Advertisement
২১ মে ২০২৪

শীর্ষ আদালতের যুক্তি ভুল, বলছেন জেটলি

জমি ছাড়তে রাজি নয় সরকার— পরশু সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরোনোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রাক্তন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বিচারপতি নিয়োগের নয়া আইন বাতিল করা নিয়ে এ বার কলম তুললেন নরেন্দ্র মোদী সরকারের আর এক প্রাক্তন আইনমন্ত্রী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:০০
Share: Save:

জমি ছাড়তে রাজি নয় সরকার— পরশু সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরোনোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রাক্তন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বিচারপতি নিয়োগের নয়া আইন বাতিল করা নিয়ে এ বার কলম তুললেন নরেন্দ্র মোদী সরকারের আর এক প্রাক্তন আইনমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি আজ ফেসবুকে দীর্ঘ এক নিবন্ধে চাঁছাছোলা সমালোচনা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের। আইনি বিষয়ে তাঁর মতামতই প্রাধান্য পেয়ে থাকে সরকারে। তাই নিবন্ধের শেষে ‘ব্যক্তিগত মত’ কথাটি লেখা থাকলেও নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে সংঘাতেই যেতে চাইছে, জেটলির নিবন্ধ আজ স্পষ্ট ভাবে সেই বার্তাই দিল।

রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের আশঙ্কা প্রকাশ করে বিচারপতি নিয়োগের নয়া আইন বাতিল করেছে শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ। ওই রায়ে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুরুত্বকে লঘু করে দেখার, এমনকী অপব্যাখ্যা করার অভিযোগ এনেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জেটলি। তাঁর মতে, ‘‘ভ্রান্ত দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।’’ তাঁর এ-ও বক্তব্য, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের রায় চূড়ান্ত হলেও তা অব্যর্থ নয়। গণতন্ত্রে অনির্বাচিতদের স্বৈরাচার চলতে পারে না।’’

অর্থমন্ত্রীর এই ধরনের শব্দচয়ন এবং তার ধার ও ভার থেকে এই ধারণাই জোর পেয়েছে যে, শীর্ষ আদালত কিছুটা ঘষামাজা করে বিচারপতি নিয়োগের পুরনো কলেজিয়াম ব্যবস্থা চালু রাখার কথা বললেও সরকার তাতে সায় দেবে না। বরং জাতীয় বিচারপতি নিয়োগের বাতিল হওয়া আইনটিই সংশোধন করে নতুন করে পাশ করানোর চেষ্টা করবে। যাতে জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন গঠন করে তার মাধ্যমেই বিচারপতিদের নিয়োগ করা যায়।

কলেজিয়াম ব্যবস্থায় ইতি টেনে জাতীয় বিচারপতি কমিশনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থা করতে সংসদে বিল পেশ হয়েছিল মনমোহন সিংহের জমানাতেই। তখন সেটি পাশ হয়নি। বিলটিতে কিছুটা সংশোধন করে বর্তমান মোদী জমানায় বিলটি সংসদে পাশ হয়। কিন্তু মোদী সরকারের যোগ করা প্রস্তাবগুলি নিয়েই মূলত আপত্তি জানিয়েছে শীর্ষ আদালতের সংবিধানিক বেঞ্চ। তাদের মতে, এই ব্যবস্থায় বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা রয়েছে পুরোদস্তুর। কারণ, ছয় সদস্যের কমিশনে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী ও অন্য এক জন সদস্য আপত্তি জানালেই কোনও বিচারপতির নিয়োগ আটকে যেতে পারে। ফলে বিচারপতির নিয়োগ অনেকটাই নির্ভর করবে রাজনীতিকদের পছন্দের অপছন্দের ওপরে।

আদালতের এই যুক্তি নিয়েই আজ প্রশ্ন তুলেছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে রক্ষা করার যুক্তি দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনটি বাতিল করে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বৃহত্তর সাংবিধানিক কাঠামোকে উপেক্ষা করেছে আদালত। সাংবিধানিক কাঠামোয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল সংসদীয় গণতন্ত্র। তার পরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল নির্বাচিত সরকার, যা দেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। সংসদীয় গণতন্ত্রে এর পর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়বদ্ধতা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতার। কিন্তু এঁদের সবাইকে এক কথায় রাজনীতিক তকমা দিয়ে ছুড়ে ফেলে এ কথা বলা ঠিক নয় যে, ভারতীয় গণতন্ত্রকে নির্বাচিত সদস্যদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট আদালতের নিরপেক্ষতার কথা ভেবেছে ঠিকই, কিন্তু সাংবিধানিক কাঠামোর আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করেছে। তা হল, সংসদীয় গণতন্ত্র, নির্বাচিত সরকার, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা, নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা। এই সূত্রেই জেটলির ঝাঁঝালো মন্তব্য, ‘‘ভারতীয় গণতন্ত্র কখনওই অনির্বাচিতদের স্বৈরাচারের শিকার হতে পারে না, তা যদি হয়, তা হলে গণতন্ত্র বিপদে পড়তে বাধ্য।’’

জেটলির এ-ও বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনার এবং কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলকেও সরকার নিয়োগ করে। তার মানে কি তাঁরা নিরপেক্ষ এবং বিশ্বাসযোগ্য নন?

সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা পরশু রায় ঘোষণার সময় লালকৃষ্ণ আডবাণীর সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করেছিলেন। আডবাণী বলেছিলেন, দেশে জরুরি অবস্থার মতো পরিবেশ তৈরির আশঙ্কা এখনও রয়েছে। বিজেপি-র বর্ষীয়ান নেতার ওই মন্তব্যকে সামনে রেখে আদালত বলে, একমাত্র সুপ্রিম কোর্টই তখন মানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আদালতের সেই মতেরও আজ সমালোচনা করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। তিনি লিখছেন, সত্তরের দশকে যখন দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, তখন রাজনীতিকরাই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আদালতই বরং আপস করেছিল।

এ ছাড়াও সংবিধানের ১২৪ ও ২১৭ অনুচ্ছেদের ‘ভুল ব্যাখা’ করার জন্য আজ সর্বোচ্চ আদালতের সমালোচনা করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ওই দুই অনুচ্ছেদে যথাক্রমে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট নিজেদের সুবিধা অনুসারে বারবার তার ব্যাখ্যা করেছে। আর এ বার আদালত যে ব্যাখ্যা করেছে তাতে বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ভূমিকাই প্রায় তুলে দিতে চেয়েছে। আদালত কখনওই তৃতীয় আইনসভা হতে পারে না।

তবে প্রশ্ন হল, সরকার যদি এতটাই অনমনীয় অবস্থান নিয়ে চলছে, তা হলে তাদের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ কী হবে? বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, আইন প্রণয়ন করা আইনসভার কাজ। তা সুপ্রিম কোর্টের কাজ নয়। সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রেক্ষিতে, সংশ্লিষ্ট আইনটি মাজাঘষার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে সরকার।

তার জন্য আবার সংবিধান সংশোধন করতে হবে। যেটা করতে গেলে কংগ্রেস-সহ প্রায় সব দলের সমর্থন পেতে হবে সরকারকে। আগের বার সরকার তা পেয়েছিল। ২০টি রাজ্যও অনুমোদন দিয়েছিল ওই আইনে। এ বার কি সরকার সমর্থন পাবে কংগ্রেসের? সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে কংগ্রেসের ঘোষিত অবস্থান ও জেটলির নিবন্ধের সমালোচনায় কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সূরজেওয়ালা আজ যে কড়া বিবৃতি দিয়েছেন তা কিন্তু সেই আশায় জল ঢালতে শুরু করেছে এখনই। লোকসভা ভোটের পরপর গুটিয়ে যাওয়া কংগ্রেস হয়তো সমর্থন দিয়েছিল মোদী সরকারের আনা বিলে। কিন্তু মোদীর জমি অধিগ্রহণ আইন সংস্কারের চেষ্টায় জল ঢেলে দিতে পেরে সনিয়া ও রাহুল গাঁধীর দল এখন তুলনায় বেশি আত্মবিশ্বাসী। নতুন করে আইন প্রণয়নের চেষ্টা হলে তারা সহজেই সমর্থন জোগাবে, এমনটা মনে করা যাচ্ছে না।

কংগ্রেসও এখনও চায়, বিচারপতি কমিশন গড়েই বিচারপতি নিয়োগ হোক। কিন্তু আদালতের রায় থেকে তারা এখন রাজনৈতিক সুযোগ নিতেও তৎপর। মোদী সরকার কংগ্রেস জমানার বিলটিতে কিছু সংশোধন করে সেটি পেশ করেছিল সংসদে। বিলটিতে সমর্থন দিলেও কংগ্রেস তখনই ওই সংশোধন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি, কপিল সিব্বলদের বক্তব্য ছিল, সরকারের বিলে দু’টি দুর্বলতা রয়েছে। কমিশনের ৬ জন সদস্যের মধ্যে যে কোনও দু’জন আপত্তি করলেই কোনও বিচারপতিকে নিয়োগ করা যাবে না— এই প্রস্তাব ঠিক নয়। কমিশনের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে ৭ করে গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্যের মত নিয়ে বিচারপতি নিয়োগ করা হোক। তা ছাড়া, সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে আইনের দাওয়াই দেওয়াটা ভুল। সুপ্রিম কোর্টের এক জন প্রধান বিচারপতি অবসর নেওয়ার আগে সর্বোচ্চ আদালতের বাকি বিচারপতিদের মধ্যে যিনি সব থেকে বর্ষীয়ান, তাঁকেই পরবর্ত়ী প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কমিশন সেই অধিকারও কেড়ে নিতে চেয়েছে, এবং ৫(১) ধারা অন্তর্ভুক্ত করে বলা হয়েছে, সব থেকে সিনিয়র বিচারপতিকে তখনই পরবর্তী প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ করা হবে ‘যদি তিনি উপযুক্ত (ফিট) হন’। সর্বোচ্চ আদালতে এই প্রস্তাব খারিজ হওয়ারই ছিল। ফলে নতুন করে আইন তৈরির চেষ্টা হলে কংগ্রেস তাদের মতই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালাবে। তাদের মত না মানলে বিলে সমর্থন দিতে রাজি হবে না।

যার অর্থ, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সমালোচনা করে জেটলি আজ মোদী সরকারের অস্বস্তি কাটানোর একটা চেষ্টা চালালেন বটে, বিচারপতি নিয়োগ কমিশন গঠনের পথ এখনও বেশ দুর্গম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE