সাংবাদিকদের মুখোমুখি শিবরাজ সিংহ চৌহান। ছবি: পিটিআই।
শিবরাজ সিংহ চৌহানের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যপম কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের দাবি আজ রাজনাথ সিংহ খারিজ করে দিলেন ঠিকই। কিন্তু ও দিকে ফের লাশ মিলল ঝিল থেকে!
গত ৪৮ ঘন্টায় এই নিয়ে তৃতীয় রহস্য মৃত্যু হল ব্যপম কাণ্ডে! দুর্নীতির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে শনিবার রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছিল সাংবাদিক অক্ষয় সিংহের। পর দিনই দিল্লির এক হোটেল থেকে অসার দেহ পাওয়া যায় এই কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত জব্বলপুর মেডিক্যাল কলেজের ডিন অরুণ শর্মার। ঘুম ভাঙার আগেই আজ কাকভোরে ফের মৃত্যুর খবর হইচই ফেলে দিল দেশ জুড়ে। পুলিশের ট্রেনি সাব ইনস্পেক্টর অনামিকা কুশহাওয়ার দেহ পাওয়া গেল মধ্যপ্রদেশের সাগর জেলার ঝিল থেকে। যিনি কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত নন ঠিকই, কিন্তু কাকতালীয় ভাবে চাকরিটি পেয়েছিলেন ব্যপমের পরীক্ষার মাধ্যমে।
ব্যপমে মৃত্যু মিছিল চলছিলই। কখনও অভিযুক্ত, কখনও সাক্ষী, কখনও বা রাজসাক্ষী। এক দুই করে সংখ্যা গত চার বছরে পৌঁছে গিয়েছিল ২৪-এ। কিন্তু শেষ তিনে এ বার জবর চাপে পড়ে গেলেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান তথা বিজেপি। চাপ বাড়ল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপরেও। দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন কায়েম করতে পেরেছেন বলে সম্প্রতি তার প্রথম বছরের মেয়াদ শেষে বুক বাজিয়ে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তার পর গত এক মাসে প্রথমে ললিত কাণ্ডে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরার নাম জড়িয়ে যাওয়া, স্মৃতি ইরানির বিরুদ্ধে মিথ্যা হলফনামা দেওয়ার ঘটনা, ছত্তীসগড়ের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ৩৬ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এবং সর্বোপরি ব্যপম কেলেঙ্কারি সেই দাবির ভিত আলগা করে দিয়েছে বলেই মনে করছেন রাজনীতির কুশীলবেরা। আর বিরোধীরা বলছেন, কেলেঙ্কারির কাদায় এখন মাখামাখি অবস্থা বিজেপি-র।
স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে শিবরাজ সিংহ চৌহানের ইস্তফা চেয়ে আজ জোরালো দাবি তুলেছে কংগ্রেস। সেই সঙ্গে তাঁদের এ-ও দাবি, শিবরাজের তত্ত্বাবধানেই তিন বছর ছিল মধ্যপ্রদেশের চিকিৎসা শিক্ষা দফতর। সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধেই বা তদন্ত হবে না কেন? বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব, তাঁর স্ত্রী সাধনা সিংহ-সহ তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধেও যখন অভিযোগ রয়েছে, তখন শিবরাজের ভূমিকা কেনই বা খতিয়ে দেখা হবে না। এ জন্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্তও দাবি করেছে কংগ্রেস।
বিজেপি অবশ্য তাদের নিজস্ব টোটকা এ ক্ষেত্রেও খাটানোর চেষ্টা করছে। অর্থাৎ, বসুন্ধরা বা সুষমার প্রতিরক্ষায় বিজেপি গোড়া থেকে যে কৌশল নিয়েছিল, শিবরাজের জন্যও সেই পথ নিয়েছে। সিবিআই তদন্তের দাবির মুখের উপরেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সঙ্ঘ এবং বিজেপি নেতৃত্ব স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ ব্যাপারে বিরোধীদের দাবির সামনে মাথা নোয়ানো হবে না। এ জন্য মহিলা সাব ইনস্পেক্টরের মৃত্যুর ঘটনাটিকে আজ ঢাল করেন শিবরাজ। বলেন, সব মৃত্যুই ব্যপমের সঙ্গে মেলানো ছেলেমানুষি হচ্ছে। ওই মহিলা আত্মহত্যা করেছেন পারিবারিক বিবাদের জেরে। আবার রাজনাথ আজ ভোপাল গিয়েছিলেন সম্প্রতি নিহত বিজেপি সাংসদ দিলীপ সিংহ ভুরিয়ার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। তার পর শিবরাজকে পাশে নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ব্যাপারটা বুঝতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশে স্পেশাল টাস্ক ফোর্স ঘটনার তদন্ত করছে। হাইকোর্টই সিবিআই তদন্তের দাবি খারিজ করে দিয়েছে। এখন কী ভাবে সরকার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। তবে এটুকু বলতে পারি, আদালত নির্দেশ দিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে একটুও দেরি করব না।’’
প্রশ্ন হল, আদালত সেই নির্দেশ দেবে কি? ব্যপম কাণ্ডে আদালতের নজরদারিতে সিবিআই তদন্ত চেয়ে এর মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে কড়া নেড়েছেন অনেকেই। কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহও পাঁচ দিন আগে এ বিষয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন। তা ছাড়া আম আদমি পার্টি নেতা কুমার বিশ্বাসও আজ আদালতে যান। এই অবস্থায় মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল তথা ব্যাপম কাণ্ডে অভিযুক্ত রামনরেশ যাদবের বিরুদ্ধে মামলা শুনতে অন্তত রাজি হয়েছে আদালত।
কংগ্রেস আইনি পথ ও রাজনৈতিক আন্দোলন, উভয়কেই এখন সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। ব্যপম কাণ্ডে দুর্নীতির বহরটা বেশ বড়। বিশেষ করে কোনও দুর্নীতির ঘটনায় ৪৬ জনের রহস্য মৃত্যুটা ছোট ব্যাপার নয়। কংগ্রেস মনে করছে, স্রেফ এই পরিসংখ্যানটা তুলে ধরে বিজেপি-র বিরুদ্ধে একটা নেতিবাচক মনোভাব গোটা দেশে তৈরি করা যেতে পারে। আবার আইনি দিকটিরও গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, তদন্ত ঠিকমতো হলে কার না কার নাম বেরিয়ে আসবে কেউ জানে না। কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ আজ বলেন, এক সময় এই বোর্ডের মাধ্যমে কেবল চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রবেশিকা পরীক্ষা হত। পরে পুরোদস্তুর রাজ্য সরকারি চাকরি পরীক্ষা বোর্ডে রূপান্তরিত করেন শিবরাজ। তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ব্যপমের মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাকরণ ছুড়ে ফেলা হয়। কখনও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, কখনও আগাম টাকা নিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কখনও বা প্রার্থীর পরিবর্তে ভিন রাজ্য থেকে ছেলেমেয়ে এনে নাম ভাঁড়িয়ে পরীক্ষা দেওয়ানো হয়েছে। এবং তাতে শুধু মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনেরা নন, আমলাতন্ত্রের একাংশ, রাজ্যপাল, তাঁর ছেলে, এবং বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের অনেক নেতার নাম জড়িয়ে গিয়েছে। হিসাব মতো গোটা ঘটনায় ৩৮০০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৮০০ জন ফেরার। মৌলিক প্রশ্ন হল, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠেরা যখন অভিযুক্ত, তখন রাজ্য সরকারের তদন্ত এজেন্সি দিয়ে কি নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে?
যদিও একটা আশঙ্কা রয়েছে যে, কংগ্রেসেরও রাজ্যস্তরের এক বা দু’জন নেতার নাম বেরোতে পারে কেলেঙ্কারিতে। জবাবে দিগ্বিজয় বলেন, তা হলে সেই কংগ্রেস নেতাকেও জেলে পাঠানো হোক।
তবে বিজেপি নেতারা মনে করছেন, চুপ করে থাকাটাই বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে। ঠিক যে ভাবে বসুন্ধরা বা সুষমার ঘটনাটি এত দিনে লঘু হয়ে গিয়েছে, সে ভাবেই শিবরাজকে সরানোর দাবিও থেমে যাবে। তা ছাড়া, কৌশলে বিজেপি এখন এটাও প্রমাণ করতে চাইছে, সাংবাদিক বা জব্বলপুর মেডিকেল কলেজের ডিনের মৃত্যুর সঙ্গে ব্যপমের কোনও সম্পর্ক নেই। এই দুই মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে শিবরাজ সরকার যে ভাবে খোলামনে এগিয়ে এসেছেন এবং মৃতের পরিবারের দাবিমতো সবরকম তদন্ত করছেন তা-ও তুলে ধরা হচ্ছে। তা ছাড়া দলের মুখপাত্র সম্বিত পাত্র আজ বলেন, আদতে সরকারি হিসাবে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। সেটাই বাড়িয়ে চড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। আবার দিগ্বিজয় সিংহের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়াতেও কৌশলে কুৎসা রটানোর ব্যবস্থা করছে বিজেপি। এ কথা ছড়ানোর চেষ্টা করছে, দিগ্বিজয় যাঁদের সঙ্গে দেখা করছেন, যাঁদের সতর্ক করছেন, তাঁদেরই মৃত্যু হচ্ছে কেন? তা সে মহারাষ্ট্রের পুলিশকর্তা হেমন্ত কাড়কাড়েই হোন বা সাংবাদিক অক্ষয় সিংহ?
অন্য কথা প্রসঙ্গে দিগ্বিজয় অবশ্য আজ বলেছেন, ‘‘ব্যপমে যাঁর যাঁর নাম উঠে আসছে তাঁদের সবার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে হবে। আমার নাম এলে আমাকেও জেলে পুরে জেরা করা হোক। কিন্তু ২৬ জনের মৃত্যু কম কথা! চোখের সামনে তাঁর পৌরহিত্যে এত বড় দুর্নীতি হল আর শিবরাজ এখনও মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে যাবেন। চলবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy