Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চিন্তা করুন, দুশ্চিন্তা দূরে সরিয়ে রাখুন

প্রকাশিত হতে চলেছে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল। তার মাঝে ভোটের ফল। এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন পরীক্ষার্থী, অভিভাবক, রাজনৈতিক কর্মী, এমনকি, সাধারণ মানুষও। কী ভাবে এর থেকে মুক্তি মেলে তা নিয়ে আলোচনা করলেন মনোরোগ চিকিৎসক প্রতনু সাহাযোগা বা মেডিটেশন করলেও উপকার পাওয়া যেতে পারে। ‘রিল্যাক্সেশন টেকনিক’ বা চিন্তামুক্তির পদ্ধতি হিসেবে এগুলি অত্যন্ত ফলপ্রসূ।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৯ ০২:২৫
Share: Save:

প্রশ্ন: সামনের সপ্তাহেই মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বেরোবে। পরীক্ষার্থী এবং তাদের বাবা-মায়েরা চিন্তিত। এর মাঝে প্রকাশিত হবে লোকসভা ভোটের ফলও। তা নিয়ে সকলেই চিন্তিত। এই চিন্তা বা ‘টেনশন’ কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?

উত্তর: প্রথমেই বলে রাখা ভাল, কিছু নিয়ে চিন্তা করার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা আমাদের রয়েছে। একে ছেঁটে ফেলা সম্ভব নয়। জীবন যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণই ‘চিন্তা’, ‘দুশ্চিন্তা’ বা ‘টেনশন’, যাই বলি তাও থাকবে। তবে মনে রাখা দরকার, একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত ‘টেনশন’ বা ‘চিন্তা করা’ উপযোগী। চিন্তা না করলে আমরা কোনও লক্ষ্যপূরণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি না। অর্থাৎ চিন্তা আমাদের প্রেরণা জোগায়। ভবিষ্যতের চিন্তা আমাদের নানা বিপদ সম্পর্কেও সজাগ করে। তাই কোনও প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকতে গেলে সামান্য চিন্তা করা ভাল। খুব বেশি চিন্তা বা একেবারেই চিন্তা না থাকা— দু’টি বিষয়ই পরীক্ষার ফলের উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিন্তু রেজাল্টের আগে ‘টেনশন’ বা দুশ্চিন্তা করাটা মোটেও কাম্য নয়। এমন দুশ্চিন্তা হলে, নিজেকে বোঝাতে হবে যে ‘পারফরম্যান্স’ যা করার তা আগেই করে ফেলেছি। এখন কোনও কিছুই আমাদের হাতে নেই। দুশ্চিন্তা করলেও যা ফল হবে, না করলেও তা হবে। দুশ্চিন্তা করলে শরীরের ক্ষতি হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এ কথাটি প্রযোজ্য। যেটা আমার হাতে নেই, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে শরীরের ক্ষতি করব না— এই মানসিকতাটা দরকার। পরীক্ষা যে দিন শেষ হবে, সে দিন থেকেই নিজেকে বোঝাতে হবে যে আমি আমার দিক থেকে নিজের ১০০ শতাংশ দিয়েছি। এর পরে ফলাফল যা হবে, তা মেনে নিতেই হবে। সে ভাবেই প্রস্তুত থাকতে হবে। এই কথাটি অভিভাকদের তাঁদের সন্তানদেরকে বোঝাতে হবে।

প্রশ্ন: কিন্তু পরীক্ষার ফলপ্রকাশের আগে তো খারাপ ফলের আশঙ্কা করাটাও তো স্বাভাবিক। সেই কারণে ‘টেনশন’ হওয়ার আশঙ্কা তো থেকেই যায়। এটি কাটিয়ে উঠতে গেলে কী করণীয়?

উত্তর: বিষয়টি একদম ঠিক। পরীক্ষার পরে খারাপ ফল একটা আশঙ্কা মনে থেকেই যায়। এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজের চিন্তা ভাবনার স্রোতকে সচেতন ভাবে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। ধরে নেওয়া যাক ফল খারাপই হবে। তা হলে সে ক্ষেত্রে কী কী ঘটবে বা ঘটতে পারে সেটা ভাবতে হবে। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কী কী উপায় আমাদের সামনে রয়েছে, অর্থাৎ আমি কী ভাবে সেই পরিস্থিতিকে কাটিয়ে উঠতে পারি সেই পদক্ষেপগুলি সম্পর্কে ভাবতে হবে। নিজেকে বারবার বোঝাতে হবে, একটি পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল হলেই জীবন শেষ হয়ে যায় না। তার পরেও জীবনের অনেকটা অংশ পড়ে থাকবে। আবার সফল হওয়ার সুযোগও আসবে জীবনে। ছেলেমেয়েদের এই বার্তাটা অভিভাবকদের তরফ থেকেই পৌঁছে দেওয়া দরকার, যে ফলাফল যেমনই হোক না কেন তোমার প্রতি আমাদের স্নেহ এবং আস্থা একই রকম থাকবে। তাঁরা যেন তাঁদের সন্তানদের এটা বোঝাতে সমর্থ হন যে, তোমার পরীক্ষার ফলাফলের থেকে তুমি আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানদের শুধু মৌখিক ভাবে এই কথাটি বললেই চলবে না, নিজেদেরও অন্তর থেকে কথাটি বিশ্বাস করতে হবে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে এই মানসিক সমর্থনটা পেলে ছেলে-মেয়েদের পক্ষে টেনশন নিয়ন্ত্রণ করাটা অনেকটা সহজ হয়ে যায়।

প্রশ্ন: কিছু অভিভাবক ভাল ফলের জন্য সন্তানকে চাপ দেন না, বন্ধুর মতো আচরণ করেন। কিন্তু অনেক অবিভাবককেই বলতে শুনেছি, সন্তান নিজেই লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছে। বিশেষত, মেধাবী পড়ুয়াদের মধ্যে এই প্রবণতা খুব বেশি দেখা যায়। আমাকে একটি নির্দিষ্ট শতাংশ নম্বর পেতে হবে বা কোনও নির্দিষ্ট প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হতে হবে। তাঁদের দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি কী হতে পারে?

উত্তর: কথাটা ঠিক। বর্তমান প্রজন্মের পড়ুয়ারা অনেকেই নিজের মতো একটি লক্ষ্য তৈরি করে নেয়। তার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করে। স্কুলের নিচু ক্লাস থেকেই একটা লক্ষ্য সামনে রেখে নিজেকে অনুপ্রাণিত করে। এটা এক দিক থেকে খুবই ভাল। সামনে কোনও লক্ষ্য না থাকলে এগনো কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের একটাই কথা বলার আছে, তা হল, লক্ষ্যটা যদি ‘প্ল্যান-এ’ হয় তা হলে, পাশাপাশি, সব সময়ে একটা ‘প্ল্যান বি’ বা দ্বিতীয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। প্ল্যান-এ সফল না হলে প্ল্যান বি অনুসারে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এতে পরীক্ষার আগে অমুক বিষয়টা করতে না পারলে আমার জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে গেল সেই বোধটা কাজ করবে না। আর তাতে মনখারাপ বা টেনশনও অনেকটাই কম হবে। এই পর্যায়ের পড়ুয়ারা আর একটি ভুল করে। তারা সবসময়ে বন্ধুদের সঙ্গে নিজের তুলনা করে। এই বিষয়টি মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। তুলনাটা হওয়া উচিত সহপাঠীর সঙ্গে নয়, নিজের অতীতের পারফরম্যান্সের সঙ্গে। অভিভাবকেরাও অনেক সময় এই ভুলটা করে ফেলেন। রেজাল্ট খারাপ হলে সহপাঠীদের রেজাল্টের সঙ্গে তুলনা করে সন্তানকে বকাঝকা করেন। এটা মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে একেবারেই উপযুক্ত নয়। এতে সন্তানের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। ভবিষ্যতের ফলাফলের আশঙ্কাও থাকে।

প্রশ্ন: অভিভাবকদেরও তো সন্তানের ফলাফল নিয়ে প্রত্যাশা থাকে। সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার আশঙ্কাও থাকে। তাঁরা কী ভাবে নিজেদের চাপমুক্ত রাখবেন?

উত্তর: বাবা-মায়েরা এ ভাবে দুশ্চিন্তা করলে তা সন্তানের মধ্যেও সংক্রমিত হবে। এমনকি, মুখে কিছু না বললেও যদি তাঁদের আচার, আচরণে কোনও উদ্বেগ থাকলে তা সন্তানের নজর এড়ায় না। সুতরাং সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। টেনশন হলে মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে। বোঝাতে হবে, যদি সন্তানের ফল আশানুরূপ না হয়, সে ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় পড়ার সুযোগ তার সামনে থাকবে, কী ভাবে পরে তাঁর সন্তান আবার সাফল্যের রাস্তার ফিরতে পারে। অর্থাৎ আগের ‘প্ল্যান এ’-র পাশাপাশি, ‘প্ল্যান বি’। আসলে ‘টেনশন’ বা উদ্বেগ হলে যুক্তি দিয়ে ভাবার ক্ষমতা সাময়িক ভাবে লুপ্ত হয়ে যায়। মনে হয়, আশানুরূপ ফল করতে না পারলে সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কিন্তু সে যে অন্য কোনও বিষয়ে সফল হতে পারে সেই ভাবনাই মাথা থেকে বেড়িয়ে যায়। অনেকে শুধুই নেতিবাচক চিন্তার বশবর্তী হয়ে পড়েন। এই চিন্তার অভিমুখটাই ঘোরানো প্রয়োজন। এটা পারলে তখন সন্তানের ব্যর্থতার চিন্তায় হাত-পা অসাড় হয়ে আসবে না। সব সময়েই ভবিষ্যতের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু’টি দিক নিয়েই চিন্তা করতে হবে। আমরা নেতিবাচক বিষয়েই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি, অথচ এই দিকটি অত্যন্ত অস্পষ্ট এবং কাল্পনিক। ফলে দুচিন্তা করার প্রবণতাটাও এ ক্ষেত্রে বেশি হয়। কিন্তু যদি নেতিবাচক বলে যাকে ভাবছি তার আদলটা চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়, তখন আর বিষয়টি অতটা ভয়ঙ্কর থাকে না। অর্থাৎ যদি আমরা বুঝতে পারি মাধ্যমিক স্তরে অমুক বিষয়ে খারাপ নম্বর পাওয়ায় তার উচ্চ মাধ্যমিকে অমুক বিষয়টা পড়া হবে না তা হলে চিন্তাটা অন্য দিকে ঘোরানোর ক্ষেত্র তৈরি করাটা সহজ হয়। এই কারণেই প্রথম থেকে ‘প্ল্যান বি’ তৈরি করা থাকলে চিন্তার বহরটাও যেমন কম হয়, তেমনই নেতিবাচক দিকেরও একটা স্বচ্ছ ও মূর্ত রূপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাতে সমস্যা কমে। চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি অভিভাবক এবং সন্তান— সকলেরই দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার জন্য স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখা, নিয়মিত শরীরচর্চা করা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, গল্প করা, গান শোনা যতটা সম্ভব চালিয়ে যেতে হবে। ছেলেমেয়েরা যদি নিয়মিত খেলাধুলো বা সাঁতারে অভ্যস্ত থাকে সে ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলি তাদের চিন্তামুক্ত থাকতে সাহায্য করে। এগুলি সম্ভব না হলে টেনশনের সময় আধঘণ্টা করে খোলা মাঠে হেঁটে এলেও দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রিত হবে।

প্রশ্ন: এত কিছুর পরেও যদি টেনশন নিয়ন্ত্রণে না থাকে তবে কী করণীয়?

উত্তর: এই সমস্যার জন্য তো ওষুধ রয়েছে। তবে তার আগে বলব, ‘ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ’ বা প্রাণায়াম করা দরকার। যোগা বা মেডিটেশন করলেও উপকার পাওয়া যেতে পারে। ‘রিল্যাক্সেশন টেকনিক’ বা চিন্তামুক্তির পদ্ধতি হিসেবে এগুলি অত্যন্ত ফলপ্রসূ। ‘ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ’ আর কিছুই নয়, এক নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে আর এক নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়া। কয়েক বার করলে শরীরে মাংসপেশি শিথিল হয়ে আসবে এবং ‘রিল্যাক্সড’ মনে হবে। প্রতি দিন মিনিট দশেক সময় নিয়মিত করলে টেনশনের সময়েও শ্বাস-প্রশ্বাসের হার এবং হৃদস্পন্দনের গতিও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর এই সব কিছু করেও যাঁরা টেনশনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন না তাঁদের স্বল্পমেয়াদে ওষুধ খেতে হবে। বিশেষত টেনশনের জন্য যাদের ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে বা দৈনন্দিন কাজে মনসংযোগ করতে সমস্যা হচ্ছে অথবা ‘অ্যাংজাইটি’-র শারীরিক উপসর্গগুলি, যেমন বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসপ্রশ্বাসের হার খুব বেড়ে যাওয়া, হাত-পা কাঁপা, খেতে না পারা, বমি ভাব ইত্যাদি অনুভূত হচ্ছে তাঁদের ক্ষেত্রে ‘অ্যান্টি অ্যাংজাইটি’ ওষুধ খুব দ্রুত টেনশনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে এবং রিল্যাক্সড বোধও হবে।

মনে রাখুন

যেটা আমার হাতে নেই, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে শরীরের ক্ষতি করব না— এই মানসিকতাটা দরকার। প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কী কী উপায় আমাদের সামনে রয়েছে, অর্থাৎ আমি কী ভাবে সেই পরিস্থিতিকে কাটিয়ে উঠতে পারি সেই পদক্ষেপগুলি সম্পর্কে ভাবতে হবে। নিজেকে বারবার বোঝাতে হবে, একটি পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল হলেই জীবন শেষ হয়ে যায় না। অভিভাবকেরা সন্তানদের বোঝান, ফলাফল যেমনই হোক তোমার প্রতি আমাদের স্নেহ এবং আস্থা একই রকম থাকবে। পরীক্ষার ফলাফলের থেকে তুমি আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ’ বা প্রাণায়াম করা দরকার। যোগা বা মেডিটেশন করলেও উপকার হবে। ‘রিল্যাক্সেশন টেকনিক’ বা চিন্তামুক্তির পদ্ধতি হিসেবে এগুলি অত্যন্ত ফলপ্রসূ।

সাক্ষাৎকার: বিপ্লব ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health Mental Healtn Stress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE