Advertisement
E-Paper

ক্যানসার-যুদ্ধে ভরসার হাত ধ্বস্ত পরিজনকেও

আধো আবছায়া ঘর। শীর্ণ চেহারাটা মেডিক্যাল বেডে শুয়ে। বয়সের চেয়ে মাথায় চুল একটু বেশিই পাতলা। কেমোথেরাপির মাসুল। চোখ দু’টো বোজা। মানুষটা ঘুমোচ্ছে। পাশের টেবিলে ডাঁই করা ওষুধ। তার পাশে লোহার চেয়ারে বসে আরও একটা মানুষ। ক্লান্ত, উস্কোখুস্কো চেহারা। চোখের তলায় কালি। মুখের ওপর একটা কালো পর্দা টাঙানো যেন। একদৃষ্টে তাকিয়ে বিছানার দিকে।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০২:৫২
‘অনুব্রত ভাল আছো?’ ছবির একটি দৃশ্যে দেবলীনা দত্ত ও ঋত্বিক চক্রবর্তী।

‘অনুব্রত ভাল আছো?’ ছবির একটি দৃশ্যে দেবলীনা দত্ত ও ঋত্বিক চক্রবর্তী।

আধো আবছায়া ঘর। শীর্ণ চেহারাটা মেডিক্যাল বেডে শুয়ে। বয়সের চেয়ে মাথায় চুল একটু বেশিই পাতলা। কেমোথেরাপির মাসুল। চোখ দু’টো বোজা। মানুষটা ঘুমোচ্ছে। পাশের টেবিলে ডাঁই করা ওষুধ। তার পাশে লোহার চেয়ারে বসে আরও একটা মানুষ। ক্লান্ত, উস্কোখুস্কো চেহারা। চোখের তলায় কালি। মুখের ওপর একটা কালো পর্দা টাঙানো যেন। একদৃষ্টে তাকিয়ে বিছানার দিকে।

হঠাৎ খাটের মানুষটা চোখ মেলল। চেয়ারেও যেন জাগল প্রাণের স্পন্দন। শুকনো হেসে খাটে শোয়া চেহারাটা ক্ষীণ গলায় বলল, ‘‘এখান থেকে বেরোলে আমায় কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে?’’

কালো পর্দার সামনে ঝাপসা হতে লাগল পৃথিবী।

সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো শোনালেও বাস্তবে কোনও হাসপাতালের কেবিনে হয়তো এমনই কোনও এক দৃশ্যে আমরা কেউ না কেউ ঢুকে পড়েছি কখনও। বেরিয়ে এসে আক্ষেপ করেছি, ‘‘কী যে হবে ওদের!’’

এক জন তো ক্যানসারের অসহ্য যন্ত্রণা পাচ্ছেনই। কিন্তু মনের মধ্যে কালবৈশাখী ঝড় নিয়ে ওই চেয়ারে বসে যিনি রোগীর নিরন্তর শুশ্রূষা করে চলেছেন? নিত্য আশঙ্কার সঙ্গে ঘর করা সেই মানুষটাকে বা মানুষগুলোকে বাঁচার সাহস দেবে কে?

কথা হচ্ছিল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। তাঁরা একবাক্যে মেনে নিচ্ছেন, দিনের পর দিন এই ভাবে রোগীর পাশে থেকে তাঁর সেবা করতে করতেই গভীর অবসাদের শিকার হয়ে পড়েন অনেকে। আর এই কারণেই রোগীর পরিবারের কাউন্সেলিংয়ের দিকটিও ক্রমশ আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে আধুনিক ক্যানসার চিকিৎসায়। বিশ্ব জুড়ে ক্যানসার নিয়ে চর্চা যত বাড়ছে, ততই সামনে আসছে রোগী ও তাঁর পরিজন— দু’তরফকেই মানসিক ভাবে চাঙ্গা রাখার বিষয়টি।

একটা রোগ কী ভাবে গোটা পরিবার, নানা সম্পর্ক, পেশাগত জীবনের উপরে প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে পত্রপত্রিকায়। দেশি-বিদেশি পরিচালকেরা তাঁদের ছবিতেও তুলে ধরছেন এই পরিস্থিতির কথা। দিন কয়েকের মধ্যেই মু্ক্তি পেতে চলেছে বাংলা ছবি ‘অনুব্রত ভাল আছো?’ ক্যানসার আক্রান্তের জীবনসঙ্গীদের মানসিক লড়াইয়ের কথাই উঠে এসেছে পার্থ সেন পরিচালিত এই ছবিতে। পার্থবাবু তাঁর বাবাকে হারিয়েছিলেন অল্প বয়সে। বললেন, ‘‘বাবার দীর্ঘ অসুস্থতার সময়ে আমার এবং আমার মায়ের নিরন্তর লড়াইয়ের স্মৃতিই হয়তো কোনও ভাবে এই ছবির জন্ম দিয়েছে।’’

আসলে গোড়া থেকে লড়াইটা অসম। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সেই কারণেই যুদ্ধটা যতটা শরীরে, ততটাই মনে। তাই বিশ্ব জুড়ে গুরুত্ব বাড়ছে 'সাইকো-অঙ্কোলজি'র। ক্যানসার রোগী ও তাঁর পরিজনের উপরে রোগটির মানসিক প্রভাব নিয়ে চর্চাই 'সাইকো-অঙ্কোলজি'র মূল কথা। সমাজ ও জীবনযাত্রা কী ভাবে ক্যানসার চিকিৎসায় প্রভাব ফেলে, তা-ও খতিয়ে দেখেন এই শাখার বিশেষজ্ঞরা। ক্যানসার শল্য-চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘আমাদের কাছে বহু ধরনের মানুষ আসেন। দায়িত্ব পালন করতে করতে তাঁরা ক্লান্ত। এমনকী তাঁদের পৃথক অস্তিত্বের কথাটাও লোকে ভুলতে বসে। যাঁর স্বামী বা স্ত্রীর ক্যানসার হয়েছে, তাঁর সামান্য সাজগোজ, কোনও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে যাওয়া, সামান্য হাসিগল্পে যোগদানকেও সমাজ বাঁকা চোখে দেখে। সমালোচনা করে। এটা যে কী মারাত্মক চাপ!’’

ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ও তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবনে অজস্র পরিবারকে দেখেছেন, যেখানে নিজেদের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে দূরে সরিয়ে রেখে মানুষ তাঁদের রুগ্ণ প্রিয়জনকে সুস্থ করে তোলার পণ করেছেন। আর তার মাসুল দিয়েছে তাঁদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন। সুবীরবাবুও বলছেন, ‘‘ক্যানসার যে ভাবে ছড়াচ্ছে তাতে সমাজের সামগ্রিক ক্ষয় ঠেকাতে রোগীর পরিবারের লোকজনের কাউন্সেলিংটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’

কিন্তু কী ভাবে? ওয়াশিংটনে সম্প্রতি সাইকো-অঙ্কোলজির উপরে একটি বিশ্ব কংগ্রেসের আয়োজন করেছিল ইন্টারন্যাশনাল অঙ্কোলজি সোসাইটি এবং আমেরিকান সাইকো-সোশ্যাল অঙ্কোলজি সোসাইটি। এ দেশে তেমন কর্মকাণ্ড চলছে কি?

ক্যানসার রোগী ও তাঁদের পরিবার নিয়েই দীর্ঘদিন কাজ করছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফর্মিং আর্ট সেন্টার-এর প্রধান অমিতা দত্ত। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘রোগীর যেমন বিষাদ রয়েছে, তেমনই পরিবারের লোকদের বিষাদও কিছু কম নয়। আমরা নাচ-গান-নাটকের মাধ্যমে সাময়িক ভাবে তাঁদের ভাল রাখার চেষ্টা করি।’’ প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশু ক্যানসার রোগীদের নিয়েও কাজ করছেন অমিতাদেবী। বললেন, ‘‘ক্যানসার আক্রান্ত কোনও বাচ্চা তো জানেই না তার কী হয়েছে। কিন্তু সে দেখে, তার মায়ের মুখে কোনও সময়েই হাসি নেই। আমাদের থেরাপি যদি মায়ের মুখে কিছুক্ষণের জন্য হাসি আনতে পারে, তা হলে সেই শিশুও খুশি থাকবে। এটাও কি কম পাওয়া!’’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অনিরুদ্ধ দেবের মতে, আমাদের সমাজের কাঠামোটাই এমন যে, দায়িত্বগুলোকে অনেকেই ভবিতব্য বলে মেনে নেন। দুজনেই বয়স্ক হলে আরও সমস্যা। সেবা করে, সঙ্গ দিয়ে তাঁরা যে আর পেরে উঠছেন না, সেটা পর্যন্ত নিজেরা বুঝতে চান না। আর যদিও বা উপলব্ধি করেন, তখন তা নিয়ে এক ধরনের অপরাধবোধ তাঁদের গ্রাস করে। অনিরুদ্ধবাবুর কথায়, ''বহু ক্ষেত্রে এমন দেখেছি যেখানে ক্যানসার রোগী হয়তো চিকিৎসায় অনেকটাই সেরে উঠেছে‌ন, কিন্তু তাঁর সঙ্গী ততক্ষণে গভীর অবসাদে। সেটা আর সারানো যাচ্ছে না।’’

তা হলে এর থেকে মুক্তির উপায় কী? রোগী যদি মারা যান, সে ক্ষেত্রে কী করবেন তাঁর সঙ্গী? আচমকাই একদিন রোগীকে সেবা-যত্ন, সঙ্গ দেওয়ার প্রয়োজন ফুরোলে যে অখণ্ড শূন্যতা গ্রাস করে, কী ভাবে সেটা কাটিয়ে উঠবেন তাঁরা? ইদানীং বেশ কয়েকটি হাসপাতালে সপরিবার ক্যানসার রোগীদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। নিউটাউনে তেমনই একটি ক্যানসার হাসপাতালের

সঙ্গে যুক্ত মনোরোগ চিকিৎসক সৌমিত্র দত্ত বললেন, ‘‘আমরা রোগীকে ভাল রাখি। আর রোগী যদি কখনও চলে যান, তখন তাঁর সঙ্গীর জীবনের নিজস্ব ছন্দটা যাতে নষ্ট না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও অনেকটাই আমাদের উপরে।’’

ভরসার খড়কুটো ধরে যদি উঠে দাঁড়ায় বিপর্যস্ত মন!

abpnewsletters cancer soma mukhopadhyay doctor hospital counselling
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy