Advertisement
E-Paper

গ্লুকোমা: নিঃশব্দ অন্ধত্বের প্রধান কারণ

চলছে গ্লুকোমা সপ্তাহ (১০ মার্চ-১৬ মার্চ)। গ্লুকোমা পৃথিবীতে সবথেকে বেশি অপরিবর্তনীয় অন্ধত্বের কারণ। পৃথিবীতে অনুমানিক ৪ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। আমরা গ্লুকোমা নিয়ে কতটা সচেতন লিখছেন ভাস্করদেব মুখোপাধ্যায়। (লেখক চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মতামত নিজস্ব) চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গিছেন বহু মানুষই। আমাদের অগোচরে এই দৃষ্টির ক্ষেত্র (ফিল্ড অব ভিশন) ক্রমশঃ সংকীর্ণ হতে হতে পূর্ণ অন্ধত্বের রূপ নেয়।

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৯ ০৪:৪৪
গ্লুকোমা রোগী দেখছেন চিকিৎসক ভাস্করদেব মুখোপাধ্যায়। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

গ্লুকোমা রোগী দেখছেন চিকিৎসক ভাস্করদেব মুখোপাধ্যায়। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গিছেন বহু মানুষই। আমাদের অগোচরে এই দৃষ্টির ক্ষেত্র (ফিল্ড অব ভিশন) ক্রমশঃ সংকীর্ণ হতে হতে পূর্ণ অন্ধত্বের রূপ নেয়। এই অন্ধত্বকারী রোগের নামই হল গ্লুকোমা।

গ্লুকোমা পৃথিবীতে সবথেকে বেশি অপরিবর্তনীয় অন্ধত্বের কারণ। পৃথিবীতে অনুমানিক ৪ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। ভারতবর্ষে এর আকারও ভয়াবহ। প্রায় ১ কোটি ২ লক্ষ মানুষ এই রোগাক্রান্ত এবং তার মধ্যে ১০ শতাংশ রোগীর অনেক দেরিতে গ্লুকোমা রোগ ধরা পরে। তার ফল যথেষ্ট খারাপ হয়। গ্লুকোমা একটি চোখের রোগ। এর ফলে চোখের অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার সঙ্গে সঙ্গে চোখের দৃষ্টি কমে যেতে থাকে। চোখের নার্ভ নষ্ট হওয়ার ফলেই দৃষ্টি কমে যেতে থাকে এবং ধীরে ধীরে মানুষের জীবনে অন্ধত্ব আসে।

আমাদের চোখের একটা নির্দিষ্ট প্রেসার বা চাপ থাকে যাকে ইন্ট্রা অকুলিয়র প্রেসার (আই ও পি) বলে। চোখের এই নির্দিষ্ট চাপ চোখের অভ্যন্তরে যে অ্যাকুয়াস হিউমার তৈরি হয় তার জন্য বজায় থাকে। চোখের এই তরল পদার্থটি সিলিয়ারি বডি থেকে উৎপন্ন হয় এবং ট্র্যাবেকুলার মেসওয়ার্ক এর কাছে স্লেমস্ ক্যানাল এর মধ্যে দিয়ে বাইরে রক্তবাহিকাতে প্রবেশ করে। এই তরল পদার্থটি আমাদের চোখের মনি (কর্নিয়া) ও লেন্সকে পরিপোষক পদার্থ সরবরাহ করে। অ্যাকুয়াস হিউমারের অতিরিক্ত ক্ষরণ অথবা নির্গমনে বাধাপ্রপ্ত হলে আই ও পি বেড়ে যায়। আমাদের সাধারনভাবে চোখের আই ও পি ১৬-২০ mm Hg – র মধ্যে বজায় থাকে। আই ও পি বেড়ে গিয়ে যখন পিছনের পর্দা অপটিক নার্ভে চাপ পড়ে তখন সেই নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা আমরা রেটিনা পরীক্ষা করে বুঝতে পারি। এই নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং তার সঙ্গে দৃষ্টিক্ষেত্র কমে যাওয়াকে সমষ্টিগতভাবে গ্লুকোমা বলা হয়।

সাধারণভাবে গ্লুকোমা রোগীর কোনও বিশেষ লক্ষণ দেখা যায় না। বিশেষ ক্ষেত্রে দৃষ্টি কমে যায় বা ঝাপসা হয়ে আসে, চোখে অনেক সময় রামধনু রং দেখা যায় ও বিশেষ এক ধরনের গ্লুকোমা রোগে চোখে অসম্ভব ব্যথা হয়ে লাল হয়ে যায় এবং দৃষ্টি প্রায় ঝাপসা হয়ে ওঠে।

কিছু কিছু মানুষের এই রোগের প্রবণতা দেখা যায়। যাঁদের অতিরিক্ত মাইনাস পাওয়ার, যাঁরা মধুমেহ রোগাক্রান্ত, পূর্বে চোখে কোন আঘাত পেয়ে থাকলে, পরিবারে যদি কারুর গ্লুকোমা রোগের প্রকোপ থেকে থাকে, বহুদিন ধরে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে গ্লুকোমা হতে পারে।

এই রোগ যেহেতু সাধারণভাবে কোন লক্ষণ দ্বারা ধরা সম্ভব নয় তাই প্রথমে রোগীর চোখের প্রেশার বা আই ও পি চেক করা হয়। অ্যাপ্লানেসন টনোমেট্রি হল আই ও পি মাপার আদর্শ যন্ত্র। আই ও পি দেখার পর গোনিওস্কোপির মাধ্যমে চোখের ভিতরের কোণগুলো পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। চোখের কোণ বলতে কর্নিয়ার পিছনের স্তর ও আইরিশ–এর মধ্যবর্তী কোণকেই বুঝি। এই পরীক্ষার মাধ্যমে গ্লুকোমাকে ওপেন অ্যাঙ্গল বা ক্লোজড অ্যাঙ্গল গ্লুকোমাতে ভাগ করা হয়। সাধারণভাবে ওপেন অ্যাঙ্গল গ্লুকোমা বেশি দেখা যায়। অ্যাঙ্গল দেখার পরে অবশ্যই চোখের নার্ভ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা পর্যবেক্ষণ করা হয়। চিকিৎসাগতভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর অটোমেটেড পেরিমেট্রি করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে চোখের কতটা দৃষ্টি ক্ষেত্র নষ্ট হয়েছে তা ধরতে পারা যায়। পেরিমেট্রির দ্বারা আমরা চিকিৎসাগতভাবে তুলনা করতেও পারি। কোন ব্যক্তির চিকিৎসা কতটা ফলস্বরূপ হয়েছে তা মূল্যায়ন ও বিচার এই পরীক্ষার দ্বারাই সম্ভব। এছারা ও সি টি (অপটিকাল কোহেরেন্স টোনোগ্রাফি) এর মাধ্যমে নার্ভের কতটা ক্ষতি হয়েছে তার আনুমানিক হিসাব করে ওঠা যায়।

গ্লুকোমা দুই রকমের-ওপেন অ্যাঙ্গেল ও ক্লোসড অ্যাঙ্গেল। সাধারণভাবে ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা অতিরিক্ত অ্যাকুয়াস হিউযার তৈরির ফলে হয় এবং ক্লোসড্ অ্যাঙ্গেল অ্যাকুয়াস হিউমার বেরোবার পথে প্রতিবন্ধকতা হবার ফলে হয়। ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমাতে রোগীর স্বাভাবিক ভাবে কোন লক্ষণ থাকে না, তার কেন্দ্রীয় দৃষ্টিক্ষেত্র স্বাভাবিক থাকে। যত দিন যেতে থাকে তার পার্শ্বীয় দৃষ্টিক্ষেত্র ক্রমশঃ কমতে থাকে। যখন ওই নার্ভ এতটাই ক্ষতি হয়ে যায় যে কেন্দ্রীয় দৃষ্টিক্ষেত্র আক্রান্ত হয় তখন রোগী বুঝতে পারেন যে তাঁর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে। এই সময় তাঁর চোখে অনেকটাই অপরিবর্তিত দৃষ্টিহানি হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই জন্য এই রোগকে নিঃশব্দ অন্ধত্বের প্রধান কারণ হিসাবে ধরা হয়। তাই যে সব পরিবারে এই রোগ আছে তাঁদেরকে খুব সতর্ক থাকতে হয় ও মাঝে মাঝে চোখের ডাক্তারকে দিয়ে সমস্ত রকম গ্লুকোমার পরীক্ষা করিয়েও নিতে হয়।

অ্যাঙ্গল ক্লোজার গ্লুকোমাতে রোগীর চোখে অনেক সময় ব্যথা হয় ও ঘন ঘন চোখে চালশের চশমা বদলাতে হয়। এই জাতীয় গ্লুকোমাতে হঠাৎ প্রবল ব্যথা হয়, লাল চোখ হয়ে ঝাপসা হওয়ার সম্ভাবনা হয় তখন সেই অবস্থাকে তীব্র আক্রমণ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এতে রোগীর দৃষ্টি একেবারে চলে যায়। এই অবস্থাতে আমরা জরুরীভিত্তিতে চিকিৎসা করে থাকি।

আই ও পি শুধুমাত্র বেড়ে থাকাকেই গ্লুকোমা বলা হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আই ও পি স্বাভাবিক বা কম থাকার ফলেও অপটিক নার্ভের অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হতে থাকে। এই ধরনের রোগকে নর্মোটেনসিভ বা লো টেনসন গ্লুকোমা বলা হয়। এই দুটি রোগ আরও মারাত্মক রূপ নেয় কেন না গ্লুকোমার জন্য আই ও পি মাপাই একমাত্র নির্ণায়ক সূচক নয়। এসব ক্ষেত্রে অপটিক নার্ভ ও দৃষ্টি ক্ষেত্র পরীক্ষা করা ছাড়া এই রোগ ধরাও সম্ভব নয়। এই রোগটি আরও মারাত্বক কারণ রোগী সব ক্ষেত্রেই চোখের চশমার পরীক্ষা করিয়ে থাকেন ও আই ও পি মাপা হয়ে থাকে। যেহেতু স্বাভাবিকভাবে আই ও পি বেশী থাকলেই গ্লুকোমা হয়েছে বলে ভাবা হয় তাই স্বাভাবিক বা কম আই ও পি আছে যেসব রোগীর তাদের ক্ষেত্রে দৃষ্টি ক্ষেত্র পরীক্ষা সাধারণভাবে (অটোমেটেড পেরিমেট্রি) করা হয় না। সেজন্য সমস্ত রোগীর অপটিক নার্ভ হেডের পরীক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন। সেইখানে সংশয় দেখা দিলে পরবর্তী পদক্ষেপ যেমন অটোমেটেড পেরিমেট্রি বা ও সি টি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাই যে সব ব্যক্তির চোখে মাইনাস পাওযার বা পরিবারের কেউ গ্লুকোমা রোগাক্রান্ত আছেন বা বহুদিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করছেন তাঁরা অবশ্যই চোখের ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। তাঁদের ক্ষেত্রে হয়তো কোন লক্ষন নেই কিন্তু নিয়মিত চোখের আই ও পি মাপবেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিক্ষেত্র পরীক্ষা করানো হলে অন্ধত্বের আভিশাপ থেকে বাঁচা সম্ভব।

Health Tips Health ‎Glaucoma
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy