এনসেফ্যালাইটিসের সংক্রমণ রুখতে গিয়েও রাজনীতি করার অভিযোগ উঠল উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের বিরুদ্ধে। গৌতমবাবু উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান পদেও রয়েছেন। ওই হাসপাতালে গত ১১ দিনে এনসেফ্যালাইটিসে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ৪ জন জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে মারা গিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর উদ্যোগে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে পর্যালোচনা বৈঠক ডাকা হয়। সেখানে শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়র অশোক ভট্টাচার্যকে না জানিয়ে সরাসরি পুর কমিশনারকে ডেকে প্রচারের ট্যাবলো বার করার নির্দেশ দেন মন্ত্রী। বাস্তবে, মেয়রের অনুমতি ছাড়া ওই কাজ করা সম্ভব নয়।
মন্ত্রীর ওই নির্দেশের কথা জানার পরেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন মেয়র। তিনি বলেন, ‘‘শহর ও লাগোয়া এলাকায় এনসেফ্যালাইটিস ছড়াচ্ছে। এটা সকলে মিলে রুখতে হবে। অতীতে মারণ জ্বরের সময়ে আমি পুরমন্ত্রী হিসেবে সকলকে ডেকে একযোগে কাজ করেছি। তৃণমূল নেতাদের ডেকেও পরামর্শ নিয়েছি।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রোগ প্রতিরোধ নিয়েও রাজনীতি করছেন। সে জন্য মেয়রকে না জানিয়ে পুর কমিশনারকে ডেকে পাঠাচ্ছেন।’’ মেয়র জানান, মন্ত্রী তাঁকে জানালে পুরসভার চিকিৎসককেও তিনি বৈঠকে পাঠাতেন। কারণ, শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় আক্রান্ত হচ্ছেন বাসিন্দারা। সে ক্ষেত্রে পুরসভার সঙ্গেও যথাযথ সমন্বয় হতো।
মেয়রকে এড়িয়ে কেন পুর কমিশানরকে ডেকে নির্দেশ দিলেন? এই প্রশ্নের জবাবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী বলেন, ‘‘অভিযোগ নিয়ে কিছু বলতে চাই না। পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক ডাকতে বলা হয়েছিল উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের অধ্যক্ষকে। পুরসভার প্রতিনিধি হিসেবে সর্বোচ্চ আধিকারিক পুর কমিশনারকে ডাকা হয়েছিল। তিনি এসেছিলেন।’’
জ্বর নিয়ে ভর্তি কিশোরের চিকিৎসা চলছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে।
শনিবার সন্দীপ পালের তোলা ছবি।
পরিস্থিতি উদ্বেগজনক নয় বলেও এ দিন দাবি করেছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘তবু রোগ সম্পর্কে সচেতনতা প্রচারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় ফ্লেক্স লাগানো হবে। এফএম চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচার করা হবে। স্বাস্থ্য দফতর এবং পুরসভার তরফে ট্যাবলো বার করে সচেতনতা প্রচারের কথা জানানো হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকা আবর্জনা সাফ করতে বলা হয়েছে।’’
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে ৭ জন এবং অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোমে ১৩ জন মারা গিয়েছেন। তার মধ্যে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল মাসে মারা গিয়েছেন ২, ১, ২ এবং ১ জন করে। সকলেই এইএসে। মে মাসে ৪ জন মারা গিয়েছেন তার মধ্যে ১ জন জেই এবং বাকি তিন জন এইএস। জুনে মারা গিয়েছেন ৩ জন। তার মধ্যে ২ জন জেই। জুলাইতে এখনই ৭ জন মারা গিয়েছেন। গত কাল সকালে আরতি মণ্ডল নামে আমবাড়ির কামারভিটার বাসিন্দা এক মহিলা মারা যান। তিনি সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা।
শনিবার তাঁর রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ সমীর ঘোষ রায় জানান, আরতিদেবী জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত ছিলেন। এখনও পর্যন্ত উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ভর্তি ১২৩ জন রোগীর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৪ জনের শরীরে জেই মিলেছে। ৬৫ জন এইএস বলে জানানো হয়েছে। বিভিন্ন জেলা হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে ভর্তি ১২০ জনের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তার মধ্যে ২৪ জনের রক্তে জেই মিলেছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে এ দিন ১৯ জন রোগী জেই বা এইএস নিয়ে ভর্তি রয়েছেন। ৩ জনের রক্তে জেই জীবাণু মিলেছে। মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, শিলিগুড়ি পুর এলাকার ২ জনের রক্তে জেই মিলেছিল। এক জন হায়দরপাড়ার বাসিন্দা। তিনি সুস্থ হয়েছেন। অপর জন শালুগাড়া এলাকার।
এনসেফ্যালাইটিস সংক্রমণের পিছনে আবহাওয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের একাংশ। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডেপুটি সুপার বিজয় থাপার মতে, ‘‘বৃষ্টি এবং তার পরেই কয়েক দিন টানা রোদ, গরম বিভিন্ন এলাকায় জমে থাকা জলে মশার বংশ বিস্তারের পক্ষে উপযোগী। টানা ভারী বৃষ্টি হলে জলে থাকা মশার লার্ভা ধুয়ে যায়। এই আবহাওয়া জেই বা এইএস এর বাহক কিউলেক্স মশার বংশবৃদ্ধির উপযোগী। বকের মতো পাখি থেকে মশার শরীরে এই জীবাণু আসে।’’