অসুখ বলে কয়ে আসে না। এ দিকে চিকিৎসার খরচ এখন আকাশছোঁয়া। এ অবস্থায় হঠাৎ অসুখ বা দুর্ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি হলে সুরাহা হয় মেডিক্লেমে। এই মেডিক্লেম বিভিন্ন ধরনের হয়। গ্রাহকের বয়স অনুযায়ী তার রকম, সুবিধা-অসুবিধাও আলাদা হয়, যা বিভ্রান্ত করতে পারে সাধারণ মানুষকে। তাই আগেভাগে জেনে রাখুন মেডিক্লেমের খুঁটিনাটি।
মেডিক্লেম কী?
স্বাস্থ্য বিমা মূলত এক ধরনের আর্থিক সুরক্ষা। অসুস্থতা, অস্ত্রোপচার বা দুর্ঘটনার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হলে তার চিকিৎসার আকস্মিক খরচ জোগানো থেকে পরিবারকে রক্ষা করে। নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে সেই খরচ তখন বিমা কোম্পানি মেটায়। বিভিন্ন অঙ্কের নানা সুবিধা সমন্বিত স্বাস্থ্য বিমা বাজারে সহজলভ্য। সরাসরি কোম্পানির থেকে আবার তার এজেন্ট মারফতও বিমা কেনা যায়। তার জন্য বছরে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা প্রিমিয়াম দিতে হয়। প্রিমিয়ামের অঙ্ক, পলিসির ধরনের উপরে নির্ভর করে সুবিধাসমূহ। স্বাস্থ্য বিমা মূলত দু’ভাবে কাজ করে,
ক্যাশলেস চিকিৎসা: বিমা কোম্পানির নেটওয়ার্কভুক্ত হাসপাতাল হলে সেখানে উপভোক্তাকে কোনও টাকা দিতে হয় না। রোগীর হাসপাতালের বিল বিমা কোম্পানি সরাসরি মিটিয়ে দেয়। মেডিক্লেমের আওতার বাইরের অতিরিক্ত খরচটুকু দিতে হয়।
রিইমবার্সমেন্ট: এ ক্ষেত্রে আগে উপভোক্তাকে হাসপাতালের বিল মেটাতে হয়। পরে সেই বিল বিমা সংস্থাকে জমা দিলে টাকা ফেরত পাওয়া যায়। হাসপাতাল বিমা কোম্পানির আওতাভুক্ত কি না, দেখার প্রয়োজন নেই।
মেডিক্লেমের ধরন
ইন্ডিভিজুয়াল মেডিক্লেম: এ ক্ষেত্রে বিমার সুবিধা পান গ্রাহক একা।
ফ্যামিলি ফ্লোটার মেডিক্লেম: গ্রাহকের সঙ্গে তাঁর জীবনসঙ্গী, সন্তান, মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন।
সিনিয়র সিটিজ়েন বিমা: ষাটোর্ধ্বদের এই বিমা করাতে কিছু নিয়ম রয়েছে।
গ্রুপ মেডিক্লেম: কোনও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য এই মেডিক্লেম। কোনও সংস্থায় ১০০-র বেশি কর্মী থাকলে এ ধরনের বিমা করানো যায়। এ ক্ষেত্রে প্রি-এগজ়িস্টিং ডিজ়িজ়ের নিয়মকানুন বা কোনও ওয়েটিং পিরিয়ড থাকে না।
ক্রিটিক্যাল ইলনেস মেডিক্লেম: ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাকের মতো বড় রোগে এককালীন টাকা পাওয়ার সুবিধার জন্য এক বিশেষ ধরনের বিমা।
প্রতিবন্ধী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি বা সন্তানের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য বিমার সুবিধা রয়েছে।
সরকারি ব্যবস্থা
ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বিমা ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প রয়েছে, যার আওতায় সাধারণ মানুষ পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্যাশলেস চিকিৎসার সুবিধা পেতে পারেন। তবে এ সুবিধা কেবল কেন্দ্রের ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট আয়সীমার নীচে থাকা পরিবারই পাবে। এ রাজ্যে আয়ুষ্মান ভারতের সুবিধা নেই। এখানে জনসাধারণের জন্য রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যসাথী রয়েছে। সব ধরনের আর্থিক শ্রেণির মানুষই এই অ্যাশিয়োরেন্সের সুবিধা ভোগ করতে পারেন। দু’ক্ষেত্রেই পুরো খরচ সরকার বহন করে।
সুবিধার আড়ালে শর্তসমূহ
ইউনাইটেড ইনশিয়োরেন্সের কলকাতার রিজিওনাল ম্যানেজার চন্দ্রাণী মহলানবীশ জানাচ্ছেন, মেডিক্লেমের সুবিধা পেতে কিছু নিয়মকানুনও রয়েছে—
প্রি-এগজ়িস্টিং ডিজ়িজ়: স্বাস্থ্য বিমা দেওয়ার আগে গ্রাহকের রক্তচাপ, ডায়াবিটিস বা অন্য শারীরিক সমস্যা আছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়। অল্পবয়সে বিমা করালে এ ক্ষেত্রে পরীক্ষানিরীক্ষার দরকার পড়ে না। সমস্যার কথা পলিসিতে আগেভাগে মেনশন করে রাখলে সংস্থাগুলি সেই বাবদ অতিরিক্ত কিছু অর্থ বরাদ্দ করে। তবে রোগ লুকিয়ে বিমা করানোর বিষয়টি পরে জানা গেলে, ক্লেম বাতিল হতে পারে। সিনিয়র সিটিজ়েনদের ক্ষেত্রে সংস্থার অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসকের ছাড়পত্র মিললে তবেই পলিসি কেনার সুযোগ থাকে।
ওয়েটিং পিরিয়ড: সাধারণত নতুন পলিসি নেওয়ার প্রথম একমাস ক্লেম করা যায় না। হার্নিয়া, পাইলস, ছানির মতো সমস্যার ক্লেম এক-দু’বছর পর থেকে করা যায়। প্রি-এগজ়িস্টিং ডিজ়িজ়ের ক্ষেত্রে প্রথম দু’-তিন বছর কভার হয় না। তবে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে কিন্তু মেডিক্লেম করানোর পর দিন থেকেই সুবিধা মেলে।
কো-পে শর্ত: এর অর্থ খরচের একটা অংশ রোগীকেও বহন করতে হবে। ১০-৪০ শতাংশ কো-পে শর্ত এখন অনেক বিমা কোম্পানিরই পলিসিতে থাকে। বয়স্কদের মেডিক্লেমে ঝুঁকি কমাতে এবং মানুষ যাতে অপ্রয়োজনে হাসপাতালে না যায়, সে জন্য এই শর্ত রাখছে কোম্পানিগুলি।
জ়োনাল প্রিমিয়াম সিস্টেম: স্বাস্থ্য বিমা গোটা দেশে এক ভাবে কাজ করলেও, শহর ভিত্তিতে চিকিৎসার খরচ আলাদা। মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা, বেঙ্গালুরুর মতো বড় শহরে খরচ বেশি। আবার হাওড়া, হুগলি, ফরিদাবাদের মতো জায়গায় খরচ তুলনায় কম। সে কথা মাথায় রেখে বহু বিমা কোম্পানি জ়োনাল প্রিমিয়াম সিস্টেম চালু করেছে। এ ক্ষেত্রে মুম্বই, দিল্লির মতো শহর জ়োন এ, প্রিমিয়াম বেশি। কলকাতা, বেঙ্গালুরু, চেন্নাইয়ের মতো জায়গা জ়োন বি, যেখানে প্রিমিয়ামের অঙ্ক মাঝারি। জ়োন সি-তে কয়েকটি ছোট শহর রয়েছে। এই জ়োনের প্রিমিয়াম আরও কম। বিমা সংস্থা বদলে কোন শহর কোন জ়োনে তার হেরফের হয়। বিমা করানোর আগে তা দেখে নেওয়া জরুরি। এক জ়োনের বিমা কিন্তু অন্য জ়োনে প্রযোজ্য নয়। অবশ্য সব ধরনের বিমার উপরে টপ-আপের সুবিধা থাকে। এর ফলে যে কোনও সময়ে টাকার অঙ্ক বাড়ানো, জ়োন বদল ইত্যাদি করা যায়।
বিমার আওতায় কী কী?
ইউনাইটেড ইনশিয়োরেন্সের কলকাতার রিজিওনাল ম্যানেজার চন্দ্রাণী মহলানবীশ বলছেন, “হাসপাতালে ঘরের ভাড়া, ডাক্তার, সার্জারি, ওষুধ ইত্যাদির খরচ, আইসিইউ, অ্যাম্বুল্যান্স-সহ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের ও পরের কিছু দিনের চিকিৎসার খরচ বিমার আওতায় পড়ে।” কিছু নির্দিষ্ট সুবিধাযুক্ত বিমায় রোগীর পরিবারের হাসপাতালে দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্যও টাকা পাওয়া যায়। সাধারণত হাসপাতালে ভর্তি হলে তবেই স্বাস্থ্য বিমার সুবিধা মেলে। তবে এখন ডায়ালিসিস, কেমোথেরাপি, হাড় ভাঙার চিকিৎসার মতো ডে-কেয়ার ট্রিটমেন্টেও বিমার সুবিধা পাওয়া যায়। তা ছাড়া, হাসপাতাল অযথা অতিরিক্ত বিল বাড়াচ্ছে কিনা, সে দিকেও বিমা কোম্পানি নজর রাখে।
স্যানিটাইজ়ার, তুলো, গ্লাভসের মতো কিছু জিনিস, রোজকার ওষুধের খরচ বিমার আওতায় পড়ে না। তবে এখন অনেক কোম্পানি সে সুবিধাও দিচ্ছে। অন্য এক ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির কর্মকর্তার পরামর্শ, “কেবিন বা বেড ভাড়া বিমার আওতায় না রাখাই ভাল। তাতে মূল চিকিৎসার খরচ থেকে টাকা নষ্ট যায়।” কসমেটিক সার্জারি, দাঁতের চিকিৎসার খরচও মেডিক্লেমে পাওয়া যায় না। সাধারণ মেডিক্লেমে প্রসবকালীন খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকে না, তবে এই সুবিধা অ্যাড-অন করানো যায়। সে ক্ষেত্রে দু’-তিন বছরের ওয়েটিং পিরিয়ডের শর্ত থাকে।
সাব-লিমিটসের হিসেবনিকেশ
অনেক স্বাস্থ্য বিমা পলিসির ভিতরে রুম ভাড়া, ডাক্তারের খরচ ইত্যাদি খাতে নির্দিষ্ট সীমা ধার্য করা থাকে। প্রেগন্যান্সি, হার্নিয়া, ক্যাটার্যাক্ট, গলব্লাডার অপারেশনের মতো কিছু ক্ষেত্রেও সাব-লিমিট থাকে। মূলত খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ ধরনের সাব-লিমিট রাখে বিমা কোম্পানি। বিমা কেনার আগে তা দেখে নেওয়া জরুরি।
বয়সভিত্তিক সুবিধা
এখন শূন্য থেকে পঁচাত্তর বছর, যে কোনও বয়সে স্বাস্থ্য বিমা করানো যায়। তবে যত কম বয়সে মেডিক্লেম করানো যায়, ততই প্রিমিয়ামের অঙ্ক, নিয়মকানুনের কড়াকড়ি কম থাকে। বিমা পুরনো হলে তার সুবিধা বাড়ে, ক্লেম সেটলমেন্ট তাড়াতাড়ি হয়। সন্তান জন্মের দিন থেকেই বাবা-মা তাকে নিজেদের মেডিক্লেমের আওতায় আনতে পারে। সন্তান আর্থিক ভাবে স্বাধীন হয়ে গেলে, তার পলিসি আলাদা করে দেওয়া হয়। তবে তার বিমার তারিখ এবং প্রিমিয়াম অ্যামাউন্ট পুরনো হিসেবেই চলে। বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের যে কেউ, তার পুরনো বিমা ট্রান্সফার করে অন্যজনের আওতায় আনতে পারেন। সে ক্ষেত্রেও আগের সুযোগসুবিধা বজায় থাকে। একই ভাবে মা-বাবার বয়স বাড়লে সন্তান তাঁদের বিমাটিকে আলাদা করে দিতে পারেন। পরিবারে বয়স্ক লোকদের জন্য সাধারণত প্রতি বছর মেডিক্লেম লাগে। এতে অন্যদের সমস্যায় আর সুবিধা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া, ক্লেম না করলে যে অতিরিক্ত সুবিধা মেলে, তা-ও হারাতে হয়। বয়স্ক মা-বাবার মেডিক্লেম আলাদা করে দিলে সে সমস্যা এড়ানো যায়।
ভ্রান্ত ধারণার ব্যাখ্যা
অনেকেই মনে করেন কোনও বছরে ক্লেম না করলে অকারণে টাকা নষ্ট হয়। জেনে রাখা ভাল, সে ক্ষেত্রে কিন্তু আগামী বছরে সেই টাকার নির্দিষ্ট অংশ বিমায় যোগ হয় কিংবা চাইলে প্রিমিয়ামের টাকায় ছাড় পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য বিমার বদলে জীবনবিমা বা ব্যাঙ্কে টাকা জমানোর কথা ভাবেন অনেকেই। তবে হঠাৎ অসুস্থতায় সেভিংস ভাঙলে আর্থিক ক্ষতি হয়। তা ছাড়া ব্যাঙ্ক থেকে দ্রুত মোটা অঙ্কের টাকা তোলা সহজ নয়।
বিমা করানোর আগে
মেডিক্লেম থাকলেও প্রয়োজনে তার সুবিধা পাননি এমন গ্রাহকের সংখ্যাও কম না। এর জন্য বিমা করানোর সময়েই কিছু বিষয় জেনে রাখা জরুরি:
বিমার আওতায় কোন কোন খরচ পড়বে না, সে কথা আগেই কোম্পানির নিয়মবিধি পড়ে জেনে নিন।
প্রি-এগজ়িস্টিং রোগের ওয়েটিং পিরিয়ড কত বছর, নিজের এলাকায় বিমা কোম্পানির আওতাভুক্ত কোন হাসপাতাল রয়েছে, তাদের পরিষেবা কেমন, কোম্পানির ক্লেম সেটলমেন্টের সুনাম কতটা ইত্যাদি খোঁজখবর করে তবে বিমা কিনুন।
বিমার কো-পে শর্ত ও সাব-লিমিটস বুঝে নিন। রিস্টোর বেনিফিট, লাইফলং রিনিউয়াল ইত্যাদি সুবিধা পাবেন কি না, জেনে রাখা দরকার।
স্বাস্থ্য বিমা করানোর আগে কাগজপত্র ভাল করে দেখে নিন। তথ্যে ভুল থাকলে ভবিষ্যতে হয়রানি হতে পারে। রিইমবার্সমেন্ট করালে হাসপাতাল ছাড়ার আগে কাগজপত্র, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে সব সমস্যা, ওষুধ, খুঁটিনাটি ঠিক মতো লেখা রয়েছে কি না, দেখে নেবেন। এক ব্যক্তির একাধিক বিমা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে একটি বিমার লিমিট পেরিয়ে গেলে, অন্যটির থেকেও খরচ নেওয়া সম্ভব। সুস্থ ও নিশ্চিন্ত থাকতে নিজের ও পরিবারের জন্য একটি উপযুক্ত মেডিক্লেম ভাবনাচিন্তা করে বাছতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)