Advertisement
০১ মে ২০২৪
Children Health

অতিরিক্ত ‘স্নেহ’ ভাল নয়

শিশুদের মধ্যে বাড়ছে ফ্যাটি লিভারের প্রবণতা, যা ভবিষ্যতে ডেকে আনতে পারে কঠিন রোগবালাই। সময় থাকতে সতর্ক হতে হবে।

An image of Heart

—প্রতীকী চিত্র।

নবনীতা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩ ০৮:১৫
Share: Save:

ছোটদের মধ্যে ফ্যাটি লিভারের প্রবণতা এখন খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। তার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে নানা রোগবালাই। এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই তার অন্যতম কারণ।

ছোটদের মধ্যে ফ্যাটি লিভার বাড়ছে কেন?

এই প্রসঙ্গে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী বললেন, “ফ্যাটি লিভার এক ধরনের ক্রনিক লিভার ডিজ়িজ়। বড়দের ক্ষেত্রে অ্যালকোহলিক লিভার ডিজ়িজ়। ছোটদের ক্ষেত্রে এটা নন-অ্যালকোহলিক লিভার ডিজ়িজ়। ইদানীং বাচ্চারা প্রচুর পরিমাণে জাঙ্ক ফুড খাচ্ছে। এখনকার বাচ্চারা মল-কালচারে অভ্যস্ত। ফলে সেখানে গিয়েই পিৎজ়া, বার্গার, কোল্ড ড্রিঙ্কস, কেক-পেস্ট্রির মতো এনার্জি ডেনস খাবার খাচ্ছে। এর ফলে শরীরের ইনসুলিন সিক্রিশন বেড়ে যায়। তার সঙ্গে বাইরে থেকে যে ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো আসছে, তার ফলে লিভার লাইপোজেনেসিস করছে। ফলে লিভার সেলের হেপাটোসাইটিসের মধ্যেই ফ্যাট জমা হচ্ছে। এই রোগের মূল কারণ হল ওবেসিটি, ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স ও ফিজ়িক্যাল ইনঅ্যাক্টিভিটি।” বেশির ভাগ বাচ্চারই এখন সময় কাটে চার দেওয়ালের মধ্যে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে একটু ঘুম, তার পরেই উঠে পড়তে বসা আর অবসরে টিভি বা মোবাইল দেখা। দৌড়ঝাঁপ করে নিয়মিত খেলার অভ্যেস প্রায় নেই-ই। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অতিরিঙ্ক জাঙ্ক ফুড। সব মিলিয়ে যে জীবনযাপনে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, তা থেকেই নানা রোগবালাইয়ের সূত্রপাত।

তবে এর সঙ্গে যদি কিছু জেনেটিক্যাল রোগবালাই বা মেটাবলিক ডিজ়িজ় থাকে, তা হলে রোগটা ট্রিগার করে। যেমন প্রেডার-উইলি সিনড্রোম, গ্লাইকোজেন স্টোরেজ ডিজ়িজ়, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম ইত্যাদি থাকলে সেই শিশুর ফ্যাটি লিভারের প্রবণতা থাকবে। তবে এ বিষয়ে আর-একটি দিক উল্লেখ করলেন ডা. রায়চৌধুরী। শুধু ফ্যাটি লিভারের প্রবণতা থাকলে তা কম ক্ষতিকর। তবে তার সঙ্গে যদি ইনফ্লামেশন দেখা দেয়, তা হলে কিন্তু খারাপ। তা থেকে পরে ফাইব্রোসিস, সিরোসিস অব লিভার হতে পারে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা কম, তবে সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তুবাচ্চার ফ্যাটি লিভার হলে তা বোঝার উপায় কী?

—প্রতীকী ছবি।

রোগনির্ণয়

বাচ্চাদের পেটের ডান দিকে হালকা ব্যথা দেখা দিতে পারে। তবে বাচ্চারা অনেক সময়েই পেটে ব্যথা বলে অভিযোগ করে। সব পেট ব্যথাতেই দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে মনে করছেন ডা. রায়চৌধুরী। সাধারণত বাচ্চা পেটে ব্যথা বলার পরে তাকে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা দরকার। যদি দেখা যায়, তার কিছুক্ষণ বাদেই সে খেলতে শুরু করে দিচ্ছে, তা হলে চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু বাচ্চা যদি পেটের ব্যথায় কুঁকড়ে যায়, শুয়ে পড়ে, স্কুলে যেতে না পারে, তার দৈনন্দিন রুটিন নষ্ট হয়, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আর-একটি দিকও উল্লেখ্য, ফ্যাটি লিভারে সব সময়েই যে কোনও উপসর্গ দেখা দেবে, এমনটা নয়। কোনও উপসর্গ না-ও থাকতেপারে। তাই বাচ্চা ওবিস হলে সতর্ক হতে হবে।

সাধারণত আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করতে দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমেই ফ্যাটি লিভার শনাক্ত করা যায়। ডা. দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী আরও কয়েকটি দিক উল্লেখ করে বললেন, “ফ্যাটি লিভার শনাক্ত হলে আরও কিছু বিষয় তার সঙ্গে যুক্ত থাকে। দেখা যায়, সেই বাচ্চাটি ওবিস বা ওভারওয়েট। লিভারও বড় হয়। তার সঙ্গে পেটের তলায় স্ট্রেচমার্কস দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের বাচ্চাদের ঘাড়ের অংশে বা কাঁধের জাংশনে ভেলভেটি ব্রাউন বা কালো রঙের পিগমেন্টেশন দেখা যায়। এগুলো দেখে আরও কিছু পরীক্ষা দেওয়া হয়। যেমন ফাস্টিং ব্লাড সুগার, সেরাম ইনসুলিন পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। ফ্যাটি লিভার থাকলে ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রি-ডায়াবিটিস বা টাইপ টু ডায়াবিটিসের ভয়ও থাকে। লিভার ফাংশন টেস্ট করলে এসজিপিটিও বেশি আসতে পারে। তার সঙ্গে ইউএসজি তো করতেই হবে।” দরকার পড়লে লিভার বায়পসিও করা হয়।

চিকিৎসা

ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় প্রথমে ভিটামিন ই দেওয়া হয়। আর্সোডিয়ক্সিকোলিক অ্যাসিডও দেওয়া হয়। ওবেসিটি কমানোর জন্য অনেক সময়ে মেটফরমিনও দেওয়া হয়ে থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ যেমন চলবে, তার সঙ্গে জীবনযাপনে বদল আনাও জরুরি। শুধু ওষুধে নির্ভর করে থাকলে হবে না। প্যাকেটজাত, ভাজাভুজি, চিজ়যুক্ত খাবার, অতিরিক্ত চকলেট খাওয়া বন্ধ করতে হবে। তার বদলে সুষম আহার জরুরি। রোজ প্রচুর পরিমাণে আনাজপাতি, ফল খাওয়ান সন্তানকে। পেঁপে, গাজর, বিনস, পটল ইত্যাদি মরসুমি আনাজ দিয়ে মাছের ঝোল রাঁধতে পারেন। খেয়াল রাখবেন, একগাদা তেলে যেন ঝোলের আনাজ ভাজা না হয়। এতে খাদ্যগুণ নষ্ট হয়। শসা, পেঁয়াজ, টম্যাটো, লেটুস দিয়ে স্যালাড করে দিতে পারেন। ২টি করে মরসুমি ফল রাখুন রোজ খাদ্যতালিকায়। তা হলেই দেখবেন সন্তানের পেট বেশ ভরা থাকবে। আর স্ন্যাকস জাতীয় খাবারের জন্য শুকনো কড়াইয়ে নাড়া মুড়ি, চিঁড়ে, মাখনা রাখতে পারেন। স্বাদের জন্য নয়, স্বাস্থ্যের জন্য ভাল, এমন খাবার নির্বাচন করতে হবে।

শারীরচর্চা বা খেলাধুলোও জরুরি। দিনের একটা সময় বাচ্চার খেলার জন্য ধার্য করুন। খোলা মাঠে দিনে অন্তত এক ঘণ্টা যেন সে দৌড়াদৌড়ি করে খেলে। তার সুযোগ না থাকলে দিনে এক ঘণ্টা সাঁতার বা কোনও ব্যায়ামের অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। তবে সবটাই রুটিনে বেঁধে ফেললে বাচ্চার মানসিকক্লান্তি দেখা দেবে। তাই তার মনের খোরাক যেন মেলে, সে ভাবেই অভিভাবককে পুরোটা পরিকল্পনা করতে হবে।

জীবনযাপন নিয়ন্ত্রিত হলে, রোগবালাইও ধীরে-ধীরে কমে আসবে। তবে সন্তানের ওজন নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মাপতে হবে। ওবেসিটি দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Children Health Fast food Fatty Liver
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE