Advertisement
২৪ মার্চ ২০২৩

জুনিয়র ডাক্তারদের ‘বাগে’ আনার পথ খুঁজছে রাজ্য

কখনও রোগীর বাড়ির লোকেদের উপরে চড়াও হওয়া, কখনও রোগীর সঙ্গেই দুর্ব্যবহার। আবার কখনও হস্টেলে আকণ্ঠ মদ ও মাত্রাতিরিক্ত মাদক খেয়ে গোলমাল। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের বিরুদ্ধে এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণের অভিযোগ গত কয়েক বছরে বার বার উঠেছে। রবিবার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হস্টেলে চোর সন্দেহে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারার ঘটনা যার সর্বশেষ উদাহরণ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৩২
Share: Save:

কখনও রোগীর বাড়ির লোকেদের উপরে চড়াও হওয়া, কখনও রোগীর সঙ্গেই দুর্ব্যবহার। আবার কখনও হস্টেলে আকণ্ঠ মদ ও মাত্রাতিরিক্ত মাদক খেয়ে গোলমাল। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের বিরুদ্ধে এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণের অভিযোগ গত কয়েক বছরে বার বার উঠেছে। রবিবার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হস্টেলে চোর সন্দেহে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারার ঘটনা যার সর্বশেষ উদাহরণ।

Advertisement

এই অবস্থায় সরকারের অন্দমহলে ভাবনা চলছে হস্টেলগুলির দায়িত্বে প্রাক্তন সেনাকর্মীদের আনা যায় কি না, তা নিয়ে। কোথাও কোথাও জুনিয়র ডাক্তারদের কাউন্সেলিংও শুরু হয়েছে।

মাসখানেক আগের কথা। ঘটনাস্থল ওই এন আর এস। ক্লাস শেষ করে ফেরার পথে হাসপাতাল চত্বরে তৃতীয় বর্ষের কয়েক জন ছাত্রকে দেখে শিউরে উঠেছিলেন এক শিক্ষক-চিকিৎসক। দেওয়ালে ঠেসে ধরে এক কিশোরকে এলোপাথাড়ি চড়-থাপ্পড় মারছিলেন ওই ছাত্ররা। কিশোরের নাক-মুখ থেকে অঝোরে রক্ত পড়ছে। কী ব্যাপার? এক ছাত্র মারতে মারতেই সে দিন জবাব দিয়েছিলেন, “এটা একটা ছিঁচকে চোর। ওকে উচিত শিক্ষা দিচ্ছি।”

রবিবার দুপুরে সেই ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করে ওই শিক্ষক বললেন, “আমি না বাঁচালে সে দিন ছেলেটাকে মেরেই ফেলত ওরা। আমার চেনা ছাত্রদের চোখমুখ যে অমন হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। জীবন দেওয়ার দায়িত্ব নিতে চলেছেন যাঁরা, তাঁরা এমন নিষ্ঠুর হতে পারেন কী ভাবে তা বুঝতে পারছি না।”

Advertisement

ডাক্তারের চড়-থাপ্পড়ে রোগীর মৃত্যুর ঘটনার কথা ইদানীং মাঝেমধ্যেই সামনে আসছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই ঘটনাগুলি অনিচ্ছাকৃত বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এ দিনের ঘটনায় যে ভাবে দলবদ্ধ ভাবে এক তরুণকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে, তা তীব্র হিংসা, আক্রোশ এবং নিষ্ঠুরতা ছাড়া কোনও ভাবেই সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বেশির ভাগ মানুষ।

স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশের মতে, জুনিয়র ডাক্তারদের এ হেন তাণ্ডব নতুন কিছু নয়। হস্টেলে রাতবিরেতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মাঝেমধ্যেই নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। উদাহরণ হিসেবে এসএসকেএম-এর কথা টেনেছেন তাঁরা। দুই রাজনৈতিক দলের সমর্থক পড়ুয়াদের মধ্যে গোলমাল, রক্তারক্তি সেখানে নিত্য ঘটনা। বছর পাঁচেক আগে এই গোলমাল এমনই চূড়ান্ত আকার নিয়েছিল, যেখানে হাসপাতালের বাইরের রাস্তায় অস্ত্র হাতে নেমে পড়েছিলেন দুই দল পড়ুয়া। পরস্পরকে রক্তাক্ত করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তার পরেও কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মাস কয়েক আগে এসএসকেএমের হস্টেলেই অত্যধিক মাদক খেয়ে সপ্তর্ষি দাস নামে এক ইন্টার্নের মৃত্যু হয়েছে।

বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে মাস কয়েক আগেই এক জুনিয়র ডাক্তারের বিরুদ্ধে রোগীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছিল। এনআরএসে এক প্রসূতিকে চড় মারা ও তার পরে তাঁর মৃত্যুর অভিযোগকে ঘিরে স্বাস্থ্য দফতর তোলপাড় হয়েছে সম্প্রতি। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তাররা বছর কয়েক আগে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের শায়েস্তা করতে বাঁশ, লাঠি, বেল্ট নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন।

জুনিয়র ডাক্তাররা যে ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছেন তা স্বীকার করে নিয়েছেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, “এই ঘটনাটা যদি সত্যি হয়, তা হলে তা ভয়াবহ। শিক্ষকরা এখন ছাত্রদের সামলাতে পারছেন না। সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মীদের হস্টেল সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া যায় কি না, সে নিয়ে আমরা ভাবনাচিন্তা শুরু করেছি।”

এসএসকেএমের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “আমরা এখন জুনিয়র ডাক্তারদের নিয়মিত কাউন্সেলিং শুরু করেছি। দেখা যাক তাতে কতটা ফল হয়। তবে সরকারি কলেজগুলিতে না হলেও বেসরকারি কলেজগুলিতে এখন মেধা ছাড়াও টাকার জোরে ভর্তি হচ্ছেন অনেকেই। তাই ডাক্তার বলতে যে ছবিটা ভেসে ওঠে, সব ক্ষেত্রে যে তা মিলবে এমন না-ও হতে পারে।”

স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “আমাদের নানা ভাবে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেন জুনিয়র ডাক্তাররা। কোনও এক জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই বাকিরা মিলে কাজ বন্ধ করে আন্দোলনের হুমকি দেন। তাই বহু ক্ষেত্রেই আমাদের মুখ বুজে থাকতে হয়।”

কিন্তু এই সমস্যা কি শুধু ডাক্তারি পেশাতেই? মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল মনে করেন, এই ঘটনা চারপাশের সামাজিক অবক্ষয়েরই প্রতিফলন। তিনি বলেন, “যে কোনও পেশার মতো ডাক্তারদের মধ্যেও সহজাত প্রবৃত্তির দু’টি ধারা। একটি সৃজনশীল, অন্যটি ধ্বংসাত্মক। কোনও ভাবে সৃজনশীলতার মুখোশটা এক বার খুলে গেলে উন্মত্ত চেহারাটা খুব নগ্ন ভাবে প্রকাশ পায়। ডাক্তারি পড়ুয়ারা যেহেতু মানুষের শরীরটা জানেন, তাই তাঁদের অত্যাচারটাও আরও নৃশংস চেহারা নিয়েছে।”

প্রাক্তন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা জয়শ্রী মিত্র ঘোষ এক সময়ে একাধিক মেডিক্যাল কলেজের দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁর কথায়, “এই প্রবণতা আগে ছিল না। এখন অটোচালক যাত্রীকে মারছে, পাড়ার গুন্ডারা পুলিশকে মারছে। ডাক্তারি পড়ুয়ারা তো অন্য গ্রহের জীব নন। চারপাশের অবক্ষয়ের ছবি তাঁদের মধ্যেও। কাউকে বলার নেই, কোথাও প্রতিকার পাওয়ার নেই। তাই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.