Advertisement
E-Paper

বাবা-কাকা-মামা, অভিশপ্ত পরম্পরা

এ এক অভিশপ্ত পরিবারের কাহিনি। এই তো ক’দিন আগেই প্রয়াত প্রমোদ মহাজনের মেয়ে পুনম রাজস্থানি থালি খেতে খেতে বলেছিলেন, “বাবা চলে যাওয়ার পর এখন মামাই সব। মামা না থাকলে এ বার ভোটে লড়ার সাহস পেতাম না।” প্রমোদ মহাজনের মৃত্যুর আট বছর পর পুনমের ‘মামা’ গোপীনাথ মুন্ডে মারা গেলেন আকস্মিক পথ দুর্ঘটনায়।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৪ ০২:৫১

এ এক অভিশপ্ত পরিবারের কাহিনি।

এই তো ক’দিন আগেই প্রয়াত প্রমোদ মহাজনের মেয়ে পুনম রাজস্থানি থালি খেতে খেতে বলেছিলেন, “বাবা চলে যাওয়ার পর এখন মামাই সব। মামা না থাকলে এ বার ভোটে লড়ার সাহস পেতাম না।”

প্রমোদ মহাজনের মৃত্যুর আট বছর পর পুনমের ‘মামা’ গোপীনাথ মুন্ডে মারা গেলেন আকস্মিক পথ দুর্ঘটনায়।

এ এক ছত্রভঙ্গ পরিবার। কাকা গুলি চালিয়ে হত্যা করেছেন বাবাকে। তারপর সেই কাকা জেলে বন্দি অবস্থায় মারা গিয়েছেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে। প্রমোদের মৃত্যুর কয়েক দিনের মাথায় মাত্রাতিরিক্ত মদ ও মাদক সেবনে অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী বিবেক মৈত্র। হাসপাতালে ভর্তি হলেন বিবেকের দোসর, প্রমোদ-পুত্র রাহুল। সুস্থ হয়ে বাল্যপ্রেমিকাকে বিয়ে করলেন। চার বছরের মাথায় সেই বিয়ে ভাঙল। রাহুল এ বার কনে বাছতে রিয়্যালিটি শো-এ অংশ নিলেন। বঙ্গললনা ডিম্পিকে বিয়ে করলেন। সেখানেও ডিম্পিকে মারধরে অভিযুক্ত হলেন রাহুল। উঠল সমকামিতার অভিযোগও। বিয়ের চার বছরের মাথায় গত মাসেই পারিবারিক আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছেন তাঁরা। এ বার গোপীনাথের আকস্মিক মৃত্যু পরিবারটিকে আরও একটি ঝড়ের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল। আর কী আশ্চর্য, প্রমোদ-বিবেক-প্রবীণ-গোপীনাথ চার জনই মারা গেলেন মাসের তিন তারিখে! প্রমোদ ৩ মে, প্রবীণ ৩ মার্চ, বিবেক আর গোপীনাথ ৩ জুন!

বিজেপির এক শীর্ষ নেতা আজ বলছিলেন, “এই অভিশপ্ত কাহিনির নীতিকথাটি কী জানেন? অর্থই অনর্থের মূল!” রামমন্দির নিয়ে রথযাত্রার সময়ে আডবাণীর ছায়াসঙ্গী ছিলেন প্রমোদ। প্রথম যে দিন মুম্বই শহরে আডবাণীর সঙ্গে প্রমোদের ছোট্ট ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম, সে দিন গোপীনাথও সেখানে ছিলেন। আডবাণী বলেছিলেন, “জানো তো এরা দু’জন সমবয়সী। একই কলেজের ছাত্র।” গোপীনাথ বলে উঠেছিলেন, “আমরা একই স্কুলে টাইপরাইটিং-ও শিখেছি।” সে যুগে ছাত্র-ছাত্রীদের চাকরি পাওয়ার জন্য টাইপরাইটিং শেখা ছিল একটি আবশ্যিক কাজ। প্রমোদ পরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শুধু টাইপরাইটার নয়। আধুনিক মোবাইল এমনকী পরবর্তী কালে ইন্টারনেট ব্যবহারেও তিনি একই ভাবে পারঙ্গম।

গোপীনাথ কিন্তু এতটা স্মার্ট ছিলেন না। ব্রাহ্মণ নেতা প্রমোদ বেঙ্কটেশ মহাজন আর ওবিসি গোপীনাথ পান্ডুরঙ্গ মুন্ডের মধ্যে তাই আচার-আচরণের ফারাক ছিল প্রবল। মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে সে দিন দু’জনের স্ত্রী-কেও দেখেছিলাম। দু’জনেই ছাপোষা পরিবারের মেয়ে ছিলেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই দিল্লির রাজনীতিতে প্রমোদ মহাজনের চড়চড় করে উত্থান ঘটল। তার সঙ্গে এল বৈভব। প্রমোদের পরিবারের ভোলও একেবারে বদলে গেল।

ক্ষুরধার বুদ্ধি ছিল প্রমোদের। কিন্তু সারা জীবন ধরে নানা ভয়ঙ্কর অভিযোগও তাড়া করে বেড়িয়েছে তাঁকে। সাংবাদিক শিবানী ভাটনগর হত্যা মামলায় আইপিএস অফিসার রবিকান্ত শর্মার স্ত্রী মধু শর্মা অভিযোগ করেছিলেন, শিবাজী হত্যার ষড়যন্ত্রের নায়ক প্রমোদই। প্রমোদ যখন অটলবিহারী বাজপেয়ীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হলেন, রবিকান্ত প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কাজ করতেন। প্রমোদের সঙ্গে রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠতা নিয়েও কম জলঘোলা হয়নি। অভিযোগ ওঠে, প্রমোদের ছেলেকে বিনা পয়সায় শেয়ার পাইয়ে দিয়েছিল ওই সংস্থা।

শ্যালক গোপীনাথকে ঘিরে কিন্তু কোনও দিন এ সব অভিযোগ ওঠেনি। ধীরুভাই অম্বানী যখন মারা যান, বিতর্কের ভয়ে তাঁর শেষকৃত্যে যাননি প্রমোদ। আডবাণী তখন গোপীনাথকেই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ গোপীনাথকে নিয়ে কখনও কোনও বিতর্ক ছিল না। তার একটা বড় কারণ, প্রমোদ অনেক বেশি বহির্মুখী ও রঙিন চরিত্র। সে তুলনায় গোপীনাথ অনেক বেশি অন্তর্মুখী ও সাদামাটা। দিল্লির রাজনৈতিক শিবিরে ইংরেজি তো দূর, ভাল করে হিন্দিতেও কথা বলতে পারতেন না গোপীনাথ। হিন্দি বলতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই মরাঠি শব্দ ঢুকে যেত। তবে একাধারে সেটা গোপীনাথের শক্তিও ছিল।

আসলে গোপীনাথ দীর্ঘদিন যাবৎ প্রমোদের উপরেই নির্ভরশীল ছিলেন। এমনকী ভাই প্রবীণ যখন গুলি করে দাদাকে হত্যা করেন, তখন চেঁচিয়ে বলেছিলেন, “সব সম্পত্তি তো শালাকেই দিয়ে দিচ্ছ! আমি আর কিছুই পেলাম না!” প্রমোদের মৃত্যুর পর প্রথম কয়েক বছর গোপীনাথ দিল্লিতে তেমন কিছু করে উঠতে পারেননি। এমনকী বিজেপির অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়, প্রমোদের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে তাঁর অনেক টাকাপয়সা বেহাত হয়ে যায়। হিসেব-রহিত সেই সব অর্থ চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনতে পারেননি গোপীনাথ।

নিজে এমনিতে আশির দশক থেকে মহারাষ্ট্রের বিধায়ক। তার পর ১৯৯০-২০০৯ টানা বিধায়ক থাকেন। ১৯৯৫-৯৯ উপমুখ্যমন্ত্রীও হন। কিন্তু দিল্লির কেরিয়ার শুরু হয় প্রমোদের মৃত্যুর পরেই। ২০০৬-এ মারা গেলেন প্রমোদ, আর গোপীনাথ প্রথম বার লোকসভায় জিতলেন ২০০৯-এ। তার পর এ বারে জিতে মন্ত্রিত্ব। কিন্তু সে সুখ আর সইল কই!

ইদানীং শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। প্রমোদ রোজ সকালে এক ঘণ্টা ট্রেডমিল করতেন। নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। গোপীনাথের সে সব বালাই ছিল না।

তিন মেয়ে। ছোট মেয়ে যশেশ্বরী আইনের ছাত্রী, মেজ মেয়ে প্রতিমা চিকিৎসক। বড় মেয়ে পঙ্কজা রাজনীতিতে এসেছেন।

নিজের এক সন্তানের হাতে অন্য সন্তানের মৃত্যু দেখতে হয়েছিল প্রমোদের মা-কে। প্রমোদের স্ত্রী রেখা তখনই মেয়ে পুনমকে রাজনীতিতে আসতে বারণ করে দিয়েছিলেন। পুনম কিন্তু এ বার গোপীনাথের হাত ধরেই মুম্বই থেকে জিতেছেন।

রাজনীতিতে গোপীনাথের নিজের মেয়ে পঙ্কজার হাতেখড়ি আরও আগে। ২০০৯-এই বিধায়ক হয়েছেন তিনি। এ বার গোপীনাথের প্রচারের অনেকটা নিজের হাতে সামলেছিলেন। আজ কিন্তু গোপীনাথের স্ত্রী ঠিক পুনমের মায়ের মতোই কাঁদতে কাঁদতে পঙ্কজাকে বললেন, “রাজনীতি থেকে এখনই পালিয়ে যা!”

যদি তাতে শাপমুক্তি ঘটে!

gopinath munde accident bjp jayant ghosal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy