ভক্তি মাদারি।—নিজস্ব চিত্র।
হঠাৎ করেই দু’চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হতে হতে অন্ধকার নেমে আসছিল। চেনা পৃথিবীটা দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে বসেছিল।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য তা হয়নি। কোনও এক জনের মরণোত্তর কর্নিয়া তাঁর চোখে প্রতিস্থাপিত হওয়ায় চেনা জগৎটাকে আবার তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আগের মতোই।
তিনি— জাঙ্গিপাড়ার যুবক ভক্তি মাদারি। মরণোত্তর কর্নিয়া তাঁর চোখে প্রতিস্থাপিত না হলে কী হতো, ভাবতে এখনও শিউরে ওঠেন। আর তাই দৃষ্টি ফিরে পেয়েই মরণোত্তর চক্ষুদানের প্রয়োজনীয়তা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচারে নেমে পড়েছেন পুরোদমে।
আদতে হাওড়ার আমতার বাসিন্দা হলেও স্ত্রী দীপালি, অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া মেয়ে সুস্মিতা এবং ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া ছেলে রানাকে নিয়ে ভক্তি বর্তমানে থাকেন জাঙ্গিপাড়ার রাধানগর পঞ্চায়েতের চণ্ডীনগর গ্রামে। কলকাতায় এক জনের গাড়ি চালানোই ছিল তাঁর জীবিকা। ২০১১ সালের গোড়ার দিকে এক দিন তাঁর ডান চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করে। চোখ লাল হয়ে যায়। শিয়াখালায় চিকিৎসকের কাছে যান। কিন্তু সমস্যা মেটে না। উল্টে, চোখে কম দেখতে শুরু করেন। বাঁ চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হতে থাকে। কর্নিয়ার উপরটা সাদা হয়ে যায়। ডান চোখেরও দৃষ্টি কমতে থাকে। এ বার তিনি যান শেওড়াফুলির একটি চক্ষু হাসপাতালে।
এর পরেই হাসপাতালের চিকিৎসকদের কথায় ভক্তির রাতের ঘুম উবে যায়। ভক্তির কথায়, ‘‘ওখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বলা হয়, কর্নিয়ার সমস্যার কারণে তাঁর দৃষ্টিশক্তি কমছে। কর্নিয়া বদলাতে হবে।’’ কিন্তু কোথায় মিলবে কর্নিয়া? কত টাকা লাগবে অস্ত্রোপচারে? ভেবে কূল পান না ভক্তি।
তখনই তাঁর যোগাযোগ হয় জাঙ্গিপাড়া স্বেচ্ছাসেবী রাজবলহাট কালচারাল সার্কেল ও সেবায়নের সদস্যদের সঙ্গে। সংগঠনটি মরণোত্তর কর্নিয়া সংগ্রহ এবং বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করে। তাদের হাত ধরেই ২০১৩ সালের গোড়ায় ভক্তি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছন। ওই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ওই হাসপাতালেই তাঁর চোখে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়। তার পরে আরও কিছু দিন চিকিৎসা চলে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় কার্যত নিখরচায়। শুধু ওষুধ কিনতে হয়েছিল।
কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পরে আবার আগের মতো দৃষ্টি ফিরে পান ভক্তি। কলকাতার কাজ ছেড়ে এখন জাঙ্গিপা়ড়া গ্রামীণ হাসপাতালে এক স্বাস্থ্যকর্তার গাড়ি চালান। আর কাজের ফাঁকে চলে তাঁর মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে প্রচার। আর সেই প্রচারে তাঁর হাতিয়ার নিজের কাহিনিই। সংসারে তিনিই একমাত্র রোজগেরে। চোখে দেখতে না পাওয়ায় তিন বছর কার্যত বসে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। সংসার চালানো দায় হয়ে উঠেছিল। জমি বিক্রি করতে হয়েছিল। অন্যের কর্নিয়ায় ফেরত পাওয়া দৃষ্টি নিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
ভক্তির কথায়, ‘‘নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি, মৃত্যুর পরে চক্ষুদানের উপযোগিতা। কার কর্নিয়ায় আমি দেখতে পাচ্ছি, জানি না। কিন্তু এটুকু বুঝেছি, ঠিকমতো প্রচার হলে আর মানুষ কুসংস্কারমুক্ত হলে বহু দৃষ্টিহীন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। এ জন্য যতদিন পারব, প্রচার চালিয়ে যাব। নিজেও মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করে যাব।’’
প্রতি বছর ২৫ অগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতীয় অন্ধত্ব দূরীকরণ পক্ষ পালিত হয়। এ রাজ্যেও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ১৫ দিন নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। জাঙ্গিপাড়ার ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে প্রচার কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন ভক্তি। সংগঠনের সদস্য সুরজিৎ শীল বলেন, ‘‘মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে সরকারি ভাবে প্রচার তেমন হয় না। অনেকেই কুসংস্কারের জন্য প্রিয়জনের মৃত্যুর পরে চক্ষুদানে সম্মত হন না। কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূরীকরণে এটাই বড় সমস্যা। ভক্তিদা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষকে বোঝাচ্ছেন, মরণোত্তর চক্ষুদানের প্রয়োজন ঠিক কতটা।’’
যাতে কর্নিয়ার সমস্যায় এই সুন্দর পৃথিবীটা কারও দৃষ্টির আড়ালে চলে না যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy