গত দু’বারের মতো পার্টি কংগ্রেস এ বারও দক্ষিণে। বিপর্যয়ের সময়ে দলের রাশও থেকে যাওয়ার কথা দক্ষিণী হাতেই। কিন্তু কোন হাত? পার্টি কংগ্রেসের ঘোষণার পরেই লড়াই জমে উঠছে সিপিএমের অন্দরে!
তিন বারের বেশি কোনও কমিটির সম্পাদক পদে থাকা যাবে না বলে নিয়ম জারি হয়েছে সিপিএমে। সেই নিয়মেই দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে এ বার বিদায় নেওয়ার কথা প্রকাশ কারাটের। বিশেষ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় কমিটির তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থন নিয়ে আরও এক বার সম্পাদক থেকে যাওয়ার সংস্থান অবশ্য গঠনতন্ত্রে আছে। কিন্তু লোকসভা ভোটে দলের বেনজির বিপর্যয়ের পরে কারাটের পক্ষে সেই ব্যতিক্রমী পথে হাঁটা কঠিন। তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসাবে দলে যাঁকে ভেবে রাখা হয়েছিল, তাঁকে নিয়ে আবার তৈরি হয়েছে নতুন জটিলতা! এমতাবস্থায় বিশাখাপত্তনমের পার্টি কংগ্রেসে সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে শেষ পর্যন্ত অন্ধ্রের এক ভূমিপুত্রের অধিষ্ঠান ঘটানোর প্রয়াস গতি পাচ্ছে।
কারাটের নেপথ্য সমর্থনেই সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে সংগঠন দেখেন পলিটব্যুরোর সদস্য এস রামচন্দ্র পিল্লাই। দলের অন্দরে যাঁর পরিচয় ‘এসআরপি’ নামে। কোঝিকোড়ে বিগত পার্টি কংগ্রেসে দলের সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেছিলেন তিনিই। তাঁর হাতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েই কারাট দলে নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখবেন, এমনই ভাবনা শুরু হয়েছিল সিপিএমে। কিন্তু গোল বেধেছে একের পর এক রাজ্য শাখা এসআরপি-র নামে বেঁকে বসায়! পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, বঙ্গ ব্রিগেড তো বটেই, তামিলনাড়ু বা অন্ধ্র, তেলঙ্গানার মতো দক্ষিণী রাজ্যের নেতারাও দলের কর্ণধার হিসাবে এসআরপি-কে মানতে নারাজ! পাশে শুধু তাঁর নিজের রাজ্য কেরল।
এমন বিরূপ পরিবেশে নতুন সম্পাদক চাপিয়ে দেওয়া কঠিন বুঝেই বিকল্প নাম খুঁজতে হচ্ছে কারাট শিবিরকে। আর তাতেই উঠে আসছে বি বেঙ্কট রাঘবুলুর নাম। ঘটনাচক্রে, দলের নির্দেশে সাতের দশকে জরুরি অবস্থার সময়ে যিনি ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন বিশাখাপত্তনমেই! যে সৈকত-শহরে এ বার বসছে সিপিএমের ২১তম পার্টি কংগ্রেস।
পলিটব্যুরোর সদস্য রাঘবুলু (বিভিআর) দলের শীর্ষ স্তরে কারাটেরই ঘনিষ্ঠ। পলিটব্যুরোর আর এক প্রভাবশালী নেতা সীতারাম ইয়েচুরি অন্ধ্রেরই ভূমিপুত্র হলেও তেলুগু মাতৃভাষা ছাড়া তাঁর সঙ্গে রাঘবুলুর আর কোনও মিল নেই! বাংলা-সহ দলের একাংশ যদিও মনে করে, এমন সঙ্কটের সময়ে ইয়েচুরি দলের হাল ধরলে ভাবনাচিন্তায় কিছু পরিবর্তন আশা করা যেত। তাঁর বদলে মধ্যপন্থা মেনে রাঘবুলুর নাম বঙ্গ শিবির মেনে নেবে কি না, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। সেই ১৯৯৭ সাল থেকে টানা পাঁচ বার অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক ছিলেন রাঘবুলু। পাঁচ মাস আগে নতুন তেলঙ্গানা ও সীমান্ধ্র রাজ্য কমিটি তৈরি হওয়ায় আপাতত তিনি রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বমুক্ত। পলিটব্যুরোর তরফে তেলঙ্গানা ও অন্ধ্র, দুই রাজ্যেরই ভারপ্রাপ্ত। তাঁর স্ত্রী এস পুণ্যবতীও সিপিএমের নেত্রী। দু’জনেরই উচ্চ শিক্ষা বিশাখাপত্তনমে।
সিপিএম সূত্রের খবর, এসআরপি-কে নিয়ে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে লোকসভা ভোটের পরে। বঙ্গ ব্রিগেডের ইচ্ছা ছিল, লোকসভায় দলের ক্ষীয়মাণ শক্তির নেতৃত্বের ভার দেওয়া হোক এ রাজ্যের সুবক্তা ও অভিজ্ঞ সাংসদ মহম্মদ সেলিমকে। কিন্তু মূলত কৃষক নেতা এসআরপি-র প্রবল আপত্তিতেই লোকসভার দলনেতা করা হয় কেরলের বর্ষীয়ান সাংসদ পি করুণাকরনকে। তার পর থেকেই বাংলা সিপিএমের সঙ্গে এসআরপি-র সম্পর্কও তিক্ত হয়েছে।
পরিস্থিতির ফায়দা নিতে কারাট শিবিরের একাংশ চেষ্টা চালাচ্ছে, পলিটব্যুরোর একমাত্র মহিলা সদস্য বৃন্দা কারাটকে শীর্ষ পদে নিয়ে আসার। এ রাজ্যে লাভপুর বা হাড়োয়ার ব্রাহ্মণচকের মতো আক্রান্ত এলাকায় ছুটে গিয়ে বৃন্দাও নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টায় ত্রুটি রাখছেন না। কিন্তু বিদায়ী সাধারণ সম্পাদকের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন তাঁর ঘরণী দৃষ্টিকটু বলেই এমন সম্ভাবনায় বিড়ম্বনা আছে স্বয়ং কারাটেরও!
দলের এক শীর্ষ নেতা বলছেন, “অন্ধ্র এমন রাজ্য, যেখানে সিপিএম ক্ষমতায় না এলেও আন্দোলনের ঐতিহ্য উজ্জ্বল। বিভিআর সেই রাজ্যে দীর্ঘ দিন দলের দায়িত্ব সামলেছেন।” বাংলা ও কেরলে ক্ষমতা হারিয়ে এবং লোকসভায় ক্ষুদ্র হয়ে গিয়ে সিপিএম যখন সঙ্কটে, সেই সময়ে রাঘবুলুর মতো নেতা দলকে উজ্জীবিত করতে পারবেন বলেই সিপিএমের একাংশের আশা। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “ক্ষমতাসীন অবস্থায় দল চালানোর বিলাসিতা তাঁর ছিল না, এটা অবশ্যই প্লাস পয়েন্ট।”
সিপিএম-প্রতিষ্ঠার ৫০ বর্ষপূর্তিতে এম বাসবপুন্নাইয়ার শতবর্ষ উদযাপন হচ্ছে এখন। সদ্যই হয়ে গিয়েছে পি সুন্দরাইয়ার শতবর্ষ। সুবর্ণ জয়ন্তীতে ফের কি গৌরব বাড়বে তেলুগু নেতাদের? উত্তর বিশাখাপত্তনমে!