কংগ্রেস জিতবে কেউই বোধ হয় ভাবেননি। তা বলে এ রকম ডাহা ফেল! খোদ অমেঠীতেও কিনা জিততে হল বেশ কয়েক বার পিছিয়ে পড়ে। প্রশ্ন উঠেছে, দলে কর্তৃত্ব ধরে রাখা দূরস্থান, মুখ দেখাবেন কী করে রাহুল গাঁধী?
পরাজয়ের নৈতিক দায় নিতে অবশ্য এত দিনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন রাহুল। আজও তিনি দেরি করেননি। দেওয়ালের লিখন মোটামুটি স্পষ্ট হতেই মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসেন দশ নম্বর জনপথ থেকে। মুখে আগাগোড়া বিভ্রান্তির হাসি। তার পর বলেন, “কংগ্রেস খুবই খারাপ ফল করেছে। কী কারণে এই বিপর্যয়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। তবে দলের সহ-সভাপতি হিসেবে এই হারের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।”
কিন্তু রাহুলের আত্মসমীক্ষা থাক। তাঁকে নিয়ে দলের নেতারা কী বলছেন?
শাকিল আহমেদ, বি কে হরিপ্রসাদ-সহ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশ সদস্য অবশ্য নির্বাচনী ব্যর্থতার দায় একা রাহুলের ঘাড়ে চাপাতে নারাজ। ফলাফল বিশ্লেষণ করে তাঁরা বলছেন, দেশ জুড়ে এ বার বিপুল প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা তৈরি হয়েছিল। রাহুল কেন, সেই সুনামি ঠেকানোর ক্ষমতা কারও ছিল না। শাকিলের কথায়, “নামে জোট সরকার চললেও, কেন্দ্রে শাসক দল হিসেবেই পরিচিত ছিল কংগ্রেস। তাই মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতির অভিযোগ, নীতিপঙ্গুত্ব, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মতো বিষয়ে মানুষের ক্ষোভের পুরোটাই এসে পড়েছে কংগ্রেসের ওপর। অথচ এগুলির উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল না রাহুলের। তাই একা তাঁকে দোষ দেওয়াটা ভুল হবে।”
তা হলে কংগ্রেস সহ-সভাপতির কোনও ব্যর্থতা নেই? গাঁধী পরিবারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলার মতো কোনও শরদ পওয়ার বা পূর্ণ সাংমা এই মুহূর্তে কংগ্রেসে নেই। গত রাতেই দলের সকলকে পইপই করে বলে দেওয়া হয়, কোনও ভাবেই রাহুলকে দায়ী করা চলবে না। বলতে হবে এই পরাজয়ের দায় দলের সকলের।
তবে প্রকাশ্যে না বললেও রাহুল সম্পর্কে কংগ্রেসে কাঁটাছেড়া শুরু হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। এমনকী একদা সনিয়া-ঘনিষ্ঠ মধ্যপ্রদেশের এক নেতার মতে, বিরাট সুযোগ হারালেন রাহুল। তাঁকে নেতা করা ছাড়া কংগ্রেসের বিকল্প ছিল না। গোটা দল ছিল তাঁর পাশে। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের নেতা হয়ে উঠতে পারতেন তিনি। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। তাঁর কথায়, কংগ্রেসের পরাজয় এ বার ভবিতব্যই ছিল। কিন্তু এই নেতিবাচক পরিস্থিতির মাঝে লড়াইয়ের মানসিকতা গড়ে দেওয়াটাই নেতার কাজ। সেই ব্যাপারে গোটা দল যখন তাঁর দিকে হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে ছিল, নিতান্তই হতাশ করেছেন রাহুল। গত এক বছর ধরে তাঁর হাবেভাবে যে ছবিটা তুলে ধরেছেন, তাতে এই বার্তাই গিয়েছে দলের সামনের সারিতে থেকে লড়তেই প্রস্তুত নন তিনি। রাজনীতি করলে বিরোধী আসনে বসাও শিখতে হয়। বিজেপি যখন দেড় বছর আগেই তাদের সেনাপতিকে ময়দানে নামিয়ে দিয়েছে, তখন মাঠে নামতে আগাগোড়া ইতস্তত করে গিয়েছেন রাজীব-পুত্র। তিনি প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হবেন, নাকি স্রেফ প্রচারে নেতৃত্বে দেবেন, তা স্থির করতে করতেই কেটে গিয়েছে গোটা একটা বছর।
হারের ময়নাতদন্তে নেমে দলের একাধিক নেতা আজ এ কথাও বলেন, এমন নয় যে রাজনীতিতে হঠাৎই এসে পড়েছেন রাহুল। বরং রাজনীতি তাঁর রক্তে রয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি বুঝতে পারেননি এ দেশে রাজতন্ত্রের ঘোর এখনও কাটেনি। মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি ও নিত্যদিনের নানান দুর্ভোগ থেকে বাঁচতে মানুষ এক জন বলিষ্ঠ ত্রাতা চাইছেন। সেখানে সমষ্টিগত নেতৃত্বের মতো কেতাবি কথাবার্তা অচল। কিন্তু প্রবীণরা নিষেধ করলেও সেটাই আঁকড়ে থেকেছেন রাহুল। শেষমেশ কংগ্রেস অধিবেশন থেকে যখন তাঁকে নেতা হিসাবে ঘোষণা করা হল, তত ক্ষণে মসনদের অভিমুখে অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে গিয়েছেন মোদী। গোটা দেশে প্রচারের ঝড় তুলেছেন। পটনার গাঁধী ময়দান থেকে তাঁর হুঙ্কার টলিয়ে দিয়েছে আসমুদ্র হিমাচল কংগ্রেসের ভিত। টিভি চ্যানেলের এয়ার টাইম, সোশ্যাল মিডিয়ার বারো আনা তখনই মোদী-বাহিনীর মুঠোয়। আর সেই অবস্থায় নামে কংগ্রেসের কান্ডারি হলেও কাজে খাটো হয়ে থেকেছেন রাহুল।
কংগ্রেস নেতৃত্বের মতে, আদতে ভোটে এ বার বড় ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্যাঁচ খেলেছে বিজেপি। আর সেই প্যাঁচে ভোটের তিন মাস আগেই মাজা ভেঙে গিয়েছে কংগ্রেসের। এরও অন্যতম কারণ রাহুল। কেননা মোদী যখন তাঁকে ‘শাহজাদা’ বলে নিশানা করেছেন, তখন পাল্টা আগ্রাসন দেখাতে পারেননি রাহুল। পরিবর্তে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি ধরে প্রচার করেছেন তিনি। তা নিয়ে মানুষ যতটা না খুশি হয়েছেন, তার থেকে বেশি হাসাহাসি হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিশেষ করে ভোটের আগে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ও প্রচারসভায় রাহুল এমন অর্বাচীনের মতো কথা বলেছেন যে কংগ্রেস নেতারা নিজেরাই লজ্জায় পড়ে গিয়েছেন। মোদী গরিবি নিয়ে প্রশ্ন তুললে রাহুল বলেন, দারিদ্র আসলে মনের একটা অবস্থা মাত্র। শিখ দাঙ্গা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমি তখন রাজনীতিতে ছিলাম না।” তাঁর সেই জবাব দেখে হাত কামড়েছেন দলের নিচু তলার নেতারাও। আর শ্লেষ মেশানো বাক্যবাণে রাহুল ও তাঁর দলবলকে নাস্তানাবুদ করে হাসির খোরাক করে তুলেছেন মোদী।
তবে কংগ্রেসের কিছু প্রবীণ নেতার মতে, এই সব ভুলের পিছনেও একটা বড় ভুল রয়েছে। এমনকী দলের এক শীর্ষ নেতা আজ এ কথাও বলেন, রাহুল রাজনীতিটাই বোঝেন কি না সন্দেহ। সব বিষয়েই তিনি একটা আকাশকুসুম ধারণা পোষণ করেন। তাই কখনও দলিতের ঘরে রাত কাটিয়ে রোমান্টিকতা প্রদর্শন করেন। কখনও বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে গিয়ে বল্গাহীন হয়ে নিজেদের সরকারের আনা অর্ডিন্যান্সই ছিঁড়ে ফেলার কথা বলেন। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর যেমন অমর্যাদা হয়েছে, তেমনই রাহুলের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
শুধু তাই নয়, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে রাহুলের ফর্মুলাও আজ প্রশ্নের মুখে পড়েছে। প্রবীণদের মতে, সংগঠন তৈরির নামে গত দশ বছর অযথা সময় নষ্ট করেছেন রাহুল। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে একের পর এক রাজ্যে যুব কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচন করেছেন। তাতে নেতা তো বিশেষ উঠে আসেইনি, উল্টে আঞ্চলিক নেতাদের চটিয়ে ফেলেছেন রাহুল। রাজনীতিতে অপরিণত যুব নেতাদের মাথায় তুলে প্রবীণদের ডানা ছাঁটা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী যখন অমিত শাহ-র মতো এক জন পোড় খাওয়া নেতাকে তাঁর রাজনৈতিক ম্যানেজার করেছেন, তখন রাহুল খুঁজে খুঁজে ধরে এনেছেন কিছু সমাজসেবী ও টেকনোক্র্যাটকে, যাঁদের সঙ্গে মাটির কোনও যোগই নেই। মধুসূদন মিস্ত্রী, মোহন গোপাল, জয়রাম রমেশের মতো এ ধরনের নোতারাই গত পাঁচ বছরে হয়ে উঠেছেন রাহুলের মন্ত্রগুরু। সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক না-থাকা এই মধুসূদনই এ বার গোটা দেশ ঘুরে কংগ্রেসের প্রার্থী বাছাই করেছেন।
কেবল রাহুল নন, তাঁর এই পরামর্শদাতাদের ওপরেও তাই আজ রাগ ঝরে পড়েছে কংগ্রেসে। শাকিল আহমেদ আজ খোলাখুলিই বলেন, “কোনও নেতার পক্ষে সব দিকে চোখ রাখা সম্ভব নয়। সেটা তাঁর পরামর্শদাতাদের কাজ। ব্যর্থতার দায় তাই তাঁদেরও নিতে হবে বইকি।” নাম না-করলেও শাকিলের মতো নেতারা আজ জয়রাম রমেশদেরই নিশানা করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদীই যে এ বার বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হতে চলেছেন, তা দেড় বছর আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মোদীকে ঠেকাতে তখনই সক্রিয় হতে পারত কংগ্রেস। তাঁকে তাঁর ভাষাতেই জবাব দিতে পারত। কিন্তু এ ব্যাপারে রাহুলের পরামর্শদাতারাই রাহুলকে বিভ্রান্ত করেন। তাঁকে বোঝানো হয়েছে, মোদী সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করলে তিনি বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে যাবেন। বস্তুত এক বছর ধরে কার্যত ফাঁকা মাঠেই এগিয়ে গিয়েছেন মোদী।
তবে ঘরোয়া আলোচনায় প্রবীণরা বলছেন, রাহুল গাঁধী এর মধ্যেই দশ-দশটা বছর নষ্ট করেছেন। তাঁর হাতে রয়েছে বড় জোর পাঁচ বছর। এর মধ্যে না-পারলে আর কোনও দিনই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না তিনি। যদি না বোন প্রিয়ঙ্কা এসে নতুন ইনিংস শুরু করেন, ভারতের রাজনীতিতে হয়তো ইতিহাসই হয়ে যাবে গাঁধী পরিবারের প্রভাব।