Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
রক্তে হিমোগ্লোবিন খুব বেশি হলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় পলিসাইথেমিয়া। জেনে নিন বিশদে
Polycythemia

Polycythemia: ঠিক সময়ে চিকিৎসা

যাঁরা তিব্বতে বাস করেন, তাঁদের হিমোগ্লোবিন সমতলের মানুষের তুলনায় বেশি।

সৌরজিৎ দাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২২ ০৬:৪২
Share: Save:

গায়ের রং লালচে ধরনের, চোখ রক্তবর্ণ— এমন মানুষ আমাদের চোখে পড়তে বাধ্য। যদি ওই ব্যক্তির রক্তপরীক্ষা করা হয় তা হলে সাধারণত দেখা যাবে, তাঁর হিমোগ্লোবিন খুব বেশি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের শারীরিক অবস্থাকে বলা হয় পলিসাইথেমিয়া। খেলোয়াড় বা যে সব মানুষ পাহাড়ি অঞ্চলে থাকেন, তাঁদের হিমোগ্লোবিন বেশি হয়। যাঁরা তিব্বতে বাস করেন, তাঁদের হিমোগ্লোবিন সমতলের মানুষের তুলনায় বেশি। যদিও তিব্বতের মানুষদের ক্ষেত্রে এটা কিন্তু কোনও শারীরিক সমস্যা নয়। তবে কিছু সিস্টেমিক ডিজ়িজ়ের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিন বেড়ে যায়। যেমন, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ এয়ারওয়ে ডিজ়িজ় বা লাং ফাইব্রোসিস, যেগুলি শ্বসনতন্ত্রের কিছু গুরুতর রোগ কিংবা যে সব শিশুর হৃদ্‌যন্ত্রে ফুটো রয়েছে এবং সেখানে রক্ত বাঁ দিক থেকে ডান দিকের বদলে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে বয়ে যায়, সেখানে এই সমস্যা দেখা যায়। যদি কারও এগুলির কোনওটাই না থাকে, তা হলে চিকিৎসকেরা ধরে নেন সেই ব্যক্তির প্রাইমারি ব্লাড ডিসঅর্ডার রয়েছে। একে বলে পলিসাইথেমিয়া রুবরা ভেরা। এই রক্তের সমস্যা নিয়ে বিশদে আলোচনা করলেন হেমাটোলজিস্ট শর্মিলা চন্দ্র।

রোগটি কী?
ডা. চন্দ্রর মতে, পলিসাইথেমিয়া রুবরা ভেরা এক ধরনের ম্যালিগন্যান্ট ব্লাড ডিসঅর্ডার যেটা পড়ে মায়েলোপ্রোলিফারেটিভ নিয়োপ্লাজ়ম (এমপিভি) গ্রুপের মধ্যে। যদিও এই সমস্যার মূল লক্ষণ বেশি মাত্রায় হিমোগ্লোবিন, তা হলেও এর ফলে অস্থিমজ্জার মধ্যে হিমাটোপয়েসিস প্রক্রিয়াটি বহু গুণ বেড়ে যায়। হেমাটোপয়েসিস হল মানুষের শরীরে বিভিন্ন রক্তকণিকা তৈরির প্রক্রিয়া। পলিসাইথেমিয়া রুবরা ভেরা-য় জেএকে২ নামে এক ধরনের অ্যাকোয়ার্ড জেনেটিক মিউটেশনের কারণে অস্থিমজ্জায় মায়েলয়েড কোষ প্রচুর রক্তকণিকা তৈরি করে ফেলে। তার ফলে রক্তের সমস্যাটি দেখে দেয়।

লক্ষণ
এই সমস্যায় লক্ষণগুলি খুব উল্লেখযোগ্য কিছু হয় না। মাথা ধরে থাকা, দপদপ করা, কান ভোঁ ভোঁ করা, মুখ লাল হয়ে থাকা, প্রচণ্ড রক্তচাপ, লিভার এবং স্প্লিন বেড়ে যাওয়া। ২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) পলিসাইথেমিয়া রুবরা ভেরা নির্ণয়ের জন্য কিছু শর্ত দিয়েছে। যেমন:
* হিমোগ্লোবিন অথবা লাল রক্তকণিকা বেশি থাকা
* অস্থিমজ্জায় ট্রাইলিনিয়েজ হিমাটোপয়েসিস দেখা যায়। ট্রাইলিনিয়েজ হিমাটোপয়েসিস হল সেই প্রক্রিয়া যেখানে তিন ধরনের রক্তকণিকা তৈরি হয় — প্লেটলেট, লাল রক্তকণিকা এবং শ্বেত রক্তকণিকা।
* সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শরীরে জিনগত মিউটেশন জেএকে ২ মিউটেশন পাওয়া যাবে। তা ছাড়া প্রাইমারি পলিসাইথেমিয়ায় এরিথ্রোপয়েটিন-এর (হরমোন যা অস্থিমজ্জাকে রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে) মাত্রা কম থাকে।

নির্ণয়
এ ক্ষেত্রে রোগীর রক্ত পরীক্ষা করা হয়— কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট। সেখানে হিমোগ্লোবিন এবং হেমাটোক্রিট (রক্ত কণিকার পরিমাণ)-এর মাত্রা দেখা হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১৬.৫ গ্রাম% এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ১৬.০ গ্রাম% -এর উপরে থাকলে এবং হেমাটোক্রিটের মাত্রাও বেশি হলে পলিসাইথেমিয়া রুবরা ভেরা নির্ণয়ের পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ ছাড়াও একটি জেনেটিক টেস্টও করা হয়— ‘জেএকে২ভি৬১৭এফ’। অধিকাংশ পলিসাইথেমিয়া কেসের এই টেস্টে পজ়িটিভ রেজ়াল্ট আসে বলেই জানালেন ডা. চন্দ্র।

নিরাময়
ডা. চন্দ্রর বক্তব্য, রোগী কতখানি কোমর্বিড অর্থাৎ তাঁর অন্য কোনও অসুখ আছে কি না, তাঁর থ্রম্বোসিসের কী ইতিহাস রয়েছে, বয়স কত— সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এই সব দেখে নেওয়া হয়। তার পরে সেই মতো শুরু হয় চিকিৎসা। ডা. চন্দ্রের মতে, রোগীর বয়স যদি অল্প হয় এবং হিমোগ্লোবিন যদি বেশি থাকে, তা হলে তার ফ্লেবোটেমি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় রোগীর শরীর থেকে রক্ত বার করে নেওয়া হয়, যতক্ষণ না হেমাটোক্রিট বা পিসিভি ৪৫-এর আশেপাশে হয়।

শরীরে রক্তকণিকা বেশি তৈরি হলে রক্ত ঘন হয়ে যায়। রক্তনালির মধ্য দিয়ে তা ধীর গতিতে বয়। ঘন রক্ত অনেক সময় জমাট বেঁধে গিয়ে শিরা এবং ধমনী বন্ধ করে দেয়। এর থেকে থ্রম্বোসিস হয়। তার ফলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে। রক্ত জমাট বাঁধা আটকানোর জন্য তাই অনেক সময়েই অ্যাস্পিরিন ব্যবহার করা হয়।
যেহেতু এই সমস্যায় শরীরে রক্তকণিকা বেশি তৈরি হয়, তাই তা কমানোর জন্য হাইড্রক্সিইউরিয়া গোত্রের ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু যদি হাইড্রক্সিইউরিয়াতেও কাজ না হয়, তা হলে ইন্টারফেরন, বুসুলফান, রাক্সলিটিনিব গোত্রের ওষুধ দেওয়া হয় শরীরে রক্তকণিকা বেশি তৈরি হওয়া কমানোর জন্য।

জটিলতা
এই ধরনের সমস্যায় রক্ত জমাট বাঁধার কারণে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস হতে পারে। যদি প্রত্যঙ্গে পর্যাপ্ত রক্ত না পৌঁছয়, তা হলে বুকে ব্যথা কিংবা সেরিব্রাল স্ট্রোক হতে পারে। লাল রক্তকণিকা বেশি হলে পেটে আলসার, গাউট কিংবা কিডনি স্টোন হতে পারে। এ ছাড়াও পলিসাইথেমিয়ার রোগীর শেষ জীবনে লিউকিমিয়া কিংবা মায়েলোফাইব্রোসিস-এর মতো গুরুতর রক্তের সমস্যা পর্যন্ত হতে পারে। লিউকিমিয়া হল ব্লাড ক্যানসার যা খুব তাড়াতাড়ি খারাপের দিকে চলে যেতে পারে। আর মায়েলোফাইব্রোসিসে অস্থিমজ্জা স্কার টিসুতে ভর্তি হয়ে যায়।

আয়ু
আগে যখন এই সমস্যার কোনও চিকিৎসা ছিল না, তখন লোকে দেড় থেকে তিন বছর বাঁচতেন। কিন্তু এখন বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার কারণে বয়স্ক মানুষেরা প্রায় ১৪ বছর বেশি আর যাদের বয়স ৬০ বছরের কম, তাঁরা ২৪ বছর বেশি বাঁচতে পারেন, এমনটাই অভিমত ডা. চন্দ্রের।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই রোগ সাধারণত জন্মগত নয়। ফলে কারও পলিসাইথেমিয়া থাকলে সেটা তাঁর সন্তানের মধ্যেও আসবে, এমন হয় না বলে জানালেন ডা. চন্দ্র। রোগটি অ্যাকোয়ার্ড জেনেটিক ডিসঅর্ডার। কোনও কারণে শরীরে জেএকে ২ মিউটেশনটি ঘটার ফলে এই রোগের সৃষ্টি হয়। এবং এই রোগ মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Polycythemia Health Blood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE