Advertisement
E-Paper

মনোরোগীর সন্তানের জন্য ক্রেশের দাবি

ঝড় বয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনে। সেই ঝড়ে ছোট্ট শালুকে হারিয়ে ফেলেন কবিতা। পাঁচ মাস পরে মানসিক রোগ থেকে সুস্থ হয়ে উঠে খুঁজে পাচ্ছিলেন না কোলের মেয়েকে। শেষে পুলিশ, স্বাস্থ্য দফতর ও মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার চেষ্টায় এই অচেনা কলকাতা থেকেই শালুকে খুঁজে পেয়েছেন তাঁর মা।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০২:৩৮
মেয়ের সঙ্গে মা।  —নিজস্ব চিত্র।

মেয়ের সঙ্গে মা। —নিজস্ব চিত্র।

ঝড় বয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনে। সেই ঝড়ে ছোট্ট শালুকে হারিয়ে ফেলেন কবিতা। পাঁচ মাস পরে মানসিক রোগ থেকে সুস্থ হয়ে উঠে খুঁজে পাচ্ছিলেন না কোলের মেয়েকে। শেষে পুলিশ, স্বাস্থ্য দফতর ও মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার চেষ্টায় এই অচেনা কলকাতা থেকেই শালুকে খুঁজে পেয়েছেন তাঁর মা। কিন্তু কবিতা-শালুর কাহিনি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে মানসিক রোগীদের সন্তানদের সম্পর্কে স্বাস্থ্য দফতর তথা সমাজকল্যাণ দফতরের গৃহীত নীতি নিয়ে।

প্রশ্ন হল, মানসিক অসুস্থ কোনও মহিলাকে যদি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় এবং তাঁর সন্তানের দেখাশোনার জন্য যদি পরিবারের কাউকে পাওয়া না-যায়, তা হলে সেই বাচ্চা কেন মায়ের কাছাকাছি থাকবে না? কেন রাজ্যের প্রতিটি মানসিক হাসপাতালে বাচ্চাদের রাখার ক্রেশ তৈরি হবে না? মনোবিদ ও মনোচিকিৎসদের মতে, মানসিক ভাবে অসুস্থ মা যদি সন্তানের সান্নিধ্য পান, তবে তাঁর জলদি সেরে ওঠার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। কিন্তু সেই সুবিধা এ রাজ্যের সরকারি মানসিক হাসপাতালে নেই।

রাজ্য শিশু অধিকার ও সুরক্ষা আয়োগের চেয়ারম্যান অশোকেন্দু দাশগুপ্তও মনে করেন, “মানসিক রোগী মাকে মাঝেমাঝেই ক্রেশে বাচ্চার কাছে নিয়ে যাওয়ার থেকে ভাল কিছু হয় না। কিন্তু অবশ্যই মায়েদের সঙ্গে এক-এক জন করে সাইকিয়াট্রিক অ্যাটেন্ড্যান্ট দিতে হবে। যাতে হঠাৎ কোনও ভাবে তিনি শিশুর কোনও ক্ষতি করতে না পারেন। এমন অ্যাটেন্ড্যান্ট আমাদের রাজ্যে নেই। তাই কেউ ঝুঁকি নিতে চাইবে না।”

স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে ক্রেশের প্রয়োজনীয়তার কথা মেনে নিয়ে বলেন, “দরকার তো অবশ্যই। কিন্তু সেই ক্রেশ দেখাশোনা করার মতো লোকবলের বড় অভাব। কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যদি ভাল প্রস্তাব নিয়ে এলে আমরা প্রস্তুত।” তাঁর কথায়, “প্রায় প্রত্যেকটি মানসিক হাসপাতালে ক্রেশ করার জায়গা রয়েছে। জল, বিদ্যুৎও আমরা দেব। কর্মীর ব্যবস্থা করতে হবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে। আমরা চাই মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই নতুন জিনিসগুলি শুরু হোক। সরকারি মানসিক হাসপাতালে মনোরোগীদের খাঁচার মতো সেলে বন্ধ করে রাখা যেমন তুলে দিয়েছি তেমনই মনোরোগী মায়েদের কাছে তাঁদের সন্তানদের রাখার নিয়ম চালু করতেও আগ্রহী।”

উত্তরপ্রদেশের অম্বেডনগরের জরিওয়াল কাটোই গ্রামে বাড়ি বছর সাতাশের কবিতার। স্বামী বাণেশ্বর দিনভর নেশা করে পড়ে থাকতেন আর তাঁকে মারতেন বলে জানান কবিতা। মার সহ্য করতে না পেরে গত বছর অক্টোবরে দুই ছেলেকে ফেলে শুধু দেড় বছরের মেয়ে শালুকে কোলে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি। পরের কিছু দিনের কথা তাঁর মনে নেই। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সেই সময়ে মানসিক চাপে সাময়িক ভাবে মনের ভারসাম্য হারান কবিতা। ঘুরতে-ঘুরতে পৌঁছে যান কলকাতার নারকেলডাঙা এলাকায়। পুলিশ সেখান থেকে কবিতাকে ভর্তি করে লুম্বিনীতে। শালুকে রিপন স্ট্রিটের একটি হোমে রাখা হয়। তবে লুম্বিনীর কাগজপত্রে শালু-র কথা লেখা ছিল না।

একটু সুস্থ হওয়ার পরে কবিতা লুম্বিনী হাসপাতালে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী শুক্লা দাস বড়ুয়াকে তাঁর ভাইয়ের ফোন নম্বর দেন। সেই নম্বরে ফোন করেই খোঁজ মেলে তাঁর পরিবারের। দিন কয়েক আগে উত্তরপ্রদেশের আকবরপুর থেকে কলকাতায় পৌঁছে যান কবিতার বাবা সীতারাম ও মা কমলা। কবিতা এবং তাঁর অভিভাবকেরা তখন শালু-র কথা জানতে চান। তাতে সমস্যায় পড়ে যান লুম্বিনী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কারণ তাঁদের নথিতে শালুর কথা লেখা নেই। তার পরে অনেক খুঁজে এবং পুলিশের সাহায্যে গত ১৩ মার্চ সালুকে ফিরে পান কবিতা। গত ১৭ মার্চ সকলে মিলে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন তাঁরা। লুম্বিনীর চিকিৎসকেরাই জানাচ্ছেন, হাসপাতালের সঙ্গে একটা ক্রেশ থাকলে মানসিক রোগীদের সন্তানদের হারিয়ে যাওয়া কমবে এবং মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিশুদের মানসিক ‘ট্রমা’ও হবে না।

একাধিক সরকারি হাসপাতালে মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের প্রধান রত্নাবলী রায়ের কথায়, “মানসিক রোগীদের অধিকার মানেই কিন্তু শুধু চিকিৎসার অধিকার নয়। তাঁদের উপযুক্ত পরিবেশে রাখা, মানবিক সুযোগসুবিধা দেওয়াটাও কর্তব্য। সন্তানের সঙ্গে দেখা করা এবং সন্তানের সান্নিধ্য পাওয়াটাও সেই বাধ্যতামূলক অধিকারের মধ্যে পড়ে, যার সম্পর্কে নীতি নির্ধারকেরা উদাসীন।” রত্নাবলী আরও জানিয়েছেন, দিল্লির একাধিক সরকারি হাসপাতালে ক্রেশ রয়েছে। সেখানে অ্যাটেন্ড্যান্টদের সঙ্গে গিয়ে মনোরোগী মায়েরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে পারেন, সময় কাটাতে পারেন, দুধ খাওয়াতে পারেন।এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের যত তাড়াতাড়ি বোধোদয় হয়, ততই ভাল বলে মনে করছেন মনোরোগীদের অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা।

parijat bandopadhyay mental patient to mental hospital Ripon Street social welfare department
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy