Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
এম আর বাঙুর

রোগিণীকে বাঁচাতে রক্ত দিলেন ডাক্তার

বছর কুড়ির মেয়েটিকে নিয়ে তাঁর পরিবারের লোকেরা যখন হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন, ততক্ষণে তাঁর চেতনা হারিয়েছে। টানা এক মাস অবিরাম রক্তস্রাবে ধ্বস্ত তরুণীর হিমোগ্লোবিন নেমে গিয়েছে দুই-এ। গোটা শরীর ফুলে গিয়েছে। গাইনি ইমার্জেন্সির কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝলেন অবিলম্বে রক্ত না দিলে যে কোনও মুহূর্তে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হতে পারে।

চিকিৎসক অশোক সামন্ত

চিকিৎসক অশোক সামন্ত

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৪ ০২:৪৯
Share: Save:

বছর কুড়ির মেয়েটিকে নিয়ে তাঁর পরিবারের লোকেরা যখন হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন, ততক্ষণে তাঁর চেতনা হারিয়েছে। টানা এক মাস অবিরাম রক্তস্রাবে ধ্বস্ত তরুণীর হিমোগ্লোবিন নেমে গিয়েছে দুই-এ। গোটা শরীর ফুলে গিয়েছে। গাইনি ইমার্জেন্সির কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝলেন অবিলম্বে রক্ত না দিলে যে কোনও মুহূর্তে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হতে পারে। বি পজিটিভ রক্ত আনতে বলা হল বাড়ির লোককে। কিন্তু হাসপাতালের নিজস্ব ব্লাড ব্যাঙ্ক জানিয়ে দিল, ওই মুহূর্তে ওই গ্রুপের এক ইউনিট রক্তও তাদের কাছে মজুত নেই। রেফার করা হল সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা পরিবারের সদস্যরা কলকাতার কিছুই প্রায় চেনেন না। সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক কোথায় তা বুঝে নিতে তাঁরা শরণাপন্ন হলেন ডাক্তারবাবুর। কথা বলে ডাক্তারবাবু বুঝলেন, কলকাতার রাস্তাঘাট সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই তাঁদের। ফলে নানা জায়গায় ঠোক্কর খেয়ে মানিকতলা পৌঁছে সেখানে ব্লাডব্যাঙ্কে রক্তের ক্রস ম্যাচিং করে তা নিয়ে আসতে আসতে ছ’-সাত ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে। ততক্ষণ কি প্রাণ থাকবে মেয়েটির দেহে?

মনে এই সংশয় আসা মাত্র আর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি ওই চিকিৎসক। তাঁর নিজেরও ওই একই গ্রপের রক্ত। তৎক্ষণাৎ তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজের রক্ত দিয়েই মেয়েটির প্রাণ বাঁচাবেন। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। তড়িঘড়ি রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা হল, হাসপাতালের নিজস্ব ব্লাড ব্যাঙ্কে জরুরি ভিত্তিতে রক্তের ক্রস ম্যাচিং করানোর পরে মেয়েটিকে রক্ত দেওয়া শুরু হল। মেয়েটির বিপদ কাটিয়ে ডাক্তারবাবু ফের ফিরে গেলেন ইমার্জেন্সিতে।

নজিরবিহীন ভাবে চিকিৎসকের রক্তে প্রাণ বেঁচেছে সাবেরা খাতুন নামে ওই তরুণীর। কলকাতার এম আর বাঙুর হাসপাতালের এই ঘটনা রাজ্যের চিকিৎসক মহলের ভাবমূর্তিকেই আরও উজ্জ্বল করল বলে মনে করছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অশোক সামন্ত নামে ওই চিকিৎসক অবশ্য একে আলাদা ভাবে কোনও গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁর কথায়, “ওই মুহূর্তে মেয়েটির প্রাণ বাঁচাতে এটাই সবচেয়ে জরুরি বলে মনে হয়েছিল। কাজটা করলে লোকে প্রশংসা করবে, এমন কিছু ভেবে এটা করিনি। এখন সকলে প্রশংসা করছেন বলে মনে হচ্ছে সকলকে ডেকে বলি, বাহবা দেওয়ার দরকার নেই, ডাক্তারদের গায়ে কালি ছেটানোর আগে শুধু দয়া করে একটু ভাববেন।”

বাঙুরের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও ওই চিকিৎসককে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, “এই হাসপাতালের হাল ফেরাতে আমরা বদ্ধপরিকর। এর জন্য অশোকবাবুদের মতো মানুষকেই বড় বেশি দরকার।” একই কথা বলেছেন সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ও। অশোকবাবুর দৃষ্টান্ত অন্যদের কাছেও তুলে ধরছেন তিনি। সোমনাথবাবু জানান, রোগীকল্যাণ সমিতির পরবর্তী বৈঠকে অশোকবাবুকে সংবর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। হাসপাতালের সহকারী সুপার সেবন্তী মুখোপাধ্যায় বলেন, “ডাক্তারবাবু নিঃশব্দে ঘটনাটা ঘটিয়েছেন। কাউকে বলেননি। বিভাগের অন্যদের কাছে আমরা বিষয়টি জানতে পারি। এমন ডাক্তাররা থাকলে হাসপাতালের পরিষেবার উন্নতি হতে বাধ্য।”

বি পজিটিভ রক্তের কোনও বিরল গ্রুপ নয়। প্রশ্ন উঠেছে, তবু রাজ্যের এক জেলা সদর হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে তা মজুত ছিল না কেন? ওই ব্লাড ব্যাঙ্কের মেডিক্যাল অফিসার সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ইদানীং সারা বছর ধরেই রক্তের আকাল চলছে। রবিবার যে ক্যাম্পগুলো হয়, সেখানে ২৫-৩০ জনের বেশি রক্ত দেন না। বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি বহু সময়েই টাকা বা উপহার দিয়ে রক্তদাতাদের আকৃষ্ট করে নেয়। সরকারি ক্যাম্পে তো সে সব নেই।”

২০১২-র সেপ্টেম্বরে বাঙুরে যোগ দিয়েছেন অশোকবাবু। এর আগে ছিলেন এসএসকেএম হাসপাতালে। বললেন, “আমার নিজের বাড়িও প্রত্যন্ত জেলায়। তাই শহরে এসে মানুষের ভোগান্তিটা ভালই টের পাই। ঠিক কোথায় যেতে হবে, তা বুঝতে না পেরে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন বহু মানুষ। ডাক্তার হিসেবে এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। তাই ওঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।”

আর যাঁর জীবন বাঁচল, সেই সাবেরা কী বলছেন? সদ্য হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া তরুণীর চোখে জল। বললেন, “আমার তো বাঁচারই কথা নয়। এই জীবন ওই ডাক্তারবাবুরই দান।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE