Advertisement
০৮ মে ২০২৪

শরীরে শর্করা তিতকুটে

ভারতে ডায়াবেটিস বাড়ছে হু-হু করে। এর সঙ্গে জড়িত হৃদরোগ, কিডনির রোগ, চোখের রোগও। কী ভাবে রাশ টানা যায় শরীরের শর্করা বৃদ্ধিতে, জানালেন রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক শ্যামল পোড়ে। ভারতে ডায়াবেটিস বাড়ছে হু-হু করে। এর সঙ্গে জড়িত হৃদরোগ, কিডনির রোগ, চোখের রোগও। কী ভাবে রাশ টানা যায় শরীরের শর্করা বৃদ্ধিতে, জানালেন রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক শ্যামল পোড়ে।

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:০৩
Share: Save:

ভারতকে এখন বলা হয় ‘ডায়াবেটিস ক্যাপিটাল।’ এ দেশে সমস্ত বয়সের মানুষের মধ্যে এই রোগ মারাত্মক ভাবে বেড়েছে। এতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও উদ্বিগ্ন। তবে অযথা আতঙ্কিত না-হয়ে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি। রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রিত না-হলে তা মানুষের প্রাণও নিতে পারে।

শিশুরাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে, তবে বয়স বাড়লে এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আজকাল আমরা তরুণ প্রজন্ম তো বটেই এমনকি ১৩-১৪র কিশোরদের মধ্যেও ডায়াবেটিস পাচ্ছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগ বংশানুক্রমিক। রক্তের সম্পর্ক আছে এমন পূর্বপুরুষ যেমন বাবা, মা, দাদু, ঠাকুমা এঁদের কারও ডায়াবেটিস থাকলে পরবর্তীকালে উত্তরপুরুষদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই থাকে। অনেক সময়ে দেখা যায়, বাবা-মা কারও ডায়াবেটিস নেই, তবে দাদু, ঠাকুমা, কাকা-পিসি বা রক্তের সম্পর্কের কারও রয়েছে। সে ক্ষেত্রেও সন্তানের ডায়াবেটিস হতে পারে।

ডায়াবেটিস হলে রক্তে শর্করা বা সুগারের পরিমান স্বাভাবিকের থেকে বৃদ্ধি পাওয়া। আমাদের দেহে এই শর্করা বা সুগারকে নিয়ন্ত্রণ করে ইনসুলিন হরমোন। অগ্ন্যাশয়ের বা প্যানক্রিয়াসের বিটা সেল থেকে এই ইনসুলিন হরমোন ক্ষরণ হয়। কোনও কারণে এই ইনসুলিন হরমোনের ক্ষরণ কমে গেলে বা ব্যাহত হলে শরীরে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। আবার অনেক সময়ে দেখা যায়, অসুখ বিসুখের জন্য বা অন্য কারণে বিটা সেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতেও ইনসুলিনের ক্ষরণ ধাক্কা খায়। রোগী তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগ বংশানুক্রমিক।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খাওয়া দাওয়ার উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এ ছাড়া পরিশ্রমসাধ্য কাজ করে শরীরের অতিরিক্ত ক্যালরি কমিয়ে ফেলতে হবে। মিষ্টি জাতীয় খাবার যাতে শর্করা আছে সেগুলো খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। ক্যালরি অর্থাৎ, খাবারের থেকে যে শক্তি আমরা পাই। এই ক্যালরির পরিমাণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখাটা জরুরি। তাতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। কী খেলাম সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে কতটা খেলাম। ফাস্ট ফুডের মত খাবারের পরিমাণ যেমন আমাদের কমাতে হবে, তেমনি যে সমস্ত খাবারে ক্যালরির পরিমান বেশি আছে সেই খাবার খাওয়াও কমাতে হবে। পরিশ্রমের কাজ করে শরীরে জমা হওয়া অতিরিক্ত ক্যালরি ঝরিয়ে ফেলতে হবে।

সাঁতার কাটা, ব্যায়াম করা এগুলো খুবই উপকারী। এ ছাড়াও দিনে তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট বা তিন থেকে চার কিলোমিটার ঘাম ঝড়িয়ে হাঁটতে হবে। সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন পরিশ্রমের কাজ করা উচিৎ। যে কাজে ক্যালরি ক্ষয় হয়। এ ছাড়াও পরিমিত বিশ্রাম, প্রয়োজনমতো ওষুধ, চিকিৎসকের পরামর্শ এবং নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করানো উচিত। যাঁদের ডায়াবেটিস আছে তাঁদের যাবতীয় উদ্বেগ বা টেনশন থেকে দূরে থাকতে হবে।

ইনসুলিন দিয়ে সুগার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

মনে রাখবেন, যাঁরা পরিশ্রমসাধ্য কাজ করেন তাঁদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। তবে একেবারে হবে না এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। আমরা রোগীদের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখি, এই অতিরিক্ত ক্যালরি যেন দেহে জমা না-হয়। খাবারের সঙ্গে যত পরিমাণ ক্যালরি দেহে যাচ্ছে সেটা যেন তার শরীরের প্রয়োজনমতো হয়। অতিরিক্ত না-হয়। এর জন্য কিছু পরিশ্রমের কাজ করতে হবে। চল্লিশ বছর পার করলেই আমাদের নিয়মিত প্রেসার, সুগার ইত্যাদি পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। বিশেষ করে যাঁদের পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে তাঁদের আরও বেশি করে এই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। গর্ভবতী মহিলাদের আমরা সুগার পরীক্ষা করাই। কারণ, গর্ভাবস্থায় একটা স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কাজ করে। ফলে, অনেক সময়েই দেখা যায়, রোগীর এমনিতে সুগার ছিল না কিন্তু গর্ভাবস্থায় সুগার ধরা পড়ে। ডেলিভারির পরে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়।

সহজে সারে না কাটা ঘা

কী দেখে বুঝবেন এই রোগ
• ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
• তেষ্টা পাওয়া।
• খাওয়ার পরও ঘন ঘন খিদে
পরিশ্রান্ত অনুভব করা।
• চোখে ঝাপসা দেখা।
• শরীরের বিভিন্ন অংশের কাটাছেঁড়া সহজে না-সারা।
• খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া
• হাতে-পায়ে ব্যথা বা মাঝে মাঝে অবশ হয়ে যাওয়া।

কী ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়
• পরিমিত আহার করা, ব্যায়াম করে ওজন কমানো।
• সকালের ব্রেকফাস্টে গুরুত্ব দিন।
• ফ্যাটযুক্ত খাবার বাদ দিন।
• ফাস্ট ফুড খাবেন না।
• কোল্ড ড্রিঙ্ক ত্যাগ করুন।
• আনাজ ও আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খান।
• মানসিক ভাবে চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন।
• পর্যাপ্ত ঘুম দরকার।
• প্রচুর জল খান।

কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তাঁর ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। সুগার নিয়ন্ত্রণে রেখেই যাবতীয় অস্ত্রোপচারের কাজ করা হয়। জরুরি অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে রোগীর যদি সুগার থাকে তখন অস্ত্রোপচার পিছিয়ে যেতে পারে। ইনসুলিন দিয়ে সুগার নিয়ন্ত্রণে এনে তবে অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, যে ওষুধ দেওয়া হোক না কেন ইনসুলিন ক্ষরণ ঠিক রাখতে হবে। সেই ওষুধ যেন ইনসুলিন কমিয়ে না-দেয়। ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে একে একে আমাদের চোখ, কিডনি, হৃদযন্ত্র-সহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকলে এ গুলো রোধ করা যায় অনেকটাই।

ফ্যাটযুক্ত খাবার বাদ দিন, ফাস্ট ফুড খাবেন না।

সুগার নিয়ন্ত্রণে না-থাকলে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যায় অনেকটাই। তা জমা হতে থাকে ধমনীতে। এতে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। হৃদযন্ত্রেও রক্ত চলাচলও ব্যাহত হতে পারে। তখন বুকে ব্যথা হয়। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।ডায়াবেটিসের কারণে আমাদের স্নায়ুর সক্রিয়তাও কমে যায়। ফলে আঘাত লাগলেও অনেক সময়ে ব্যথা অনুভব হয় না। এই কারণে অনেক সময়ে বুকে ব্যথা হলেও রোগী তা বুঝতে পারেন না। আমরা সেই জন্য রোগীকে ইসিজি করিয়ে নিই। যাঁদের ডায়াবেটিস আছে তাঁদের ক্ষেত্রে আমরা খালি পায়ে হাঁটাচলা করতে বারণ করি। কারন, আগেই বলেছি ডায়াবেটিস হলে স্নায়ুর সক্রিয়তা কমে যায়। সেই কারণে চলাফেরার সময়ে পায়ে কোনও আঘাত পেলে রোগী অনেক সময়ে টের পান না। একই কারণে হাত পায়ের নখও আমরা নিয়মিত, সাবধানে কাটতে বলি। কারণ, ডায়াবেটিসের রোগীর যে কোনও কাটা সহজে শুকোয় না, যে কোনও সংক্রমণ মারাত্মক রূপ নিতে পারে।

গ্যাংগ্রিন বা শরীরের অংশবিশেষে পচনও শুরু হতে পারে। সুগার থাকলে শরীরে কোনও সংক্রমণ বা ইনফেকশন যেমন দ্রুত বৃদ্ধি পাবে তেমনি ইনফেকশনের কারণেও সুগার বৃদ্ধি পাবে। কাজেই এই বিষয়ে সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। সুগারের ক্ষেত্রে ইউরিন ইনফেকশনও খুব বেশি হয়। সুগার একটি মানুষকে ভিতরে ভিতরে ফাঁপা করে দেয়। তাঁর পরিশ্রম করার ক্ষমতা লুপ্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে ওজন মারাত্মক কমে, চুল উঠে যায়, ত্বক খারাপ হয়ে যায়, মানসিক ভাবে রোগী বিধ্বস্ত হয়ে যায়। খাদ্যাভ্যাসে নিয়ন্ত্রণ এনে ডায়াবেটিস মাত্রার মধ্যে ধরে রাখা তাই অত্যন্ত জরুরি।

ছবি: প্রণব দেবনাথ ও নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Diabetes Symptoms Treatment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE