কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়ার জাতীয় প্রাসাদ। ছবি: এপি।
চিনা বিনিয়োগে তৈরি হতে থাকা দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেল প্রকল্প বাতিল করল মালয়েশিয়া। প্রকল্পের খরচ মাত্রাতিরিক্ত বেশি, এই যুক্তি দেখিয়েই চিন-মালয়েশিয়া যৌথ প্রকল্প ‘ইস্ট কোস্ট রেল লিঙ্ক’ থেকে বেরিয়ে গেল কুয়ালালামপুর। এই প্রকল্পের খরচ ছিল ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমান প্রায় এক লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। মালয়েশিয়া এই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় নিশ্চিত ভাবেই ধাক্কা খেল চিন। কারণ, ‘ইস্ট কোস্ট রেল লিঙ্ক’ চিনের গুরুত্বপূর্ণ ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
শনিবারই মালয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রী আজমিন আলি এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। প্রকল্পের খরচ অত্যন্ত বেশি হওয়ার পাশাপাশি চড়া চিনা সুদের কারণেই মালয়েশিয়া এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল বলে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘দেশের পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূল জোড়ার জন্য এই রেলপথ বানাতে যা খরচ হবে, তা দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য আমাদের নেই। এই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে না গেলে শুধু সুদ হিসেবেই প্রতি বছর চিনকে দিতে হবে ৫০০ মিলিয়ন রিঙ্গিত। দু’দিন আগেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ’’
৫০০ মিলিয়ন রিঙ্গিত অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৮৬০ কোটি টাকা। চিনা বিনিয়োগে এই রেল প্রকল্প তৈরি হচ্ছে বলে সুদ হিসেবে এই বিপুল পরিমাণ টাকা বেজিংকে দিতে বাধ্য কুয়ালালামপুর। সেই ঋণের ফাঁস থেকে মুক্তি পেতেই চিনকে ‘না’ বলল মালয়েশিয়া, এমনটাই জানানো হচ্ছে সরকারি ভাবে।
আরও পড়ুন: চিনের অস্বস্তি বাড়িয়ে ভারতের সঙ্গে যৌথ মহড়ায় আসছে আফ্রিকার ১২ দেশ
এই মুহূর্তে তীব্র অর্থসঙ্কটে ভুগছে মালয়েশিয়া। সামগ্রিক ঋণের বোঝা দাঁড়িয়েছে ১৭ লক্ষ কোটি টাকা। বাধ্য হয়েই একের পর এক প্রকল্প বাতিল করছে মালয়েশিয়া সরকার। যদিও ‘ইস্ট কোস্ট রেল লিঙ্ক’ থেকে বেরিয়ে যাওয়া তার মধ্যে অন্যতম, কারণ শুধুই আর্থিক বা পরিকাঠামোগত বা বাণিজ্যিক নয়, এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল চিন। তাই বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে অন্তর্দেশীয় কূটনীতিও।
মালয়েশিয়ার আগের প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ওঠা-বসা ছিল চিনের। সেই সম্পর্কের সুযোগ নিয়েই মালয়েশিয়ার সঙ্গে একের পর এক যৌথ প্রকল্প শুরু করে দেয় চিন। প্রতিটি প্রকল্পের পিছনেই ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি আর চড়া হারে চিনা সুদ আরোপ করার অভিযোগ উঠেছিল মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। এমন অভিযোগও উঠেছিল যে নিজের পাহাড় প্রমাণ আর্থিক তহবিল তছরুপের বিষয়টিতে ধামাচাপা দিতেই চিনের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন নাজিব। সেই অভিযোগের জেরেই টানা ন’বছর ক্ষমতায় থাকায় পর গত বছরের মে মাসে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে হারেন নাজিব আর ক্ষমতায় ফেরেন মুহাথির মহম্মদ।
আরও পড়ুন: ঋণের ফাঁদে ইসলামাবাদ, বন্ধুত্বের মুখোশে পাকিস্তানে লুঠ চালাচ্ছে চিন?
ক্ষমতায় এসেই আর্থিক দুর্নীতি আর পাহাড় প্রমাণ ঋণের উৎস খুঁজতে চিন-মালয়েশিয়া যৌথ প্রকল্পগুলির দিকে বিশেষ নজর দেন মুহাথির। আর তখনই বেরিয়ে আসে এই সব চুক্তিতে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির হদিশ। কিছু দিন আগেই হতাশ হয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘‘ চিনকে আমরাই প্রকল্পের বরাত দিচ্ছি, আমরাই চিনের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছি, প্রকল্পের সমস্ত কাঁচা মাল এবং যন্ত্রাংশ চিন থেকে আমদানি করছে চিনা কোম্পানিরা, শ্রমিকও নিয়ে আসা হচ্ছে চিন থেকে, আবার এই প্রকল্পের জন্য বাণিজ্যিক সুবিধাও পাবে চিনই। আমি এই ধরনের এক পেশে চুক্তিতে বিশ্বাসী নই।’’
যদিও এই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মালয়েশিয়ার কাছে বিপুল পরিমাণ আর্থিক জরিমানা দাবি করতে পারে চিন। সেই জরিমানা কত হতে পারে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার।
চিনা ঋণের বোঝা থেকে বাঁচতে মালয়েশিয়া বেরিয়ে গেলেও এই ঘটনায় বড়সড় ধাক্কা খেল চিন। কারণ, এই প্রকল্প ছিল তাঁদের স্বপ্নের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের অংশ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপ, এই তিনটি মহাদেশকে রেল, সড়ক, বিমান এবং সমুদ্রপথে যুক্ত করে দেওয়াই আসল চিনা পরিকল্পনা। যার বাণিজ্যিক সুফল নিশ্চিত ভাবেই পাবে চিন। ‘ইস্ট কোস্ট রেল লিঙ্ক’ থেকে মালয়েশিয়া বেরিয়ে যাওয়ায় তাই বড় ধাক্কা চিনের কাছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক বিরোধ, আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ- সব গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের আন্তর্জাতিক বিভাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy