশনদু’টি শব্দই আছে। অনেকেই একে অসঙ্গতি বলে মনে করছেন।

উল্লেখ্য, যোজনা কমিশনের মতো নীতি আয়োগও তৈরি হচ্ছে মন্ত্রিসভার প্রস্তাবের মাধ্যমে। আইন করে নয়। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার ‘গসপ্ল্যান’-এ অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৫০ সালের ১৫ মার্চ মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব এনে যোজনা কমিশন গড়েন জওহরলাল নেহরু। একই ভাবে গত ২৯ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব এনে নীতি আয়োগ তৈরি করলেন মোদীও। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মহাত্মা গাঁধী, বি আর অম্বেডকর, দীনদয়াল উপাধ্যায় এবং স্বামী বিবেকানন্দকে উদ্ধৃতও করা হয়েছে সেই প্রস্তাবে।

নতুন প্রতিষ্ঠান নিয়ে মোদীর প্রতিশ্রুতি, এ বার পা মেপে সকলের আলাদা জুতো। আর বিরোধীদের অভিযোগ, নতুন ‘কারখানার জুতো’ পায়ে খাপ খাবে না কারওরই। নীতি আয়োগের জুতো শেষ পর্যন্ত কার পায়ে কতটা মানানসই হয়, সে দিকেই এখন নজর সকলের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

niti ayog narendra modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE