Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Adenovirus

বাড়ছে প্রকোপ, নিরাপদে রাখুন শিশুকে

রাজ্য জুড়ে এই মুহূর্তে আতঙ্কের আর-এক নাম অ্যাডিনোভাইরাস। বছরের শুরু থেকেই বাড়ছে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। বড়দের চেয়ে বাচ্চারাই এই ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

Children are being advised to maintain proper precautions in order to avoid Adenovirus

বড়দের চেয়ে বাচ্চারাই এই ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফুসফুস। প্রতীকী ছবি।

কোয়েনা দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৩ ০৮:২৭
Share: Save:

ঋতু পরিবর্তনের সময়ে জ্বর, সর্দি-কাশি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু করোনার পর বেড়েছে একাধিক ভাইরাস-ব্যাক্টিরিয়ার প্রকোপ। রাজ্য জুড়ে এই মুহূর্তে আতঙ্কের আর-এক নাম অ্যাডিনোভাইরাস। বছরের শুরু থেকেই বাড়ছে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। বড়দের চেয়ে বাচ্চারাই এই ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফুসফুস। শহর থেকে জেলা, সরকারি থেকে বেসরকারি, কোথাও কোনও হাসপাতালের শিশু বিভাগের বেড খালি নেই। খালি নেই ভেন্টিলেটরও। পেডিয়াট্রিক ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটেও (পিকু) শয্যার আকাল দেখা দিয়েছে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রভাস প্রসূন গিরির কথায়, “বাচ্চার বয়স যত কম, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।”

কী এই অ্যাডিনোভাইরাস?

এটি মূলত ডিএনএ ভাইরাস। সর্দি-কাশি-হাঁচির মাধ্যমে একজন মানুষের থেকে অন্য মানুষের দেহে প্রবেশ করে। করোনার মতোই তা ছোঁয়াচেও। এ ক্ষেত্রেও ড্রপলেট এবং এয়ারোসোলের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। একজন আক্রান্ত হলেই তার হাঁচি-কাশি থেকে অন্য শিশু আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে দ্রুত বাড়ছে সংক্রমণ। আপাত ভাবে সাধারণ ভাইরাল ফিভারের মতো মনে হলেও এর প্রভাব আলাদা। প্যারাসিটামলে সাধারণ জ্বর মোটামুটি দু’-তিন দিনের মধ্যেই কমে যায়। কিন্তু অ্যাডিনোভাইরাসের সংক্রমণে কোনও কোনও ক্ষেত্রে দশ থেকে চোদ্দো দিন পর্যন্ত বাচ্চাদের তীব্র জ্বর থাকছে। কখনও তাপমাত্রা পৌঁছচ্ছে ১০৪ ডিগ্রিতেও। প্যারাসিটামল ব্যবহারেও ভাইরাসে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে কমছে না তাপমাত্রা।

প্রাথমিক ভাবে তীব্র কাঁপুনি দিয়ে জ্বরের সঙ্গে উপসর্গ হিসেবে থাকছে সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, খিঁচুনি, ভুল বকা, ঠোঁট-মুখ লাল হয়ে যাওয়া, কনজাংটিভাইটিস, প্রবল শ্বাসকষ্ট, পেটখারাপ ও বমি। বাচ্চার খাওয়ার এবং প্রস্রাবের পরিমাণও অনেক সময়ে আচমকা কমে যাচ্ছে।

ইতিমধ্যেই রাজ্যে অ্যাডিনোভাইরাসে শিশুমৃত্যু হয়েছে। অ্যাডিনোভাইরাস কিন্তু আগেও ছিল। তবে চরিত্র বদলের কারণে এই ভাইরাসে এসেছে মারণক্ষমতা। শুধু কলকাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গের অন্তত ৫০ শতাংশ শিশু জ্বর, সর্দি, কাশিতে কাহিল। পাশাপাশি শিশুরোগীদের ৯০ শতাংশেরই শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ অর্থাৎ রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ শিশু একইসঙ্গে ভাইরাল নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে তাদের সুস্থ করে তোলা। শহর জুড়ে মহামারির আকার নিচ্ছে এই অ্যাডিনোভাইরাস। তাই চিকিৎসকদের মতে, উপসর্গ দেখা দিলে আগেভাগেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

প্রতীকী ছবি।

আক্রান্ত কারা?

সব বয়সের মানুষই আক্রান্ত হচ্ছেন অ্যাডিনো ভাইরাসে। বড়দের ক্ষেত্রে সর্দি-কাশিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বয়সে খানিক বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে উপসর্গ হিসেবে সর্দি, কাশি, জ্বর, অল্প নিউমোনিয়া বা কনজাংটিভাইটিস দেখা যাচ্ছে। তবে ২ বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, বিশেষত বয়স তিন মাস থেকে দেড় বছরের মধ্যে হলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে উঠছে মারাত্মক।

চিকিৎসা

কোভিডে দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর এখন স্কুল খুলে গিয়েছে। চলছে পরীক্ষাও। সেখানে বাচ্চারা আরও পাঁচজনের সংস্পর্শে আসবেই। তাই উপসর্গ দেখা দিলে শিশুকে কোয়রান্টিনে রাখুন। সংক্রমিত না হলেও ছোট বাচ্চাদের ডে কেয়ার বা প্লে স্কুলে না পাঠানোই ভাল। সংক্রমণ রুখতে সচেতন না হলে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে এই মারণরোগ। ডা. প্রভাস প্রসূন গিরির মতে, “অ্যাডিনোভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা ওষুধ নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা করা হচ্ছে।” পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্দেশিকা জারি করেছে স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু বাড়ির খুদেকে নিরাপদ রাখতে গেলে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। চিকিৎসকদের মতে, অধিকাংশ সময়েই সাধারণ জ্বর ভেবে শিশুকে বাড়িতেই চিকিৎসা করা হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হলে বাড়িতেই বাচ্চাকে নেবুলাইজ়ার দিয়ে নিশ্চিন্ত হন মা-বাবারা। ডা. গিরির মতে, “শুধু নেবুলাইজ়ার নয়, বাচ্চাকে অক্সিজেন দেওয়ারও প্রয়োজন থাকতে পারে। তাই বাড়িতে চিকিৎসা নয়, শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।” জ্বর হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আক্রান্তকে ঘনঘন জল, ওআরএস খাওয়াতে হবে। তাপমান মাপতে হবে বারবার। জ্বর, সর্দিতে খাওয়া যেতে পারে প্যারাসিটামল। শ্বাসকষ্ট তীব্র হলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে শিশুকে।

প্রতীকী ছবি।

সতর্কতা

হাঁচি ও কাশির সময় নাক-মুখ যথাসম্ভব ঢেকে রাখতে হবে। ঘন ঘন সাবান জল দিয়ে হাত ধুতে হবে। স্যানিটাইজ়ার ব্যবহার করতে হবে। উপসর্গ দেখা দিলে সেই ব্যক্তিকে আইসোলেটেড থাকতে হবে। বাড়ির বড়রা যদি সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হন, তা হলে বাচ্চাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। মানতে হবে কোভিডবিধি। জনবহুল এলাকা, ভিড় থেকে শিশুকে যতটা সম্ভব দূরে রাখুন। ভাইরাসের দাপট রুখতে ডা. গিরির মতে, “কোভিডকালের মতোই মুখে মাস্ক, হাত ভাল করে ধোয়া, যেখানে সেখানে থুতু না ফেলা, মুখে-চোখে হাত না দেওয়া এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপরে জোর দিতে হবে। তিন থেকে পাঁচদিনের মধ্যে জ্বর না কমলে চিকিৎসককে দেখানো আবশ্যক। বাচ্চার খাওয়ার পরিমাণ এবং প্রস্রাবের পরিমাণের উপর নজর রাখতে হবে।”

চিকিৎসকদের মতে, কোভিডের কারণে ঘরবন্দি শিশুরা দীর্ঘ সময়ে মেলামেশা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছে। ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমেছে তাদের। সরকারি নির্দেশিকায় ইতিমধ্যেই জ্বরে আক্রান্ত সব বাচ্চারই কোভিড টেস্ট এবং অ্যাডিনোভাইরাস পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। তবে ডা. গিরি জানান, “কোভিড পরীক্ষা জরুরি নয়। অ্যাডিনোভাইরাসের পরীক্ষাও সব জায়গায় হয় না, হলেও তা ব্যয়বহুল। তা ছাড়া, বাচ্চাদের ইনসেনটিভ কেয়ার খুব সহজ ব্যাপার নয়।” করোনার মতোই বিপজ্জনক অ্যাডিনোভাইরাস। বাচ্চা একবার সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে আরও বেশি নজরে রাখতে হবে। সে সময় শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। ফলে সহজেই আবারও অন্য ভাইরাস কিংবা অ্যাডিনোভাইরাসেই আক্রান্ত হতে পারে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আর কোনও রকম উপসর্গ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE