দিন পেরোলেই বৈশাখের সূচনা। তাপমাত্রাকে তুড়ি মেরে উৎসবে মাতবে বাঙালিরা। নতুন পোশাকে নতুন সাজ। তবে কেবল জামাকাপড় নয়, নতুন যুগে রূপচর্চার দরও বেড়েছে যথেষ্ট। ৩ ধাপ, ৭ ধাপ, ১০ ধাপে ত্বকচর্চার রুটিনে বাঁধা পড়েছেন তারকা থেকে সাধারণেরা। তবে পয়লা বৈশাখের আগের দিন চট করে ইতিহাসে ফিরে তাকানো যাক? কেমন ছিল সেকালের ত্বকচর্চা? পছন্দ হলে আপনিও না হয় নতুন বছর থেকে সেকেলে হওয়ার দিকে পা বাড়াবেন।
নতুন যুগে ত্বকচর্চার ঘরোয়া টোটকা নিয়ে রোজ রোজ নতুন রিল তৈরি হয়। আর সে সব মেনে ঘন ঘন আপনিও নিশ্চয়ই আপনার রুটিন বদলাতে বাধ্য হন। কিন্তু আপনার দিদা বা ঠাকুরমার কাছে কখনওই প্রসাধনীর বাহুল্য ছিল না। তা-ও তো তাঁদের ত্বক নতুন প্রজন্মকে বলে বলে দশ গোল দিয়ে দেবে।
কিন্তু ১৯৫০-৭০, যেটিকে বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের তকমা দেওয়া হয়, সেই সময়ের অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে যদিও ছবিটা খানিক অন্য রকম ছিল। বাংলা বর্ষবরণে আনন্দবাজার ডট কমের সঙ্গে আড্ডায় তৎকালীন তিন নায়িকার রূপের রহস্যভেদ।
লিলি চক্রবর্তী
স্বামীর বকুনিই ছিল ‘ভানু পেলো লটারী’র নায়িকার মূল অনুপ্রেরণা। নয়তো নায়িকা হয়েও রূপ, সাজ নিয়ে অত বেশি মাথাব্যথা ছিল না তাঁর। কিন্তু স্বামী যে ভাবে আদরে, যত্নে স্ত্রীর খাওয়াদাওয়া, ত্বকচর্চা, শরীরচর্চার দিকে খেয়াল রাখতেন, তা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া অত সহজ ছিল না।
লিলির ত্বকচর্চা
রাতে মুসুর ডাল ভিজিয়ে রেখে দিতেন। সকালবেলা সেটি বেটে নিয়ে তাতে অল্প একটু কাঁচা হলুদবাটা মিশিয়ে গা-হাত-পায়ে মেখে নিতেন লিলি। ঘণ্টাখানেক গায়ে থাকত সেই মিশ্রণ। ওই অবস্থায় পাখা চালিয়ে শরীরচর্চা করতেন অভিনেত্রী। তত ক্ষণে ওই মিশ্রণ শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে এঁটে থাকত গায়ে। লিলির কথায়, ‘‘স্নানে গিয়ে ওটা তুলতে আমার প্রাণ বেরিয়ে যেত। শক্ত হয়ে বসে যেত শরীরে। জল ঢেলে ঢেলে নরম করে হাত দিয়ে তুলতাম। তার পর গা মুছে ক্রিম মেখে নিতাম। সেই সময়ে সাবান কম মাখতাম আমরা। পরবর্তীকালে সাবান মেখে স্নানের চলটাই বাড়ল। তবে এখন তো দেখি তরল হয়ে গিয়েছে সাবান। আগের মতো আর বার সাবানও নেই। কত তাড়াতাড়ি সব বদলে যায়। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, অনেক দিন পর্যন্ত আমার মুখে কিন্তু বলিরেখা পড়েনি। বোধহয় ওই টোটকার জাদুতেই। আমার বর মাস্টারমশাইয়ের মতো বকুনি না দিলে বোধহয় ও রকম নিয়ম মানা হতোই না।’’ তার পর একেবারে রাতে শুটিং থেকে ফিরে মেকআপ তুলতেন কেবলমাত্র তেল দিয়ে। টোনার বা ময়েশ্চারাজ়িংয়ের বালাই ছিল না।

লিলি চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
লিলির ডায়েট
স্বামী বানিয়ে দিতেন জলখাবার। টোস্ট, ডিমের পোচ। তবে সকালবেলা উঠেই আগে দুধের মধ্যে কাঁচা ডিমের কুসুম ভাল করে গুলে দিয়ে স্ত্রীকে খাওয়াতেন লিলির স্বামী।
মাধবী মুখোপাধ্যায়
‘চারুলতা’র কাছে ত্বকচর্চার মূলমন্ত্র ছিল, ‘ত্বকচর্চাই কোরো না’। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, পেশার কারণে ত্বকের উপর মেকআপের যে পরিমাণ দাপট চলত, তার পর ত্বক ভাল থাকত কী ভাবে? এ ক্ষেত্রেও অভিনেত্রীর কাছে সমাধান ছিল ‘না’-তেই। শুরু থেকেই ভারী মেকআপকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন অভিনেত্রী। ফলে ত্বকের উপর অত্যাচারও হয়নি তেমন।
মাধবীর ত্বকচর্চা
জীবনে একটি বারের জন্যও ফেশিয়াল করাননি অভিনেত্রী। শুনে অবাক লাগে, তাই না? চারুর রূপের ছটার রহস্যভেদে কি তবে কিছুই মিলবে না? মিলল, তবে তা শুধু ক্রিম। মাধবীর কথায়, ‘‘ঘরোয়া টোটকার ঝক্কিও পোহাইনি কখনও। বার সাবান দিয়ে স্নান, তার পর ক্রিম দিয়ে গা ম্যাসাজ, ব্যস।’’ রাতে শুটিং থেকে বাড়ি ফিরে চার্মিস ক্রিমের মতো ভাল ময়েশ্চারাইজ়ার দিয়েই মেকআপ তুলতেন অভিনেত্রী।

মাধবী মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
মাধবীর ডায়েট
সকালে কাজে বেরোনোর সময়ে অল্প একটু ভাত খেয়ে যেতেন নায়িকা। সঙ্গে মাছের ঝোল বা তরকারি। তা ছাড়া, ফ্লাস্কভর্তি ফলের রস বানিয়ে শুটিংয়ে নিয়ে যেতেন মাধবী। তাতে থাকত মরসুমি ফল যেমন, কমলালেবু, আমেল, আঙুর, বেদানা। বিকেলে টোস্ট খাওয়ার অভ্যাস ছিল তাঁর। ভাত দিয়েই হত নৈশভোজন।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়
‘‘অত আধুনিক জিনিসপত্র বুঝতাম না, আমাদের পরিবারে এ সব চর্চা ছিলই না’’, ত্বকচর্চার কথা শুনেই সোজা উত্তর সাবিত্রীর। তবে অভিনেত্রী হওয়ার পর কত লোকের থেকেই যে শুনতে হত, ‘‘তুমি সাজাগোজা একদম জানো না। বড় বড় তারকারা পরামর্শ দিতেন, এটা পরো, সেটা পরো।’’ এ দিকে ব্লাউজ়-শাড়ির রং মিলিয়ে পরার কৌশল জানা ছিল না ‘মৌচাক’-এর নায়িকার।
সাবিত্রীর ত্বকচর্চা
ত্বকচর্চা বলতে তেল মাখাকেই বুঝতেন সাবিত্রী। কেবল অলিভ অয়েলেই ভরসা ছিল অভিনেত্রীর। সাবিত্রী বললেন, ‘‘হাত, পা, মুখে ভীষণ টান ধরত আমার। এত শুষ্ক ছিল যে, গরমকালেও সারা দিন ধরে তেল মাখতাম। এখন তো বডি লোশন বেরিয়ে গিয়েছে বলে সেটিই মাখি। এ ছাড়া, আর কিছুই করতে হত না। তাও অনেক দিন পর্যন্ত আমার ত্বক ঝুলে পড়েনি। হয়তো এই কারণেই বলিরেখা পড়েছে দেরিতে।’’ এ ছাড়া, শুটিং শেষ করে কোল্ড ক্রিম দিয়ে মেকআপ তুলতেন নায়িকা।

সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
সাবিত্রীর ডায়েট
যেমন ছিল না ত্বকচর্চায় আলাদা নজর, তেমনই ডায়েটও ছিল সাদামাঠা। আর পাঁচজনের মতো। ও সব নিয়ে যে বেশি ভাবতেন না, তা নানা কথায় বুঝিয়ে দেন প্রবীণ অভিনেত্রী।