আটচল্লিশ ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস নাটকের পর লালকৃষ্ণ আডবাণীকে গাঁধীনগর থেকেই প্রার্থী হতে রাজি করিয়ে সঙ্কট এড়াল বিজেপি। আজ সন্ধ্যায় এক লিখিত বিবৃতিতে আডবাণী জানিয়ে দিলেন, ভোপাল নয়, গাঁধীনগর থেকেই তিনি লড়বেন।
আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সক্রিয় হস্তক্ষেপে আপাতত সঙ্কটমোচন হলেও সঙ্ঘ তথা বিজেপি নেতৃত্বের ফাঁড়া কিন্তু পুরোপুরি কাটল না। আডবাণী বনাম নরেন্দ্র মোদী সংঘাতের আবহ রয়েই গেল। ভোটের আগে গুরু-শিষ্যের সংঘাত সামগ্রিক ভাবে দলকে অস্বস্তিতে ফেলবে কি না, থেকে গেল সেই সংশয়ও।
গত কাল রাতে বিজেপি-র নির্বাচনী কমিটির বৈঠকের পরেই নরেন্দ্র মোদীকে দিল্লিতে সঙ্ঘের সদর দফতরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মোহন ভাগবত। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি পরামর্শ দেন, আডবাণীকে গাঁধীনগর থেকে প্রার্থী হতে বাধ্য করাটা ঠিক হবে না। তাঁকে গাঁধীনগর থেকেই প্রার্থী করা হোক, কিন্তু সেটা করা হোক আডবাণীর সঙ্গে দেখা করে, তাঁকে যথাযথ সম্মান দিয়ে।
এর পরেই মোদী ফোন করেন আডবাণীকে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেন, “আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ। আমার গুরু। আপনি আমাকে বকুন। আমাকে শাসন করুন। কিন্তু গুজরাত থেকে আপনার কোনও ভাবেই অন্যত্র চলে যাওয়া চলবে না।” বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য আডবাণীর বাড়িতেও আসতে চান তিনি।
তার পর ৩০ নম্বর পৃথ্বীরাজ রোডের বাড়িতে আজ প্রাতরাশের টেবিলে দুই নেতার মধ্যে ৪৫ মিনিট আলোচনা হয়। পোহা, গুজরাতি মিষ্টি খেতে খেতে বরফ অনেকটাই গলে যায়। এই বৈঠকের মাধ্যমে সঙ্ঘ ও মোদী কৌশলে আডবাণীকে বেশ নরম করে ফেলেন। মোদীর পর সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নায়ডুরা এসে ঐক্যের পরিবেশ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
তবে সঙ্ঘ এবং বিজেপি-র শীর্ষ নেতারা প্রায় সকলেই আডবাণীর সাম্প্রতিক ভূমিকায় যারপরনাই রুষ্ট। মোদী, জেটলিরা মনে করছেন, আডবাণী এখনও নানা ভাবে জিলিপির প্যাঁচ কষছেন। কংগ্রেসের কিছু নেতাও তাঁকে উৎসাহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মোহন ভাগবত বিজেপি নেতাদের বুঝিয়ে দেন, মনে যতই রোষ থাকুক, ভোটের আগে আডবাণীর সঙ্গে সংঘাতে যাওয়াটা ভুল পদক্ষেপ হবে। কারণ, অটলবিহারী বাজপেয়ীর পরে আডবাণীই দলের কর্মী এবং দেশের মানুষের কাছে বিজেপি-র শীর্ষ নেতা। মুরলীমনোহর জোশী বা যশোবন্ত সিংহের চেয়ে আডবাণীর রাজনৈতিক মর্যাদা অনেক বেশি। তাঁর হাত ধরেই লোকসভায় বিজেপি-র আসন দুই থেকে বেড়ে দু’শো হয়েছিল। এ হেন আডবাণী যদি এখন ক্ষিপ্ত হয়ে ব্লগ লিখতে শুরু করেন বা প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তা হলে বিজেপি-র সমূহ লোকসান।
আডবাণীকে মর্যাদা দিয়ে তাঁর ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করলেও আরএসএস কিন্তু প্রথম থেকেই চাইছিল, আডবাণী যেন এ বার ভোটে না দাঁড়ান। এক জন অরাজনৈতিক দূত মারফৎ সে কথা আডবাণীকে জানিয়েওছিলেন মোহন ভাগবত। মোদীও প্রাথমিক ভাবে চেয়েছিলেন আডবাণী যেন গাঁধীনগরে প্রার্থী না হন। গাঁধীনগরে আডবাণীর পুত্র বা কন্যাকে প্রার্থী করার সম্ভাবনা নিয়েও আরএসএসে আলোচনা হয়। কিন্তু আডবাণী এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর পর তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠানোর কথা উঠলে পরের দিনই গাঁধীনগরে গিয়ে ঘোষণা করেন, তিনি সেখান থেকেই প্রার্থী হবেন।
আডবাণী যখন দেখলেন, মুরলীমনোহর জোশীকে বারাণসী থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হল এবং সংবাদমাধ্যমে গাঁধীনগরে তাঁর প্রার্থীপদ নিয়ে আলোচনা শুরু হল, এমনকী এ-ও বলা হল যে সেখানে তিনি হেরে যেতে পারেন তখন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের সঙ্গে আলোচনা করেন। ভোপাল থেকে শিবরাজ এ বার কৈলাস জোশীকে প্রার্থী করতে চাইছেন না। তিনি আডবাণীকে ওই আসনটি দিতে চান। মোদী-বিরোধী সুষমা মধ্যপ্রদেশের বিদিশা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী। তিনিও আডবাণীকে ভোপাল থেকে লড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেন। আডবাণীর নামে ভোপালে পোস্টার পড়ে যায়। শিবরাজ গত কালও রাতে আডবাণীকে ফোন করে বলেছেন, “আপনি ভোপাল থেকেই দাঁড়ান। গাঁধীনগর থেকে যদি আপনাকে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়, তা হলে আপনি দু’টি আসন থেকেই লড়ুন।” আসলে মোদী-বিরোধী শিবরাজ সচেতন ভাবেই আডবাণীকে উৎসাহিত করেছেন।
এ দিকে, বিজেপি-র সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকের আগেই গুজরাত বিজেপি-র পক্ষ থেকে গাঁধীনগরের জন্য আডবাণীর নাম প্রস্তাব করা হয়। কারণ, মোদী তত ক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, আডবাণী যদি গুজরাত থেকে সরে যান, তা হলে প্রচার করা হবে যে, জোশীকে বারাণসী থেকে সরানো এবং যশোবন্ত সিংহ, যশবন্ত সিনহাকে প্রার্থী না-করার পাশাপাশি আডবাণীকেও তিনি গুজরাত-ছাড়া করতে চাইছেন। কিন্তু অভিমানী আডবাণী তখন ভোপালেই দাঁড়াবেন বলে ধনুকভাঙা পণ করে বসেছেন। ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে দাঁড়ায়।
আজ মোদীর দৌত্যের পর আডবাণী যখন গাঁধীনগর থেকে লড়তে রাজি, তখন তাঁর পক্ষে মর্যাদাজনক উপায়ে কী ভাবে সেই ঘোষণা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয় দলে। প্রথমে বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ বিবৃতি দিয়ে বলেন, আডবাণীর জন্য দল গাঁধীনগর আসন ঠিক করলেও তিনি কোনখান থেকে লড়বেন, সেটা ঠিক করার ভার তাঁর উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর পর লিখিত বিবৃতি দেন আডবাণী। তিনি বলেন: ‘রাজনাথ সিংহ আমাকে জানিয়েছেন যে, গুজরাতের দলীয় নেতৃত্ব চান আমি যেন সে রাজ্য থেকে লড়ি। দলের নির্বাচনী কমিটিও সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ তিনি আমাকে এ-ও জানিয়েছেন যে, মধ্যপ্রদেশের বিজেপি নেতৃত্ব চান আমি যেন ভোপাল আসন থেকে লড়ি। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কমিটি এবং সংসদীয় দলের বৈঠকে আলোচনা করে আসন বেছে নেওয়ার ভার আমার উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।... ১৯৪৭ সালে করাচি থেকে আসার পর থেকেই গুজরাতের সঙ্গে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৯১ সাল থেকে আমি গাঁধীনগরের সাংসদ। তাই ২০১৪ লোকসভা ভোটও আমি ওই আসন থেকেই লড়ব।’
গাঁধীনগর নিয়ে যা-ই হোক, আডবাণীর একান্ত ঘনিষ্ঠ হারিন পাঠককে কিন্তু আমদাবাদ-পূর্ব কেন্দ্র থেকে কিছুতেই প্রার্থী করতে চান না মোদী। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই পটেলের একদা অনুচর পাঠককে তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। আডবাণীর কথাতেও মোদী তাঁকে প্রার্থী করতে রাজি নন।
মোহন ভাগবতের কথা শুনে আডবাণীর মর্যাদা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করলেও তাঁকে জমি ছাড়তে নারাজ বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy